শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০১৩

কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষার বৈচিত্র্য


আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আবার অন্যভাবে বলা যেতে পারে, আমাদের মাতৃভাষা চাটগাঁইয়া। তাহলে একথাই বলা যায় যে, আমাদের দুটি মাতৃভাষা। চাটগাঁইয়া আমাদের প্রথম মাতৃভাষা  আর বাংলা আমাদের দ্বিতীয় মাতৃভাষা। বাংলা ভাষার রয়েছে নিজস্ব বর্ণ, নিজস্ব শব্দভাণ্ডার, বাক্যগঠন পদ্ধতি এবং ঐতিহ্য। পক্ষান্তরে আমাদের প্রথম মাতৃভাষায় নেই নিজস্ব বর্ণ। তবে রয়েছে পৃথক বাক্য গঠন পদ্ধতি ও নিজস্ব অনন্য বৈশিষ্ট্য, স্বকীয়তা। আমাদের দ্বিতীয় মাতৃভাষা ‘বাংলা’ বিদেশি ভাষা থেকে বিভিন্ন শব্দ ও বাক-বিধি নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে। ঠিক তেমনিভাবে আমাদের প্রথম মাতৃভাষাও বিদেশি ভাষা থেকে শব্দ ও বাক্যবিন্যাস নিয়ে নিজের অঙ্গ-সৌষ্ঠবকে করেছে সমৃদ্ধ।    
বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত জেলা কক্সবাজার। জেলার পূর্ব পাশে রয়েছে আন্তর্জাতিক নদী নাফ এবং তার পূর্বে প্রতিবেশি বার্মা। কক্সবাজারের নাজিরারটেক থেকে শুরু করে টেকনাফ উপজেলার বদরমোকাম (সাম্প্রতিক সময়ে যা নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে) পর্যন্ত দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। জেলার উত্তর-পূর্ব পাশে রয়েছে গিরিকুন্তলা বনানীর সবুজ শ্যামলিমা সু-শোভিত গভীর জঙ্গল আর পশ্চিমে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর। প্রাকৃতিক সম্পদ, পর্যটন শিল্পসহ সম্পদের সমাহারে কক্সবাজার দেশি-বিদেশি মানুষের কাছে অত্যন্ত সুপরিচিত। সুপ্রাচীন এ ভূ-খণ্ডের রয়েছে গুরুত্ববহ ভূ-রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ইতিহাস।
প্রাচীনকালে বর্তমানের বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছিল আরাকানের (বর্তমান মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশ যা চট্টগ্রামের মানুষের কাছে রোসাঙ্গ নামে বেশি পরিচিত) আওতাধীন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। চট্টগ্রাম আর আরাকানের রাজধানী আকিয়াবের মধ্যেকার সেতু-বন্ধন ছিল বর্তমান কক্সবাজার এলাকার প্রাচীন কালের ‘প্যাঁওয়া প্রে’ বা ‘হলুদ ফুলের দেশ’। অবশ্য ‘প্যাঁওয়া প্রে’ বলতে বর্তমান রামুকেই বোঝায়। সে সূত্রে আদি-চট্টগ্রাম ও আরাকানের ইতিহাসের সঙ্গে কক্সবাজারের আদি-ইতিহাসের যোগসূত্রের সন্ধান করেন ড. আবদুল করিম, আবদুল হক চৌধুরীসহ অনেকেই। 
ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাসের ন্যায় কক্সবাজারের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। মধ্যযুগের আরাকানের অভিন্ন রাজ্য হওয়ায় আরাকান রাজসভার বাংলা সাহিত্যের প্রভাব তৎকালীন কক্সবাজারকেও আলোকিত করেছিল। শুধু তাই নয়, গবেষণায় দেখা গেছে, কক্সবাজার অঞ্চলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের আগমন ঘটেছিল। এখানে আগমন ঘটেছে তুর্কি, চীনা, আরবীয়, পাখতুন, পাঞ্জাবী, মধ্য ভারতীয়, সাঁওতাল, রাখাইন, মগ, চাকমা, চাক, ত্রিপুরা, ইংরেজ, পতুর্গীজ, ওড়িয়া, অহমিয়া, ভুটিয়াসহ অনেকের। তাঁদের সাথে এসেছে তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতি। এর ফলে কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষা, শব্দ-ভাণ্ডার, সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধ। এসব কারণে এ অঞ্চলের গ্রামে-গ্রামে পুঁথির আসর বসে, শোনা যায় নানান রোমান্টিক কাব্যকথা। কবির লড়াই, হঁওলা, হাইল্যাশাইর বা হাইল্যাগীতসহ (হাইল্যা বা মজুরদের ‘শায়েরী’ (কবিতা রচনা) থেকে ‘হাইল্যাশারী’ শব্দটি এসেছে বলে অনেকেই মনে করেন) হরেক রকমের গ্রামীণ গান বা সংস্কৃতির চর্চা হতে দেখা যায়। তদুপরি সমুদ্র ও অরণ্যশোভিত অঞ্চল হিসাবে এখানকার লোকায়ত সাহিত্য-সংস্কৃতির ঐতিহ্যও বৈচিত্র্যময়। যদিও আকাশ-সংস্কৃতি, ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিসহ আধুনিক সংস্কৃতির নামে তৃণমূলীয় মানুষের এসব প্রাণের সাংস্কৃতিক স্পন্দন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ হয়ে আসছে তবু এর ফল্গুধারা এখনও বহমান।
বৃহত্তর চট্গ্রামী উপভাষার একই ভাষাগোষ্ঠী ও একই গোত্রীয় কক্সবাজারের উপভাষা বাংলাদেশের প্রমিত বাংলাভাষা থেকে তো বটেই, এমনকি দেশের বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষা থেকে এতই পৃথক যে একে একটি আলাদা ‘ভাষা’ বলা যায়। এঅঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা বাংলা উপ-ভাষার এক অনন্য সংযোজন। এ ভাষার উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য, ধ্বনি বৈচিত্র্য ও গঠন সম্পর্কে ভাষা-তাত্ত্বিক আলোচনায় সাহিত্যবিশারদ আবদুল করিম (১৮৭১-১৯৫৩) মন্তব্য করেন যে, ‘চট্টগ্রামের-কথ্য ভাষা বড়ই অদভূত ...। লিখিত ভাষার সহিত উহার বৈষম্য খুবই বেশী। এত বেশী যে চেষ্টা করিলে আসামীদের মত আমরাও অনায়াসে পৃথক ভাষার সৃষ্টি করিতে পারিতাম’।
কক্সবাজার জেলাসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের (ইসলামাবাদের) আঞ্চলিক ভাষার গঠন বৈশিষ্ট্য এতই বিচিত্র যে, সমগ্র এলাকার প্রায় বিশ মাইল অন্তর এ ভাষার অভ্যন্তরীণ একাধিক উপ-ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। কক্সবাজার এলাকা বৃহত্তর চট্টগ্রামের অন্তর্গত হয়েও আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণরীতি ও অর্থগত তারতম্যের ফলে চট্টগ্রামের অন্য এলাকা থেকে অনেকটাই স্বতন্ত্র। আঞ্চলিক শব্দ, শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এই স্বাতন্ত্র্য ধরা পড়ে।
সাহিত্যবিশারদ আবদুল করিম, সাংবাদিক-সাহিত্যিক মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকী (১৮৯৪-১৯৫১), ভাষাবিজ্ঞানী ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক (১৯০২-১৯৮২), শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান, শিক্ষাবিদ প্রফেসর শফিউল আলম, প্রফেসর মনসুর মুসা ও ভাষাবিজ্ঞানী ড. মনিরুজ্জমানসহ অনেকেই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার এ সব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পৃথক পৃথক ভাবে আলোচনা করেছেন।
বক্ষ্যমান নিবন্ধে কক্সবাজার অঞ্চলের আঞ্চলিক শব্দের বৈচিত্র্য সম্পর্কে আলোচনা করার চেষ্টা করলাম। তবে এই আলোচনাটা কয়েকটি শব্দ এবং শব্দের ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবো। 
