: মুহম্মদ নূরুল ইসলাম :
২০১২ সালের ২৩ আগস্ট বৃহস্পতিবার। পূর্ব সিদ্ধান্ত মতে ফজরের নামাজ শেষে নাস্তা সেরে যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বের হব। একই সাথে অচেনা কথিত জ্বীনের দেশে যাব। জ্বীনের দেশে নাকি পানির স্রোত উল্টো দিকে যায়, স্টার্ট না দিলেও গাড়ি চলে। বিষয়টি কেমন গা ছম ছম করা, এক অদৃশ্য ও অজানা আতঙ্ক। মনের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। শরীরের মধ্যে এক অজানা শিহরণ। কম-বেশি জ্বীনের কথা শুনেছি, পবিত্র কুর’আন শরীফে জ্বীনের কথা আছে। পবিত্র কুর’আনে ‘সুরা আল জ্বীন’ নামের একটি সুরাও আছে। সুরা আল জ্বীন পড়লেও তার অর্থসহ অন্যান্য বিষয় আমার জানা নেই। এসব বুঝার চেষ্টাও করিনি। কিন্তু জ্বীনের দেশের কথা শুনিনি। জ্বীনের অবয়ব দেখিনি। ফলে যে কোন মানুষের পক্ষেই এই অজানা রহস্য ভেদ করার এক প্রবল আগ্রহ থাকে, থাকবেই। রহস্য ভেদ করতে পারুক বা না পারুক সবাই একবার চেষ্টা করে দেখে। আমার মনের মধ্যেও সেই আকুতি। আগ্রহ নিয়েই অপেক্ষায় আছি কখন সকাল হবে। কখন নাস্তা সেরে জ্বীনের দেশে যাব।
আমি আর লিলি, লিলি মানে আমার স্ত্রী কবি হাসিনা চৌধুরী লিলি ২১ আগস্ট মঙ্গলবার আসরের নামাজের পরে পবিত্র আল-মদিনা আল-মনোয়ারায় যেসব স্থানে যিয়ারতের বিধান আছে সেসব জায়গায় গেছি, নামাজ আদায় করেছি, ঘুরে এসেছি। মসজিদে কুবা, মসজিদে কিব্লাতাইন, মাসজিদে ফাতাহ্সহ পাঁচ মসজিদ-এ নামাজ আদায় করেছি। দেখে এসেছি জঙ্গে ‘ওহুদ’। ওহুদ ময়দানে গিয়ে মুসলমানদের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর যোদ্ধা হযরত আমির হামজা’র কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়েছি। সাথে ছিল ভাতিজা শাহ আলম। আমরা ২১ আগস্ট’২০১২ মঙ্গলবার ভোর ৪টায় আল-মদিনা আল-মনোয়ারায় পৌঁছি। মদিনা মনোয়ারায় পৌঁছে হোটেলে উঠার আগেই পবিত্র মসজিদ-এ নব্বীতে ফজরের নামাজ আদায় করি। পরে আমরা হোটেলে উঠি।
আল-মদিনা আল-মনোয়ারা নগরীর ধারেপাশেই অজ্ঞাত জ্বীনের দেশে যাব নসরুল্লাহ’র গাড়িতে করে। নসরুল্লাহ কক্সবাজারের ছেলে। সে মক্কা নগরীতে হারাম শরীফের পাশে ব্যবসা করে। নসরুল্লাহ নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছে। সে ড্রাইভার রাখেনি। বিদেশ-বিভুইয়ে ড্রাইভার রাখা আরেক ঝামেলা। নসরুল্লাহ ২২ আগস্ট বুধবার তার স্ত্রী আয়েশা ও তাদের একমাত্র দুগ্ধপোষ্য কন্যা ফারিয়াকে নিয়ে নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে সুদূর মক্কা শরীফ থেকে আল-মদিনা আল-মনোয়ারা’র মসজিদে নব্বীতে এসেছে। নসরুল্লাহ’র সাথে আমার দেখা হয় কাকতালীয় ভাবে। তাও পবিত্র মসজিদে নব্বিতে। ২২ আগস্ট আসরের নামাজ পড়ার জন্য আমি আর লিলি মসজিদে নব্বীতে প্রবেশ করেছি। ইতোমধ্যে লিলি মেয়েদের নামাজের নির্দিষ্ট স্থানে ঢুকে পড়েছে। আমি মসজিদের কম্পাউন্ড থেকে ভেতরে যাচ্ছি। ঠিক এসময় পেছন থেকে শুনতে পেলাম ‘আঙ্কেল, আঙ্কেল’ শব্দ। মসজিদে নব্বীতে বাংলা উচ্চারণে ‘আঙ্কেল’ শব্দ শুনলে স্বাভাবিক ভাবেই ফিরে থাকার কথা। আমিও কৌতুহলবশত পেছনে ফিরে তাকালাম। পেছনে ফিরে দেখলাম এক সুশ্রী যুবক। গায়ে সৌদি আরবের লম্বা জোব্বা। আমাকে ‘আঙ্কেল’ সম্বোধন করা ব্যক্তি সে যুবক কিনা আমি সন্দেহ পোষণ করলাম। ফর্সা, দোহারা গঠনের যুবক। তার শরীরের অবয়বে মনে হচ্ছিলÑ সে সৌদি আরবের বা মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশের বাসিন্দা। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের কোন যুবকের মুখ থেকে বাংলা উচ্চারণে ‘আঙ্কেল’ শব্দ বের হওয়া স্বাভাবিক নয়। আমার অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে সে বলে উঠলোÑ ‘আমি নসরুল্লাহ’। নসরুল্লাহ’র সাথে পূর্বে আমার দেখা হয়নি। তার সাথে পূর্বে আমার দেখা না হলেও কক্সবাজারে আমাদের পরিবারে তার আসা-যাওয়া আছে। সে সম্পর্কে আমাদের আত্মীয় হয়। নসরুল্লাহ্’র সাথে আমার বয়সের ব্যবধানটা একটু বেশি কিনা সেজন্যই তার সাথে আমার দেখা হয়নি। তবে সৌভাগ্যবশত সে আমাকে চিনে। সাথে তার স্ত্রী-কন্যাও রয়েছে। আলাপ পরিচয়ের পরে নসরুল্লাহ’র স্ত্রী আয়েশা মহিলাদের নামাজের নির্দিষ্ট জায়গায় ঢুকে পড়লো নামাজ আদায় করতে। আমি নসরুল্লাহ ও তার কন্যা ফারিয়াকে নিয়ে বাদশা ফাহাদ গেইট দিয়ে মসজিদে নব্বীতে প্রবেশ করলাম।
২৩ আগস্ট বৃহস্পতিবার ফজরের নামাজ শেষে নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-র রওজা মোবারক যিয়ারত শেষে বের হয়ে আমি আর নসরুল্লাহ গেলাম জান্নাতুল বাকী’তে। লিলি, আয়েশা এবং নসরুল্লাহ’র মেয়ে নিচে মসজিদে নব্বীর প্রাঙ্গনে রয়েছে। জান্নাতুল বাকী’তে শুয়ে আছেন নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পরিবারের সদস্য, সাহাবাবৃন্দ থেকে শুরু করে অনেক নিকটজন। যাঁরা মূলত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে ইসলামের খেদমতে এবং মুসরিকদের সাথে যুদ্ধ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় নিজেদেরকে ইসলামের জন্য উৎসর্গ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন, হযরত বিবি ফাতেমা (রাঃ), হযরত ইমাম হাসান (রাঃ), হযরত ইমাম জয়নাল আবেদীন (রাঃ), হযরত ইমাম বাকের (রাঃ), রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর চাচা হযরত আব্বাস (রাঃ), রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অপর তিন কন্যা, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নয় স্ত্রী, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর চাচী, হযরত ইমাম মালিক (রাঃ), রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর শিশু পুত্র ইব্রাহিম, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দুধ-মাতা বিবি হালিমা, ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রাঃ)-এর নাম উল্লেখযোগ্য। তবে রাসূলুল্লাহ তনয়া হযরত বিবি ফাতেমা (রাঃ)‘র কবর জান্নাতুল বাকী’তে কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেকের মতে হযরত বিবি ফাতেমা (রাঃ)’কে তাঁর নিজের ঘরেই দাফন করা হয় যা বর্তমানে মসজিদে নব্বী’র অন্তর্ভুক্ত। অপর দিকে প্রথমাবস্থায় খোলাফায়ে রাশেদিনের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রাঃ) কবর ছিল জান্নাতুল বাকী’র বাইরে। পরবর্তীতে জান্নাতুল বাকী’কে সম্প্রসারণ করা হলে হযরত ওসমানের (রাঃ) কবর বর্তমান সীমানা প্রাচীরের অভ্যন্তরে চলে আসে।
হযরত ওসমান (রাঃ)-এর কবর এবং তাঁর দাফন নিয়েও রয়েছে এক লোমহর্ষক কাহিনী। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ওফাতের পরে মুসলমানদের গৃহযুদ্ধের শিকার হযরত ওসমান (রাঃ)। ইসলামের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, বিদ্র্রোহীরা হযরত ওসমান (রাঃ)-এর বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখে। বাড়ি অবরুদ্ধ করে রেখে বিদ্রোহীরা হযরত ওসমান (রাঃ)-এর খলিফার পদ থেকে সরে যেতে আহবান জানান। তিনি পদত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। তাঁকে গোপনে মক্কা কিম্বা সিরিয়ায় চলে যাবার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়, কিন্তু তিনি মদিনা ছাড়তে রাজি হননি। যার ফলশ্রুতিতে বিদ্রোহীরা বাড়িতে প্রবেশ করে হযরত ওসমান (রাঃ)’কে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এসময় তিনি পবিত্র কুর’আন অধ্যয়নে রত ছিলেন। পবিত্র কুর’আন হযরত ওসমান (রাঃ)-এর পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হয়ে পড়ে। হযরত ওসমান (রাঃ)-এর মরদেহ তিনদিন এভাবে পড়ে থাকে। পরে বিদ্রোহীরা রাতের অন্ধকারে জান্নাতুল বাকী’র বাইরে তাঁকে দাফন করে। সে সময় জান্নাতুল বাকী’র বিস্তৃতি ছিল অনেক ছোট। সে কারণেই ইসলামের তৃতীয় খলিফার কবর জান্নাতুল বাকী’র প্রবেশ মুখে না হয়ে অনেক ভেতরে হয়েছে। বিষয়টি হতবাক করার মত।
জান্নাতুল বাকী’তেও প্রচন্ড ভীড়। ভীড় ঠেলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দেখি সশস্ত্র লোকজন। যাঁরা মূলত দর্শনার্থী এবং জিয়ারতে আগত লোকজনকে নিয়ন্ত্রণ করছে, আবার কেউ শিরক করতে চাইলে তাতে বাধা দিচ্ছেন। অনেক হাজ্বী জান্নাতুল বাকী’তে গিয়ে কান্না-কাটি করে বুক ফাঁটিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খায় একই সাথে কবরে সেজদা করার চেষ্টা করে।
জান্নাতুল বাকীতে দোয়া পড়ে আমি আর নসরুল্লাহ নিচে নেমে লিলি, আয়েশা এবং নসরুল্লাহ’র মেয়েকে নিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। নসরুল্লাহ তার স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে উঠেছে ঢাকা হোটেলের পাশে একটি হোটেলে। আমাদের হোটেল ছেড়ে আরো একটু উত্তর-পশ্চিম দিকে গেলেই নসরুল্লাহ‘র হোটেল পড়বে। তার হোটেলের নাম ‘দারুল আনসার’। ‘দারুল আনসার’ হোটেল মসজিদে নব্বীর খুব কাছেই। সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিটের পায়ে হাঁটা পথ। হোটেলে বসেই সকালের নাস্তা সারতে সারতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আমরা অপরিচিত জায়গায় যাব তাই একজন স্থানীয় গাইড প্রয়োজন। নসরুল্লাহ বললো, ‘এই হোটেল পরিচালনা করে রুমেল নামের এক ভদ্রলোক। তার বাড়ি চট্টগ্রামে। তিনি হোটেলটি ভাড়া নিয়ে পরিচালনা করছেন। পবিত্র মক্কা এবং মদিনা মনোয়ারার হারাম শরীফের চারপাশে যেসব হোটেল আছে তার মালিক সৌদি নাগরিক। পরিচালনার জন্য মালিকেরা এসব হোটেল বাৎসরিক ভিত্তিক ভাড়া দিয়ে দেয়। ভাড়া গ্রহণকারীদের মধ্যে বাংলাদেশী, পাকিস্তানী এমন কি ভারতীয়রাও রয়েছে। বাংলাদেশীদের মধ্যে বৃহত্তর চট্টগ্রামের লোকজন বেশি। নসরুল্লাহ বললো রুমেলের সাথে আমার পরিচয় আছে। তাঁকে বলেছি আমাদের সাথে যাবার জন্য, তিনি রাজি হয়েছেন।’