বিষয়টি বুঝাবার জন্য আমরা একটা শব্দ নিচ্ছি, ধরুন, ‘কৃপণ’। বাংলা সাহিত্যে বিভিন্নভাবে ‘কৃপণ’ শব্দের ব্যবহার রয়েছে। কৃপণ অর্থে আমরা বুঝি কিপটা, কণজুস, হাড়কিপটা। বাংলার শব্দভাণ্ডারে এর বেশি কিছু খুব একটা নেই। শৈলেন্দ্র বিশ্বাস এম এ, কর্তৃক সংকলিত সংসদ বাঙ্গালা অভিধান-এ ‘কৃপণ’ অর্থে লিখা হয়েছে ‘অত্যন্ত ব্যয়কুণ্ঠ ও সঞ্চয়প্রিয়; নীচ, অনুদার’। (পৃষ্ঠা-১৬৩)। একই গ্রন্থের ১৫১ পৃষ্ঠায় কিপটা বা কিপটে অর্থে লিখা হয়েছে ‘কৃপণ, ব্যয়কুণ্ঠ’। অভিধানের ৪৬৯ পৃষ্ঠায় ‘বখিল বা বখীল’ অর্থে লেখা রয়েছে ‘কৃপণ’।  
বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ব্যবহারিক বাংলা অভিধান প্রধান সম্পাদক ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক-এর ২৮২ পৃষ্ঠায় কৃপণ, কিরপিন অর্থ হচ্ছে ‘১. অত্যন্ত ব্যয়কুণ্ঠ, কিপটে, কঞ্জুস, খরচ না করে কেবল সঞ্চয় করতে চায় এমন (লোকে বলত আমি নাকি বড্ডো কিরপিন-নই)। ২. অনুদার, নীচপ্রবৃত্তি। একই অভিধানের ২০৮ পৃষ্ঠায় ‘কঞ্জুস বা কঞ্জুষ অর্থ রয়েছে কৃপণ, কিপটে। একই অভিধানের ২৬৩ পৃষ্ঠায় ‘কিপটে, কিপ্পন অর্থে লিখা হয়েছে কৃপণ, কঞ্জুষ, বখিল। একই অভিধানের ৮২১ পৃষ্ঠায় ‘বখিল অর্থ লেখা রয়েছে ১. কৃপণ, ব্যয়কুণ্ঠ (বখিল কবির চিন্তা মনে ভাবি কষ্ট-সৈআ)। ২. অভাবগ্রস্থ, শূন্য, রিক্ত (বখিল না হয় তায় অখিল ভরিয়া যায়-ঈগু)।      
পক্ষান্তরে, কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষায় কৃপণের এক ডজনের উপরে সমার্থক শব্দ রয়েছে। যেমন- ছেছি, ছোছ্, পেতনি, পেডি খাইয়া, ছেচ্ছর, ঘষা, মাক্কি, আদানা, নাটা, বখিল, কন্জুস, মুচি, (বাকধারা) হাতর সেরততু পানি ন গলে হেন’সহ ইত্যাদি।
তবে চট্টগ্রামী আঞ্চলিক ভাষার অভিধান গ্রন্থে নূর মোহাম্মদ রফিক ‘কৃপণ’ অর্থ লিখেছেন ‘আলপিত’ ও ‘নাটকিলা’। এই শব্দ দু’টি সম্পর্কে কক্সবাজার অঞ্চলের মানুষ পরিচিত নয়। 
এখানে দেখা যাচ্ছে যে, কৃপণ অর্থ বোধে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারেও রয়েছে ভিন্নতা। এমনকি বাংলা ভাষা থেকেও কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষার স্বাতন্ত্র্য লক্ষণীয়। বাংলা ভাষায় এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ‘কৃপণ’ অর্থে খুব বেশি সমার্থক শব্দ নেই বললেও চলে। কিন্তু সেক্ষেত্রে কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষায় শব্দভাণ্ডার অনেক বেশি ঋদ্ধ। সে কারণে নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে কক্সবাজার অঞ্চলের শব্দের তথা ভাষার গভীরতা অনেক বেশি। বাংলা ভাষা বা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার তুলনামূলক আলোচনার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার দিকে দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে। ইংরেজি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। এই আন্তর্জাতিক ভাষার সাথে কক্সবাজারের অঞ্চলের ভাষার আলোচনা করা নির্বুদ্ধিতা তথা মুর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। তবুও এখানে ইংরেজি ভাষার শব্দভাণ্ডার নিয়ে আলোচনা করে দেখা যেতে পারে। 