নাস্তা খাওয়া শেষ। আমরা রুমেলের অপেক্ষায়। মোবাইলে রুমেলের সাথে যোগাযোগ করা হলো। তিনি তখনও ঘুম থেকে উঠেননি। ফলে আমাদেরকে বিকল্প চিন্তা করতে হলো। তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নিয়েই যেতে হবে। হোটেলের ম্যানেজার তাঁর পরিচিত এক গাইডকে খবর দিলেন। দশ মিনিটের মধ্যেই তিনি হোটেলে উপস্থিত। আমরা উপর থেকে নিচে নেমেই দেখতে পেলাম হোটেলের অভ্যর্থনা কক্ষে বসে আছেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। বয়স আনুমানিক ৫০ থেকে ৬০ এর মধ্যে, সুগঠিত শরীর। পেশীতে টান ধরেনি। তিনি জন্মগত ভাবে পাকিস্তানী। অনেক দিন ধরে আল-মদিনা আল-মনোয়ারায় তার বসবাস। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। ইতোমধ্যে ভোরের স্নিগ্ধতা কেটে সূর্যের আলো বিকিরণ ছড়াতে শুরু করেছে।
নসরুল্লাহ্ গাড়ি ড্রাইভ করছে। গাইড মোজাফ্ফর আহমদ রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছেন। সকাল ৯টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম ওহুদ প্রান্তরে। ওহুদ প্রান্তর ছিল আমাদের পরিচিত। আমি, লিলি দু’দিন আগেই ওহুদ প্রান্তর থেকে ঘুরে গেছি। ওহুদ প্রান্তরে গিয়ে যিয়ারত শেষে আবার বাংলায় লিখা সাইন বোর্ডটি পড়লাম। ভাল লাগলো সুদূর আল-মদিনা আল-মনোয়ারার ওহুদ প্রান্তরে বাংলা বর্ণে লেখা সাইন বোর্ড দেখে। সাইন বোর্ডে বাংলায় যিয়ারতের দোয়া লেখা। পাশাপাশি দু’টি সাইন বোর্ড। একটি বাংলা অপরটি আরবিতে। ডান পার্শ্বে রয়েছে আরবিতে লেখা সাইন বোর্ডটি। পৃথিবীর এত ভাষাভাষি মানুষের যাতায়াত ওহুদ প্রান্তরে। অন্য কোন ভাষার সাইন বোর্ড চোখে পড়লো না। আরবির পাশাপাশি শুধু বাংলা সাইন বোর্ড। গর্বে বুক ফুলে উঠলো। কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরের একটি বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক প্রান্তরে মাতৃভাষায় লেখা সাইন বোর্ড দেখলে কার না ভাল লাগে।
গরম তেতে উঠার আগেই আমরা জ্বীনের দেশে যেতে চাই। সেভাবেই বলা হলো গাইডকে। গাইড আমাদেরকে ওদিকে নিয়ে যেতে লাগলেন। গাইডের দেখিয়ে দেয়া রাস্তা ধরে নসরুল্লাহ গাড়ি চালাচ্ছেন। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি খেজুর বাগান। গাছে গাছে কাঁচাপাকা খেজুর ঝুলছে। কোন কোন গাছে পাকা খেজুরে দেয়া হয়েছে জাল। জাল পেঁচিয়ে পাকা খেজুর আটকে রাখা হয়েছে। এতে খেজুর যেমন নিচে পড়ছে না তেমনি ভাবে কোন পাখিও খেতে পারছে না। পাকা খেজুর দেখে জিহ্বায় জল এসে যাচ্ছিল। গাছে পাকা খেজুর দেখে শৈশবের দুরন্ত সময়ের কথা মনে পড়ে গেল। বাল্যকালে আমি, জেঠাতো ভাই মোবারক, ইলিয়াছ, ভাতিজা বাবুল, আমিন সবাই মিলে গ্রামের বাড়ির, পরিবারের এবং পড়শীদের পাকা আম, জাম, কলা, পেপে কাঁচা শসা, ডাব, নারিকেল, আঁখ কতই না গাছ থেকে ছিঁড়ে খেয়েছি। এসব ছিলো নেহায়েতই শৈশব-কৈশোরের দুরন্তপনা। কোন কোন সময় জেঠি, বয়োঃজ্যেষ্ঠরা বা গৃহকর্ত্রীরা বকাঝকা করলেও শিশুসুলভ আচরণের কারণে তা সিরিয়াসলি নিতো না। বর্তমানে গ্রামের মানুষের কাছ থেকে সে আচরণ কল্পনাও করা যায় না। যেতে যেতে গ্রামের চির পরিচিত দৃশ্য দেখে নষ্টালজিয়ায় ভুগছিলাম।
রাস্তার উপর থেকে দেখা যাচ্ছিল খেজুর বাগানের ফাঁকে ফাঁকে পাকা দালানও। খেজুর বাগানের বেশ পেছনে পাহাড়ের সারি। রুক্ষ পাহাড়। পাথরের পাহাড়। পাথর আর পাথর। যাতে মাটির লেশমাত্রও নেই। সে পাহাড়ে নেই সবুজের টিকিটিও। তবে পাহাড়ের নিচে উপত্যকায় ধুধু বালিতে আরবের কাঁটাযুক্ত গাছ আছে। সে গাছেও পাতার পরিমাণ কম। প্রায় ১৫ কিলোমিটার যাওয়ার পরে রাস্তার দু’পাশেই বিশাল বিশাল সাইন বোর্ড। সাইন বোর্ড জুড়ে রয়েছে সাদা মাছের ছবি। সাইন বোর্ডের লিখা আরবিতে। রাস্তা যথারীতি চার লেইন বিশিষ্ট। গাইড মোজাফ্ফরের কাছ থেকে জানতে চাইলামÑ সাইন বোর্ডে কি লিখা আছে। উত্তরে মোজাফ্ফর জানালেন, এখানে মাছের খামার। তার উত্তর শুনে আমার চোখ ছানা-বড়া।
বলে কি মোজাফ্ফর!
সুদূর আরব দেশে, তাও আবার পাথরের রুক্ষ পাহাড়ের ঢালুতে, ধুধু মরুর বালিতে মাছের চাষ! সাইন বোর্ডে মাছের ছবি দেখে বিষয়টি কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু তা বাস্তবিকই মাছের চাষ তা অবাক করার মতো। রাস্তার দু’ধারেই বেশ কয়েকটি মৎস্য প্রকল্পের সাইনবোর্ড। মনে মনে ঈর্ষা কাতর হলেও ভাল লাগলো অন্তত আরবের মানুষ আরাম-আয়েশের দিন পেছনে ফেলে রেখে বাস্তবতার দিকে ধাবিত হচ্ছে ভেবে। গভীর নলকূপ দিয়ে পানি তুলে মাছের চাষ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বা অন্যদেশে যেভাবে মাছের খাঁচা তৈরি করে মাছ চাষ করা হচ্ছে মদিনাতেও সে দৃশ্য। মাছের খামারের পাশে সবুজের সমারোহ। বিভিন্ন সব্জির ক্ষেত। পিকআপ ভর্তি করে তা বাজারজাত করা হচ্ছে। এসব মাছের খামারে এবং সব্জি ক্ষেতেও রয়েছে বাঙালিদের হাত। বাংলাদেশের অনেক শ্রমিক সে সব প্রকল্পে শ্রম দিয়ে মরুভূমিকে সবুজে ভরিয়ে দিচ্ছে। সরকারি নির্দিষ্ট পোষাকে রাস্তার পাশের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করছে। দেখা গেলো এসব লোকজনও বাংলাদেশের। যারা আবর্জনা পরিষ্কার করে এদেশে তাদেরকে ‘বলদিয়া’ বলা হয়। তবে পবিত্র মক্কার বাবে ক্বাবা ও মদিনা মনোয়ারার মসজিদে নব্বীতে যারা পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে আছে তাদেরকে ‘বলদিয়া’ বলা হলেও বাংলায় কিন্তু তাদেরকে ‘সেবক’ বলা হয়। এই পবিত্র মসজিদদ্বয়েও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েক হাজার সেবক রয়েছে।
সড়ক ধরে এগুতেই ডান দিকে সাইন বোর্ড দেখা গেল মদিনা বিমান বন্দরের। ডান দিকে আরেকটি রাস্তা টার্ন নিয়ে চলে গেছে। আমরা সোজাই চলতে লাগলাম। আরো প্রায় ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার যাওয়ার পরে দেখা গেলো রাস্তার পাশে পার্কের মতো স্থাপনা রয়েছে। সেখানে রয়েছে ছোটখাট স্থাপনা ও অবকাঠামো। খেলার জন্য রাইডারসহ বিভিন্ন উপকরণ। মোটর সাইকেল করে মরুর তপ্ত বালি উড়িয়ে খেলা করছে। উক্ত পার্কের উল্টো দিকে আরবের কাঁটাযুক্ত গাছের ফাঁকে লোকজন দাঁড়িয়ে অবসর নেওয়ার চেষ্টা করছে যদিওবা কিছু উত্তপ্ত বাতাস ছাড়া আর কিছু নেই। গাড়ি থেকেই চোখে পড়লো একটি পিকআপ দাঁড়িয়ে আছে। চারজন মানুষ দাঁড়িয়ে পানির বোতল রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে। গাইড মোজাফ্ফর গাড়ি থামাবার জন্য বললেন। গাড়ি থামার সাথে সাথে আমরাও গাড়ি থেকে নামলাম। আমরাও দেখলাম পানির বোতল রাস্তার উপরের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। যতই নিচের দিকে ঠেলে দিক না কেন কিন্তু বোতল ঠিকই উপরের দিকে গড়িয়ে যেতে থাকলো। বিষয়টি অবাক করার মতো। এসময় হঠাৎ শরীরের বিদ্যুতের শিহরণ বয়ে গেল। গাইড মোজাফ্ফর বললেন, এখান থেকেই জ্বীনের রাজ্য শুরু। গাইড বললেন, এই রাস্তাটি সামনে আরো দুই কিলোমিটার গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। সৌদি আরব সরকার অনেক চেষ্টা করেও এখানে আর রাস্তা করতে পারেনি। সৌদি আরবের বিভিন্ন এলাকায় বিশাল বিশাল পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করা হলেও এই ক্ষুদ্র পাহাড় কাটা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। দেখলাম পাহাড়গুলোর উচ্চতাও খুব বেশি নয়। হয়তো বা শ’দুয়েক ফুট উঁচু হবে। জ্বীনের দেশের রোমাঞ্চকর আকর্ষণে আমরা আরো সামনে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে বসলাম। গাইড মোজাফ্ফর বললেন, এই এলাকার নাম ‘আল ওয়াদিয়া’। এখানকার ‘হাদা’ পাহাড়গুলো হাদা পর্বতমালার অংশ। হাদা পর্বতমালা এখান থেকে শুরু করে তায়েফসহ অন্যান্য স্থানেও বিস্তৃত। ফলে এখানকার পুরো এলাকাকে লোকজন ‘আল-হাদা আল-ওয়াদিয়া’ বলে থাকে।
গাইড মোজাফ্ফর আবারো বললেন, রাস্তার দু’পাশের পাহাড়ের দিকে লক্ষ্য করে দেখেন পাহাড়ের রং।
আমরাও লক্ষ্য করলাম। রাস্তার দু’পাশের পাহাড়ের বিচিত্র রং। কোন পাহাড়ের রং কালচে, কোনটি লালচে, কোনটি হলদে, কোনটির রং সবুজাভ, কোনটি রং ধুসর। পাহাড়ের বিচিত্র রং দেখে আমরাও হতবাক। পাহাড় দেখতে দেখতে আমাদের গাড়ি রাস্তার শেষ প্রান্তে এসে গেল। রাস্তাটি ‘ইউ’ টার্ন নিয়ে আবার একই সড়কে পড়েছে। সামনে রাস্তা নেই। সামনে, ডানে ও বামে সেই বিচিত্র রং-এর উঁচু পাহাড়ের প্রাচীর। গাইড মোজাফ্ফর জানালেন এখানেÑ রাস্তা শেষ। আর সামনে যাওয়া যাবে না। এমনকি পায়ে হেঁটেও যাওয়া যাবেনা। সরকার রাস্তা তৈরি করতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু জ্বিন জাতি পাহাড় কেটে রাস্তা করতে দেয়নি বলে কথিত আছে। তাঁর কথা শুনে গাড়ি থেকে নামার জন্য ভরসা পেলাম না। এমনিতেই ভয়ে আমাদের অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেছে। দুরু দুরু বক্ষে আমরা সবাই দোয়া ইউনুস পাঠ করছিলাম। আবার যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে যায় এই আশংকা আমাদেরকে তাড়া করছিল। গাইড মোজাফ্ফর বলেই চলেছে, সরকার এই রাস্তাটি বন্ধ করে দিয়েছিল। বিগত দু’বছর আগে জ্বীন রাজ্যের রাস্তাটি সর্বসাধারণের জন্য খুলে দিয়েছে। এতে করে জ্বিনের রাজ্যের বিষয়টি সৌদি আরবের অনেক এলাকার লোকজনও জানে না। এমনকি খোদ মক্কা শরীফের লোকজনও।