ইংরেজি ভাষায় কৃপণ অর্থ Miser. এই Miser শব্দের কি কি প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ আছে তা দেখা যেতে পারে।   
বাংলা একাডেমী প্রকাশিত Zillur Rahman Siddiqui সম্পাদিত English-Bengali Dictionary গ্রন্থে Miser শব্দের অর্থ দেয়া আছে কৃপণ, অর্থপিশাচ, বখিল, কঞ্জুস। এখানে ব্যবহৃত ‘বখিল’ শব্দটি আরবি ভাষা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। 
আমেরিকান অভিধানে Miser-এর প্রতিশব্দ রয়েছে ছয়টি। শব্দগুলো হচ্ছে যথাক্রমে-Collector, Saver, Accumulator, Squirrel, Magpie and Stasher. কিন্তু  যে শব্দগুলো প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তার একটি মাত্র শব্দ ছাড়া অবশিষ্ট ৫টি শব্দই কৃপণের সাথে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দেখা গেছে, ইংরেজি শব্দ Collector-এর বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘জেলার যে প্রধান রাজপুরুষ বা রাজ প্রতিনিধি খাজনা আদায় এবং শাসন ও বিচার করেন। খাজনা সংগ্রহকারী, খাজনা আদায়কারী।’ ইংরেজি শব্দ Saverএর অর্থ হচ্ছে, ‘রক্ষাকর্তা, মিতব্যয়ী।’ ইংরেজি শব্দ Accumulator-এর অর্থ হচ্ছে ‘জমাকারী’।  ইংরেজি শব্দ  Squirrel-এর বাংলা অর্থ হচ্ছে-‘কাঠবিড়ালী’, ইংরেজি শব্দ Magpie অর্থ হচ্ছে, ‘কিছিরমিছিরকারী দুষ্ট পাখিবিশেষ’, বাচাল এবং ইংরেজি শব্দ Stasher-এর অর্থ হচ্ছে ‘লুকানোকারী।’
Miser-noun- (disapproving) a person who loves money and hates spending it. Person who loves wealth for its own sake and spends as little as possible stingy. এতো গেল সমার্থক শব্দের বহর এবং যথার্থবোধক ব্যবহার যাতে কৃপণ লোকটিকে সাজানো অক্ষরে ও উচ্চারণ ভঙ্গিতে চিনিয়ে দেয়া যায়Ñ ‘মাক্কি’ বা ‘ছেঁচি’ শব্দে কৃপণের চেহারাই যেন ফুটে ওঠে। 
বৃহত্তর কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষায় শব্দ ব্যবহারের বিষয়টি ও লক্ষণীয়। কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষায় বাক্য ব্যবহারে যেমন রয়েছে কমনীয়তা, কোমলতা, ঠিক তেমনিভাবে এসব শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও রয়েছে গভীরতা। একই সাথে বলা যেতে পারে যে, স্থানীয় ভাষায় একই শব্দের একাধিক ক্ষেত্রে ব্যবহার এবং পৃথক অর্থ বহন করা শব্দের ব্যাপকতাকেই বুঝায়। 
যেমন উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে, ‘নঅল’ শব্দটি। যার রয়েছে একাধিক বাক্যে পৃথক অর্থ নিয়ে ব্যবহার। এই ‘নঅল’ শব্দটি স্থানীয় ভাবে ‘লাঙ্গল’ হিসেবে, ‘নোঙর’ হিসেবে, জমির পলিমাটি হিসেবে, জমি পরিমাপের পরিমাপক ‘বাঁশ’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন, ‘জমিতে নঅল বা লাঙ্গল নিয়ে যাও।’ যেমন ‘নঅল’ বা নোঙর ফেল, বন্যার ফলে জমিতে প্রচুর পরিমাণে ‘নঅল’ (পলিমাটি) পড়েছে এবং সর্বশেষ জমিতে ন’ল ফেল বা জমির পরিমাপক বাঁশ যাকে ‘ন’ল বাঁশ’ নিয়ে জমি পরিমাপ কর। এরূপ ব্যবহার আরো অনেক শব্দের ক্ষেত্রে দেখা যায়। 