‘ইউ’ টার্ন নিয়ে নসরুল্লাহ গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিল। গাড়ির মাইল মিটারে দেখলাম আমরা ইতোমধ্যে ৪৫ কিলোমিটার সড়ক অতিক্রম করে এসেছি। গাড়ির স্টার্টের চাবি খুলে হাতে নিল। চাবি খুলে আমাদের সবাইকে দেখাল। গাড়ি নিউট্রাল করার সাথে সাথে গাড়ি চলতে লাগলো। নসরুল্লাহ্কে আমি বললাম গাড়ির ব্রেকে পা রাখার জন্য।
নসরুল্লাহ বললো, আঙ্কেল গাড়ি ব্রেক নিচ্ছে না।
আমি আবার নসরুল্লাহ্কে গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত রাখার জন্য বললাম।
নসরুল্লাহ আমাদেরকে অভয় দিয়ে বললো, গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত আছে।
গাড়ির ব্রেকে পা রাখার পরে গাড়ি চলতে শুরু করল। গাড়ির গতি ক্রমে বাড়তে লাগলো। এক পর্যায়ে দেখলাম মাইল মিটারে গাড়ির গতি ১২০ কিলোমিটারের ঘরে। গাড়ির গতি যতই বাড়তে লাগলো ততই হৃদকম্পন বৃদ্ধি পেতে লাগলো। এ পর্যায়ে প্রচন্ড ভাবে ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল ভয়ের ঠেলায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। বিশেষ করে যখন দেখলাম যে, রাস্তার পাশে কয়েকটি গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে উল্টে পড়ে আছে। শুধু উল্টে পড়ে আছে বললে তো আর শেষ হয় না, বলা যায় দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। ফলে গাড়ির ভেতর যেসব যাত্রী ছিল তাদের কী অবস্থা ভাবতেই বুক শুকিয়ে গেল।
মনে মনে ভয় পেলেও তা চেপে নসরুল্লাহকে আবার বললাম গাড়ির ব্রেকে পা রাখার জন্য এবং স্টিয়ারিং-এ হাত রাখতে।
প্রতি উত্তরে নসরুল্লাহ একই কথা বললো।
এসময় আমি নসরুল্লাহকে গাড়ির স্টিয়ারিং শক্ত হাতে ধরে রেখে রাস্তার উপরে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা করতে বললাম।
সে সম্মতি সূচক উত্তর দিল।
এক পর্যায়ে তিন কিলোমিটার সড়ক অতিক্রম করে (যেখানে পানির বোতল গড়িয়ে রাস্তার উজানে যাচ্ছিল সেখানে) গাড়ি ব্রেক নিল।
আল্লাহ্ তা’আলাকে লাখো শুকরিয়া। গাড়ির ভেতরে আমি যেখানে ভয় পেয়েছি সেখানে অন্যরা ভয় পাবেনা তা ভাবাই যায় না। দেখা গেল মেয়েরা আরো বেশি ভয় পেয়েছে। তার নজির দেখা গেল। একটু এগুতেই নসরুল্লাহ্’র স্ত্রী আয়েশা‘র বমি ধরেছে। আয়েশা বয়সে এখনো ছোট। বয়স আনুমানিক ২০ বা ২২ হতে পারে। রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে আয়েশাকে বমি করার ব্যবস্থা করা হল। লিলি’ও যে ভয় পায়নি এমন নয়। ওখান থেকে হোটেলে পৌঁছে লিলি বললো তার খারাপ লাগছে। বুঝতে পারলাম ভয়ের কারণেই তার এ অবস্থা।
সকালে আমরা যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বের হবার সময় মসজিদে কুবা হয়ে এসেছি। মসজিদে কুবাতে আমরা নামাজ পড়েছি। এরপরেই ওহুদ ময়দান এবং পরে জ্বীনের দেশে।
জ্বীনের দেশে যাওয়ার সময় প্রচন্ড মানসিক চাপের মধ্যে ছিলাম। ছিলাম প্রচন্ড উত্তেজিত। আলহামদুলিল্লাহ, সবার মধ্যে একটি ভয় কাজ করলেও মোটামুটি ভাবে ভালয় ভালয় ফিরে আসতে পেরেছি।
ইতোমধ্যে গরমও তেতে উঠেছে। এদিকে আয়েশা বমি করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, লিলিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এতে করে আর কোথাও যাবার চিন্তা বাদ দিলাম। গাইড মোজাফ্ফরকে ৫০ রিয়াল দিয়ে বিদায় করা হল।
গাড়িতে ফিরতে ফিরতে গাইড মোজাফ্ফর বলেছিলেন, কথিত আছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবদ্দশায় জিনের দেশে গিয়ে জিনদের ইসলামের প্রতি দীক্ষা দিতেন। কোন কোন জিন এসময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে পবিত্র ইসলাম ধর্মও গ্রহণ করেছেন। তিনি তার স্বপক্ষে কোন অকাট্য দলিল দেখাতে বা রেফারেন্স দিতে পারলেন না। তবে তিনি বললেন, মহাগ্রন্থ পবিত্র কুর’আনে ‘সুরা আল-জ্বিন’ নামের একটি সুরা আছে। ‘সুরা আল-জ্বিন’-এ আল্লাহ্তাআলা জ্বিনদের ব্যাপারে অনেক কিছু বলেছেন।
‘সুরা আল-জ্বিন’ বেশ আগেই আমি পড়েছি। তবে পড়া থাকলেও তার অনুবাদ বা তার উপর কোন রকমের দখল বা গভীরতা না থাকার কারণে গাইড মোজাফ্ফরকে কিছু বললাম না। তিনি যা বলে গেলেন তার কোন প্রতি উত্তর করলাম না। তবে এটা ঠিক যে, পবিত্র কুর’আনের প্রায় শুরু থেকেই জ্বিন ও মানুষের কথা উল্লেখ রয়েছে। পবিত্র কুর’আনের সুরা আল ফাতিহা, সুরা আল বাক্বারাহ, সুরা হিজর, সুরা রহমান, সূরা ফালাক, সূরা নাসসহ বিভিন্ন সুরাতেই জ্বিনদের ব্যাপারে বর্ণনা আছে। মহাগ্রন্থ পবিত্র কুর’আনের সুরা আল ফাতিহা’র ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘বুদ্ধি ও অনুভূতির ক্ষেত্রে এ তারতম্যের জন্যই সমগ্র সৃষ্টিজগতের মধ্যে একমাত্র মানুষ ও জ্বিন জাতিকেই শরীয়তের হুকুম-আহকামের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। কারণ, সৃষ্টির এ দু’টি স্তরের মধ্যেই বুদ্ধি ও অনুভূতি পূর্ণ মাত্রায় দেয়া হয়েছে। কিন্তু, তাই বলে একথা বলা যাবে না যে, একমাত্র মানুষ ও জ্বিন জাতি ছাড়া সৃষ্টির অন্য কোন কিছুর মধ্যে বুদ্ধি ও অনুভূতির অস্থিত্ব নেই।’
পবিত্র কুর’আনের বিভিন্ন জায়গায় ‘মানুষ এবং জ্বিন জাতিকে বিবেকবান ও বুদ্ধিসম্পন্ন বলা হয়েছে’। সুরা আল বাক্বারাহ্ জ্বিন জাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে এভাবে, ‘শয়তান জান্নাত থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরে আদম (আঃ)-কে প্রতারিত করার জন্য কিভাবে আবার সেখানে প্রবেশ করল? কারণ, শয়তানের প্রবঞ্চনার জন্যে জান্নাতে প্রবেশের কোন প্রয়োজন নেই। কেননা, আল্লাহ্ পাক শয়তান ও জ্বিন জাতিকে দূর থেকে প্রবঞ্চনা ও প্রতারণা করার ক্ষমতা দিয়েছেন। একই সুরায় পরে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ্ পাক জ্বিন ও শয়তানকে বিভিন্ন আকার অবয়বে আত্মপ্রকাশের শক্তি দিয়েছেন। হতে পারে, সে এমন রূপ ধারণ করে সামনে এসেছিল যে, হযরত আদম (আঃ) বুঝতেই পারেননি যে, সে’ই শয়তান।’ একইভাবে সুরা আল বাক্বারাহ্ বলা হয়েছে, ‘কিন্তু যেহেতু পৃথিবীতে আগমনের মধ্যে আরও অনেক তাৎপর্য ও কল্যাণ নিহিত ছিল যেমন, তাঁদের বংশধরদের মধ্য থেকে ফেরেশতা ও জ্বিন জাতির মাঝে এক নতুন জাতি ‘মানব’ জাতির আবির্ভাব ঘটা, তাদের এক ধরনের কর্ম-স্বাধীনতা দিয়ে তাদের প্রতি শরীয়তী বিধান প্রয়োগের যোগ্য করে গড়ে তোলা, বিশ্বে খোদায়ী খেলাফত প্রতিষ্ঠা এবং অপরাধীর শাস্তি বিধান, শরীয়তী আইন ও নির্দেশনা প্রবর্তন।’
জ্বিন জাতি সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা সুরা আল-হিজর-এর ২৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন এভাবে,
‘ওয়ালাক্বাদ খালাক্বনাল্ ইন্সা-না মিন্ ছ¦ালছ¦া-লিম্ মিন্ হামাইম্ মাসনূন।’
যার বাংলা অর্থ
‘আর অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুকনো ঠনঠনে কাল্চে কাদামাটি থেকে।’
সুরা আল-হিজর-এর ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে এভাবে,
‘ওয়াল্জ্বান্না খালাক্বনা-হু মিন্ ক্বাবলু মিন্ না-রিস্ সামূম্।’
যার বাংলা অর্থ
‘আর ইতপূর্বে জিনকে সৃষ্টি করেছি উত্তপ্ত অগ্নিশিখা থেকে।’
পরবর্তীতে পবিত্র কুর’আনের সুরা আর-রাহমান-এ একই কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। সুরা আর-রাহমান-এর ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে এভাবে,
‘খালাক্বাল্ ইন্সা-না মিন্ স্বাল্স্বা-লিন্ কাল্ ফাখ্খা-র।’
যার বাংলা অর্থÑ
‘যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন শুষ্ক ঠনঠনে মাটি থেকে যা পোড়া মাটির ন্যায়।’
সুরা আর-রাহমান-এর ১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে এভাবে,
‘ওয়া খালাক্বাল্ জ্বান্না মিম্ মা-রিজ্বিম্ মিন্ নার্-।’
যার বাংলা অর্থ
‘আর তিনি জিনকে সৃষ্টি করেছেন ধোঁয়াবিহীন অগ্নিশিখা থেকে।’
শুধু কি তাই, আল্লাহ তাআলা মহাগ্রন্থ পবিত্র কুর’আনের সুরা আয-যারিয়াত-এর ৫৬ নম্বর আয়াতে বর্ণনা করেছেন এভাবে,
‘ওয়ামা-খালাক্বতুল্ জিন্না ওয়াল্ ইন্সা ইল্লা-লিইয়া‘বুদূন।’
যার বাংলা অর্থ
‘আমার এবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জ্বীন জাতি সৃষ্টি করেছি।‘
তবে হ্যাঁ, পবিত্র কুর’আনের বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি, মানুষের আকৃতি আছে, মানুষকে দেখা যায়। জ্বীনদের আকৃতি নেই, জ্বীনদেরকে দেখা যায় না। তবে জ্বীন জাতি মানুষকে দেখতে পায়। মানুষের মধ্যে যেমন ভাল-খারাপ প্রকৃতির মানুষ রয়েছে ঠিক তেমনি ভাবে জ্বীনদের মধ্যেও ভাল-খারাপ আছে। মানুষের মধ্যে যেমন রয়েছে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী, তেমনি ভাবে জ্বিনদের মধ্যেও রয়েছে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী। পৃথিবীতে ভুরি ভুরি নজির আছে জ্বীনের সন্তানেরা মানুষের আকৃতি ধরে শিক্ষা গ্রহণ করতে। এ ঘটনা কক্সবাজারের বিভিন্ন মাদ্রাসাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ঘটেছে বলে রটনা রয়েছে। কিন্তু বিষয়টি কখনো স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি।
‘জ্বীন জাতি সম্পর্কে’ মহাগ্রন্থ পবিত্র কুর’আনে ‘সূরা আল-জ্বীন’-এর এক নম্বর ও দুই নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে এভাবে,
‘কূল্ ঊহিয়া ইলাইয়্যা আন্নাহুস্ তামা’আ নাফারুম্ মিনাল্ জ্বিন্নি ফাক্বা-লূ-ইন্না-সামি’না-কুরআ-নান্ ‘আজ্বাবা। ইয়াহ্দী-ইলার রুশ্দি ফাআ-মান্না-বিহী; ওয়া লান্ নুশরিকা বিরাব্বিনা-আহাদা-।’
যার বাংলা অর্থ-
‘বলুনঃ আমার প্রতি ওহী নাযিল হয়েছে যে, জ্বীনদের একটি দল কুর’আন শ্রবণ করেছে, অতঃপর তারা বলেছে ঃ আমরা বিস্ময়কর কুর’আন শ্রবণ করেছি; যা সৎপথ প্রদর্শন করে। ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনও আমাদের পালনকর্তার সাথে কাউকে শরীক করব না।’
শুধু তাই নয়, জ্বীন জাতি সম্পর্কে পবিত্র কুর’আন মজিদের সূরা আহকাফ-এর ২৯, ৩০ ও ৩১ নম্বর আয়াতে বর্নিত রয়েছে এভাবে-
সূরা আহকাফ-এর ২৯-৩১ আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন,