প্রবন্ধের পরিসর বৃদ্ধি না করে বাক্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে কমণীয়তা বা কোমলতা ব্যবহার করা হয় তা দেখাতে চেষ্টা করলাম। এখানে মাত্র চারটি বাক্য দিয়ে দেখাতে চেষ্টা করলাম যে, বাক্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে কী পরিমাণ সচেতন ভাবে কোমল দ্যোতনা ফুটিয়ে তোলা হয়। 
যেমন- ১. পুগে বা পুকে ছুঁইয়ে। 
২. বউয়র গা ভারী হইয়ে বা বউঅত্তু সম হইয়ে বা বউয়ে খানা বাছের বা বউ হামিল হইয়ে ইত্যাদি। 
৩. মাইয়া পোয়া ফুল দেইখ্খে।
৪. বা’রে গিয়ে। (বর বা’রে, ছোড় বা’রে)।  
১. সাপে কাটলে স্থানীয়ভাবে বলা হয় ‘পুগে’ বা ‘পুকে’ ছুঁইয়ে। স্থানীয় ভাবে বিশ্বাস করা হয় সাপে কাটলে যদি ‘সাপে কেটেছে’ বলা হয় তা হলে রোগী সুস্থ হবে না। সে কারণে বলা হয় ‘পুগে’ ছুঁইয়ে। বিষাক্ত সাপকে এখানে ‘পুক’ বা ‘পোকো’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। 
২. স্ত্রী বা ঘরের পুত্র বধূ সন্তান ধারণ করলে বলা হয় ‘গা ভারী হইয়ে’। মূলতঃ সন্তান ধারণ বা সন্তান সম্ভাবা হলে বলা হচ্ছে ‘গা ভারী হইয়ে’। যদিও স্থানীয় ভাবে সন্তান ধারণ করা ‘হামিল’ হওয়া বুঝায়। কোমল ভাবে বুঝাবার জন্যই ‘গা ভারী হইয়ে’ ব্যবহার করা হয়। একই ভাবে বলা হয় ‘বউয়ততু সম হইয়ে’। এই সম হওয়ার বিষয়টি বাংলা ভাষার সাথে সম্পর্কযুক্ত। ‘সম’ শব্দটি মূলতঃ সমস্যা থেকেই এসেছে। পেটে সন্তান ধারণ করা একটি সমস্যাই বটে। সে কারণে ‘সম’ হয়েছে বলা হয়। আবার বলা হয় ‘বউয়ে খানা বাছের’। ‘বউয়ে খানা বাছের’ বলতেও সন্তান সম্ভাবা বুঝায়। (ইংরেজিতে কোমলরূপে বলা হয়-In the mother way)বাংলা গর্ভবতী বা পোয়াতির স্থলে এরূপ স্নেহসূচক, সহানুভূতিমূলক বাক্য বা শব্দ ব্যবহার চাটগাঁইয়া ভাষার এক উল্লেখযোগ্য দিক। 
৩. মাইয়া পোয়া ফুল দেইখ্খে। মেয়েদের বয়োসন্ধিক্ষণে প্রথম রক্তস্রাব হলে বলা হয় ‘মেয়ে ফুল দেখেছে’।  
৪. বা’রে গিয়ে। বা’রে যাওয়া মূলত পায়খানা বা প্রস্রাব করাকে বুঝায়। মল বা প্রস্রাবত্যাগের বেগ পেলে আমরা টয়লেট বা পায়খানা খুঁজি। কিন্তু পূর্বে মল বা প্রস্রাবের বেগ পেলে বলা হতো ‘বা’রে’ যাব। ছোট বা’রে বা ‘প্রস্রাব’ আবার ‘র্ব’ বা বড় বা’রে বুঝাতে ‘মলত্যাগের’ বিষয়টি বুঝাচ্ছে। বা’রে অর্থ বাহিরে। বাইরে কাজ কথাটির মধ্যে রুচিশীল ইঙ্গিতময়তা প্রকাশ পেয়েছে। 
বাংলা শব্দ মোরগ-মুরগি নিয়ে আলোচনায়ও দেখা যায় যে, বাংলা ও ইংরেজির শব্দভাণ্ডারের চেয়ে স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষার সমার্থক শব্দভাণ্ডার অনেক বেশি। বাংলা ভাষায় মোরগ-মুরগির অন্যকোন প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ নেই। বাচ্চা মোরগ-মুরগিকে বাচ্চা‘ই বলা হয়। এর মাঝখানে আর কোন প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ নেই। একই ভাবে ইংরেজি ভাষায় মোরগ-মুরগির প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ রয়েছে কয়েকটি। যেমন-ইংরেজি Fowl শব্দের অর্থ মোরগ-মুরগি। ইংরেজি Henঅর্থ মুরগি। ইংরেজি Cock অর্থ মোরগ। ইংরেজি শব্দ Chicken অর্থ পক্ষিশাবক, বিশেষত বাচ্চা মোরগ বা মুরগি; মুরগির ছানা। কিন্তু কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষায় মোরগ-মুরগিকে ‘কুরা’ বলা হয়। ‘কুরা’ মূলত উভয় লিঙ্গকে একসাথে বুঝাচ্ছে। আর মোরগকে ‘রাতাকুরা’ ও মুরগিকে ‘কুঁরিকুরা’ বলা হয়। অপর দিকে একই প্রজাতির প্রকার ও বয়সভেদে বিভিন্ন শব্দের অবতারণায় স্থানীয় ভাষা ও শব্দের স্বকীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন- মোরগ-মুরগির বাচ্চাকে ‘কুরার ছ’, কুরার ছ একটু বড় হলে দুরুইচ্যা কুরা, আর একটু বড় হলে তাকে বলা হয় ‘ছালইন্যা কুরা’। একই সাথে বয়স ভেদে বলা হয়, রাতা ছ, করইকুরা, দরকরইচ্যা রাতা, বাক্কা রাতা, শিয়ারী রাতা, বাকদেদে রাতা, করকরাইন্না কুঁরি, বদাপারইন্না কুঁরি।  
স্থানীয় আঞ্চলিক শব্দভাণ্ডারে এরূপ অসংখ্য শব্দ রয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে এসব শব্দ লিপিবদ্ধ করা যেতে পারে। পাশাপাশি বাংলা শব্দ, ইংরেজি শব্দ বা অন্যকোন ভাষার শব্দ জানা থাকলে তা নিয়ে একটি তুলনামূলক আলোচনা করা যেতে পারে। তখন স্থানীয় শব্দভাণ্ডারের ব্যাপকতা, বিশিষ্টতা, বৈচিত্র্য জানা এবং দেখা যাবে। এসব শব্দ নিয়ে গবেষণা করার এখনই উত্তম সময়। কথায় আছে ‘সময়ের একফুড়, অসময়ের দশফুড়’। ভবিষ্যত প্রজন্ম এব্যাপারে কোন ধারণা না পেলে গবেষণা করার বা লেখালেখি করার কোন সুযোগ পাবে না। প্রমিত বাংলা শব্দ ও ইংরেজি শব্দের ব্যবহার যে হারে গ্রামে-গঞ্জে বাড়ছে তাতে ব্যবহারের অভাবে এ সব বিচিত্র অর্থবোধক ও দ্যোতনাব্যঞ্জক আঞ্চলিক শব্দ অচিরেই হারিয়ে যাবে বলে আমাদের আশংকা। ইতোমধ্যে যে সব শব্দের ব্যবহার হচ্ছে না সে গুলোও এই সাথে সংরক্ষণ করা দরকার। বিগত পঞ্চাশ বছরে কম ব্যবহারের কারণে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পথে কয়েকটি শব্দ যেমনÑ কদ্দা, বছি, বত্তন, বদা, ল বা লব্বই, ঝুড়া, হারমাদসহ আরো অনেক শব্দ পূর্বে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো।

সহায়কগ্রন্থ:
১. সংসদ বাঙ্গালা অভিধান, সংশোধিত ও পরিবর্ধিত চতুর্থ সংস্করণ, শৈলেন্দ্র বিশ্বাস এম এ, কর্তৃক সংকলিত ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাক্তন রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপক ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত এম এ, পি আর এস, পি-এইচ ডি কর্তৃক (দ্বিতীয় সংস্করণ পর্যন্ত) সংশোধিত। ত্রয়োবিংশতিতম মুদ্রণ আগস্ট ১৯৯৯।  
২. ব্যবহারিক বাংলা অভিধানÑপ্রধান সম্পাদক ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, প্রকাশক মুহম্মদ নূরুল হুদা, পরিচালক, প্রাতিষ্ঠানিক, পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ বিভাগ (পুনর্মুদ্রণ প্রকল্প, বাংলা একাডেমী, ঢাকা। প্রকাশ-পরিমার্জিত সংস্করণঃ পৌষ ১৪০৭/ডিসেম্বর ২০০০)।    
৩. চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, নূর মোহাম্মদ রফিক সম্পাদিত, প্রথম প্রকাশ-২০০১, এ্যাডর্ন পাবলিকেশন্স, ঢাকা-চট্টগ্রাম। 
4. English-Bengali Dictionary (Editor-Zillur Rahman Siddiqui, MA (Dhaka) MA (Oxon), Professor, Department of English, Jahangirnagar University, Savar, Dhaka. First Edition, Bhadra-1400/August 1993.Manuscript & Reset Compilation Department, 32th Reprint, Falgun-1415, Feb-2009, Published by Shahida Khaton, Director, Establishment, Training & Planning Division, Bangla Academy, Dhaka. 
5. Oxford Advance Learner’s Dictionary, Joanna Turnbull, Managing Editor, Eight edition- 2010, Published-Oxford University Press.
৬. চট্টগ্রামী বাঙ্গলার রহস্যভেদ, মুহম্মদ এনামূল হক, মুহম্মদ এনামূল হক রচনাবলী (১ম খণ্ড), মনসুর মুসা সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা। 
৭. কক্সবাজারের বিলুপ্তপ্রায় লোকাচার-মুহম্মদ নূরুল ইসলাম, প্রকাশ-কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমী, একুশে বইমেলা’২০০৯, ফেব্রুয়ারি-২০০৯। 

লেখক
লোকসাহিত্য-ইতিহাস গবেষক-সাংবাদিক,  সভাপতি, কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমী।
01199 70 72 61

৫টি মন্তব্য:

  1. ধন্যবাদ ভদ্দা উনরে -- এরিম্মা আরোও বেশি বেশি লেখা চাই --- আরার আঞ্চলিক ভাষা ল্যেয়ীনে

    উত্তরমুছুন
  2. কৃপণ শব্দের সমার্থক শব্দ হিসেবে ছেছি, পেডি খাইয়া, ছেচ্ছর, ঘষা, এই চারটি শব্দ চট্টগ্রামের ভাষায় শুনিনি ঠিক কিন্তু বাকি সব গুলো শব্দই চট্টগ্রামের ভাষায় আছে। রাতা কুরা আর কুঁরি কুরার যত শব্দমালা দেখিয়েছেন সেগুলোও ঠিক সেভাবে সারা চট্টগ্রামে কথিত/ব্যবহৃত হয়। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে চট্টগ্রামের ভাষা সম্পর্কে আপনার ধারনা খুব বেশি নয়। অবশ্য নিজ অঞ্চল-প্রীতির কারনেও অবজ্ঞা করতে পারেন।

    বর্তমান বাংলার লিখিত ভাষাটি নদিয়া-শান্তিপুরের প্রচলিত ভাষা। নদিয়া-শান্তিপুর হতে যতই দূরে যাওয়া হয় ততই বাংলার লিখিত ভাষার সাথে ফারাক বাড়তে থাকে। যেমন বাংলার প্রান্তীয় অঞ্চল সিলেট আর চট্টগ্রামের ভাষার সাথে নদিয়া-শান্তিপুরের ভাষার বেশি দৃশ্যমান। নদিয়া-শান্তিপুরের লিখিত বাংলা ভাষার সাথে চট্টগ্রামের ভাষার দুরত্ব সবচাইতে দৃশ্যমান।

    চট্টগ্রামী ভাষার দুটি ভিন্নরুপ চোখে পড়ে। একটি উত্তর চট্টগ্রামের ভাষা অন্যটি রোয়াইঙ্গা (রোসাঙ্গের) ঘেষা দক্ষিণ চট্টগ্রামের ভাষা। উত্তর চট্টগ্রামের কুইজ্জা আর দইজ্জা দক্ষিণ চট্টগ্রামে কুইর্গা আর দইর্গা। এটি মুলত চট্টগ্রামের ভাষার আঞ্চলিক ভ্যারাইটি। যাহোক মন্তব্যে অত বেশি লেখা যায়না। বুঝতে চাইলে সামান্য গবেষনায়ই ব্যাপারটি চোখে পড়ে।

    তারপরেও ধন্যবাদ আপনার প্রচেষ্টার জন্য।

    উত্তরমুছুন
  3. এডের বেশীরভাগ হতা এগিন পুরো চিটাং আর মাইনষি হঁই

    উত্তরমুছুন