‘ওয়া ইয্ স্বারাফ্না-ইলাইকা নাফারাম্ মিনাল জ্বিন্নি ইয়াস্তামি’ঊনাল্ কুর’আ-না, ফালাম্মা-হাদ্বারূহু ক্বা-লূ-আন্ছিতূ, ফালাম্মা-কুদ্বিয়া ওয়াল্লাও ইলা-ক্বাওমিহিম্ মুন্যিরীন। ক্বা-লূ ইয়া-ক্বাওমানা-ইন্না-সামি’না-কিতা-বান্ উন্যিলা মিম্ বা’দি মূসা-মুস্বাদ্দিক্বাল্ লিমা-বাইনা ইয়াদাইহি ইয়াহ্দী-ইলাল্ হাক্বক্বি ওয়া ইলা-ত্বারীক্বিম্ মুস্তাক্বীম। ইয়া-ক্বাওমানা-আজ্বীবূ দা-‘ইয়াল্লা-হি ওয়া আ-মিনূ বিহী ইয়ার্গ্ফিলাকুম্ মিন্ যুনূবিকুম্ ওয়া ইউর্জ্বিকুম মিন্ ‘আযা-বিন আলীম।’
যার বাংলা অর্থ
‘স্মরণ কর, আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জিনকে, যারা কুর’আন তেলাওয়াত শ্রবণ করেছিল। যখন ওরা তার নিকট হাজির হল, ওরা পরস্পর বলতে লাগল, চুপ করে শোন। যখন পবিত্র কুর’আন তেলাওয়াত শেষ হল তখন ওরা তাদের সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে গেল এক একজন সাবধানকারীরূপে। এমন এক গ্রন্থের পড়া শুনেছি, যা নাযিল হয়েছে মূসা (আঃ) এর ওপর। এটি পূর্ববর্তী কিতাবকে সমর্থন করে এবং সত্য ও সরল পথের দিকে পরিচালিত করে। হে আমাদের জাতি! আমাদের দিকে আহ্বানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তার প্রতি ঈমান আন। আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন এবং মর্মন্তুদ শাস্তি থেকে তোমাদের বাঁচাবেন।’
জ্বীনদের স্বরূপঃ জ্বীন আল্লাহ তাআলার এক প্রকার শরীরী, আত্মাধারী ও মানুষের ন্যায় জ্ঞান ও চেতনাশীল সৃষ্টজীব। তারা মানুষের দৃষ্টিগোচর নয়। এ কারণেই তাদেরকে জ্বীন বলা হয়। জ্বীন-এর শাব্দিক অর্থ গুপ্ত। মানব সৃষ্টির প্রধান উপকরণ যেমন মৃত্তিকা, তেমনি জ্বীন সৃষ্টির প্রধান উপকরণ অগ্নি। এই জাতির মধ্যেও মানুষের ন্যায় নর ও নারী আছে এবং সন্তান প্রজননের ধারা বিদ্যমান আছে। কুর’আন পাকে যাদেরকে শয়তান বলা হয়েছে, বাহ্যতঃ তারাও জ্বীনদের দুষ্ট শ্রেণীর নাম। জ্বীন ও ফেরেশতাদের অস্তিত্ব কুর’আন ও সুন্নাহর অকাট্য বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। এটা অস্বীকার করা কুফর।-(মাযহারী)
সুরা জ্বীন অবতীর্ণের ঘটনা ঃ সহীহ্ বোখারী, তিরমিযী ইত্যাদি কিতাবে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, এই ঘটনায় রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জ্বীনদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে কুর’আন শোনাননি এবং তিনি তাদেরকে দর্শনও করেননি। এই ঘটনা তখনকার, যখন শয়তানদেরকে আকাশের খবর শোনা থেকে উল্কাপিণ্ডের মাধ্যমে প্রতিহত করা হয়েছিল। এ সময়ে জ্বীনরা পরস্পরে পরামর্শ করল যে, আকাশের খবরাদি শোনার ব্যাপারে বাধাদানের এই ব্যাপারটি কোন আকস্মিক ঘটনা মনে হয় না। পৃথিবীতে অবশ্যই কোন নতুন ব্যাপার সংঘটিত হয়েছে। অতঃপর তারা স্থির করল যে, পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম ও আনাচে-কানাচে জ্বিনদের প্রতিনিধিদল প্রেরণ করতে হবে। প্রতিনিধিদল যথাযথ খোঁজাখুঁজি করে এই নতুন ব্যাপারটি কী, তা জেনে আসবে। হেজাযে প্রেরিত তাদের প্রতিনিধিদল যখন মক্কা শরীফের অদূরে ‘নাখলা’ নামক স্থানে উপস্থিত হল, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবীগণকে সাথে নিয়ে ভোরে নামায পড়ছিলেন।
জ্বীনদের এই প্রতিনিধিদল নামাযে কুর’আন পাঠ শুনে পরস্পরে শপথ করে বলতে লাগলঃ এই কালামই আমাদের ও আকাশের খবরাদির মধ্যে অন্তরায় হয়েছে। তারা সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে স্বজাতির কাছে ঘটনা বিবৃত করল এবং বললঃ ‘ইন্না-সামি’না-র্কুআ-নান্ ‘আজ্বাবা-’ (অর্থÑঅতঃপর তারা বলেছেঃ আমরা বিস্ময়কর কুর’আন শ্রবণ করেছি) আল্লাহ্ তাআলা এসব আয়াতে সমস্ত ঘটনা সম্পর্কে তাঁর রাসূলকে অবহিত করেছেন।
মক্কা বিজয়ের পরে তায়েফ জয় এবং ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সাহাবীদের নিয়ে হযরত রাসূলে করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অভিযান পরিচালনা করেন। তায়েফ বিজয়ের পরে মক্কা নগরীতে ফেরার পথে তিনি ‘নাখলা’ নামক স্থানে অবস্থান করে সাহাবীদের নিয়ে শেষরাত্রে তাহাজ্জুদের নামায শুরু করেন। সে সময় ইয়ামনের নছীবাইন শহরের জ্বীনদের একটি প্রতিনিধিদলও তখন সেখানে অবস্থানরত ছিলেন। তারা কুর’আন পাঠ শুনল এবং শুনে বিশ্বাস স্থাপন করল। অতঃপর তারা স্বজাতির কাছে ফিরে গিয়ে ঘটনা বর্ণনা করল। আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহ্ তাআলা তারই আলোচনা করেছেন।
জনৈক সাহাবী ও জ্বীনের ঘটনাঃ ইবনে জওযী (রহঃ) ‘আছ-ছফওয়া’ গ্রন্থে হযরত সহল ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি এক জায়গায় জনৈক বৃদ্ধ জ্বীনকে বায়তুল্লাহ্র দিকে মুখ করে নামাজ পড়তে দেখেন। সে পশমের জোব্বা পরিহিত ছিল। হযরত সহল (রাঃ) বলেনঃ নামায সমাপনান্তে আমি তাকে সালাম করলে তিনি জওয়াব দিলেন ও বললেন ঃ তুমি এই জোব্বার চাকচিক্য দেখে বিস্মিত হচ্ছ? জোব্বাটি সাতশ’ বছর ধরে আমার গায়ে আছে। এই জোব্বা পরিধান করেই আমি ঈসা (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাত করেছি। অতঃপর এই জোব্বা গায়েই আমি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দর্শন লাভ করেছি। যেসব জ্বীন সম্পর্কে ‘সুরা আল-জ্বীন’ অবতীর্ণ হয়েছে, আমি তাদেরই একজন। Ñ(মাযহারী)
হাদীসে বর্ণিত লায়লাতুল-জিনের ঘটনায় আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ইচ্ছাকৃতভাবে জ্বিনদের কাছে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে মক্কার অদূরে জঙ্গলে যাওয়া এবং কুর’আন শোনানো উল্লেখিত আছে। এটা বাহ্যতঃ সুরায় বর্ণিত কাহিনীর পরবর্তী ঘটনা। আল্লামা খাফফাযী বর্ণনা করেন, নির্ভরযোগ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আছে যে, জ্বিনদের প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে একবার দু’বার নয়- ছয় বার আগমন করেছিল। অতএব, সুরার বর্ণনা ও হাদীসের বর্ণনার মধ্যে কোন বৈপরিত্য নেই।
জ্বিন জাতি যে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে এসে ইসলামের প্রতি দীক্ষা নিয়েছিলেন তার বর্ণনা রয়েছে সুরা আর-রাহমানে। সূরা আর-রাহমান কোথায় নাজেল (অবতীর্ণ) হয়েছে মর্মে এক ব্যাখ্যায় তিরমিযীতে হযরত জাবের (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কয়েকজন লোকের সামনে সমগ্র সুরা আর-রাহমান তেলাওয়াত করেন। তাঁরা শুনে নিশ্চুপ থাকলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ আমি ‘লায়লাতুল জ্বিনে’ (জ্বিন-রজনীতে) জ্বিনদের সামনে এই সুরা তেলাওয়াত করেছিলাম। প্রভাবান্বিত হওয়ার দিক দিয়ে তারা তোমাদের চেয়ে উত্তম ছিল। কারণ, আমি যখনই সুরার
‘ফবে আইয়ে আলাহে রব্বাকাকুমা তোকাজ্জিবান’
যার বাংলা অর্থ-
‘অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন্ কোন্ অনুগ্রহকে (কোন্ কোন্ অনুবাদক ‘অবদান’ শব্দ ব্যবহার করেছেন) অস্বীকার করবে?
আয়াতটি তেলাওয়াত করতাম তখনই তারা সমস্বরে বলে উঠতঃ
‘রব্বানা লা নুক্কাজ্জিবু বিশাইয়িন মন নেয়ামকা ফলাকাল হামদু‘
যার বাংলা অর্থ
‘হে আমাদের পালনকর্তা। আমরা আপনার কোন অবদানই অস্বীকার করব না। আপনার জন্যেই সমস্ত প্রশংসা।’
এই হাদীস থেকে জানা যায় যে, সুরাটি মক্কায় অবতীর্ণ। কেননা, ‘জ্বিন-রজনী‘র ঘটনা মক্কায় সংঘটিত হয়েছিল। এই রজনীতে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জ্বিনদের কাছে ইসলাম প্রচার করেছিলেন এবং তাদেরকে ইসলামী শিক্ষা দান করেছিলেন।
উপরে আলোচিত সুরা আল ফাতেহা, সুরা আল বাক্বরাহ্, সুরা হিজর, সুরা আল-জ্বিন ও সুরা আর-রাহমানের উদ্বৃতি এবং বর্ণনা থেকে আমাদের কাছে জ্বিন জাতি সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হয়।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক।
islamcox56@gmail.com
তথ্যসূত্র :
১. পবিত্র কোরআনুল করীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), মূলঃ তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ ও সম্পাদনা : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, সউদী আরবের মহামান্য শাসকÑহারামাইনিশ্ শরীফাইন বাদশাহ ফাহ্দ ইবনে আবদুল আজিজের নির্দ্দেশে ও পৃষ্ঠপোষকতায় পবিত্র কোরআনের এ তরজমা ও সংক্ষিপ্ত তফসীর মুদ্রিত হলো। মুদ্রণ স্বত্ব : খাদেমুল হারামাইন শরীফাইন বাদশাহ ফাহদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প, কর্তৃক সংরক্ষিত। পো: বক্স নং-৩৫৬১ মদীনা মোনাওয়ারা।
২. আর রাহীকুল মাখতুম (রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) এর অনন্য সীরাত গ্রন্থ)-আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী, অনুবাদ-মাওলানা ওবায়েদুর রহমান ইবনে আবদুল্লাহ এম এম হাদীস ও ফিকাহ্ , ফাযেলে দারুল উলুম মইনুল ইসলাম, চট্টগ্রাম। প্রকাশক-মীনা বুক হাউস, ৪৫,বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০. তৃতীয় মুদ্রণ-মার্চ ২০১০।
৩. আসাহ্হুস সিয়ার [রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর বিশুদ্ধ ও প্রামাণ্য জীবন চরিত]- আবুল বারাকাত আবদুর রউফ দানাপুরী (র.), অনুবাদ- মাওলানা আ. ছ. ম. মাহমুদুল হাছান খান ও মালানা আবদুল্লাহ বন সাঈদ জালালাবাদী, প্রকাশক ইসলামিক ফাউন্ডেশন। দ্বিতীয় সংস্করণ-সেপ্টেম্বর ২০১০, ঢাকা।
৪. বিশ্বনবী- গোলাম মোস্তফা, প্রকাশক-আহমদ পাবলিশিং হাউস, ৬৬ প্যারীদাস রোড়, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০, ছিচল্লিশতম মুদ্রণ-এপ্রিল ২০১০, ঢাকা।
৫. পবিত্র কোরআনে বর্ণিত পঁচিশ জন নবী ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)- মাওলানা মোঃ নজরুল ইসরাম এম এম,প্রকাশক-সাগর বুক ডিপো, ১৩, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।তৃতীয় প্রকাশ-এপ্রিল ২০০৭।
1. History of Madina Munawwarah, by Shaikh Saifur Rahman Mubarakpuri, Translated by : Nasiruddin al-Khattab, Darussalam, Riyadh, Jeddah, Al-Khobar, Sharjah, Lahore, Londan, Houston, New York. Second Edition : April 2004.
জ্বীন সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। মনে হলো শয়তান টাইপের মানুষগুলোয় আসলে জ্বীনের আছর থাকে । আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন