সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে সমকামি বিয়ের অনুমোদন দিয়েছে ফেডারেল কোর্ট। এ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ১৩টি অঙ্গরাজ্যেও সমকামি বিয়ের অনুমোদন দিয়েছে। এই অঙ্গরাজ্যগুলো হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়া, কানেকটিকাট, দেলাওরি, লওয়া, মাইনী, মেরিল্যান্ড, ম্যাসাচুয়েট্স, মাইনিসুটি, নিউ হ্যামসায়ার, নিউ ইয়র্ক, রডি আইল্যান্ড, ভারমন্ট, ওয়াশিংটন ডিসি ও কলম্বিয়া। বলা যেতে পারে সমকামিদের অযৌক্তিক ও অসমর্থিত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এদিকে বিশ্বের যে ক’টি দেশের মধ্যে সমকামিতা আইন স্বীকৃতি পেয়েছে সেই সব দেশগুলো হচ্ছে যথাক্রমে- আর্জেটিনা, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, পর্তুগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেইন, সুইডেন ও উরুগুয়ে।
এদিকে ইসরাইলসহ আরো কয়েকটি দেশে সমকামিতা বৈধতা পেলেও তা কার্যকর করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি বাংলাদেশেও দুই নারী সমকামিতার খবর সংবাদপত্রে এসেছে।
সমকামি বল্লেই ব্যাপারটি অনুমান করতে কষ্ট হয় না। স্পষ্ট করে বলা যেতে পারে যে, পুরুষের সাথে পুরুষের বিয়ে, নারীর সাথে নারীর বিয়ে। যা সরাসরি আল্লাহ্র আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া। বলা যেতে পারে আল্লাহ্র সাথে যুদ্ধ করা। আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগ বলতে যাকে বুঝায় সেসময়ও সমকামিতা ছিল না। আইয়ামে জাহেলিয়া বলতে বুঝি আরবরা কন্যা শিশুকে জীবন্ত কবর দিত। আরবের কুরাইশরা, মুশরিকরা সরাসরি আল্লাহ্র নির্দেশ অমান্যকারী, তারা ছিল জালেম, তারা আল্লাহ্র তা’আলার একত্ববাদ ছেড়ে ৩৬০টি মূর্তির পূজা নিয়ে সদা ব্যস্ত থাকত। হালাল কি তারা চিনতো না। হারামের সাথে ছিল তাদের বসবাস। আল্লাহ্র আইন, আল্লাহ্র নির্দেশ অমান্যকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়কে আল্লাহ্ তা’আলা শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও কোন সম্প্রদায় তার থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করেনি। বরঞ্চ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ অমান্য করার জন্য প্রতিযোগিতা করেছে। আল্লাহ্র প্রেরিত নবী, রাসূল, ওহী, কিতাবকে তারা করেছে উপেক্ষা। এমনকি কোনো কোনো সম্প্রদায়ের লোকজন আল্লাহ্র প্রেরিত নবী, রাসূলকে হত্যা পর্যন্ত করেছে।
আদি মানব হযরত আদম আ.-কে সৃষ্টি করার পরেই আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর বাম পাশের পাজর থেকে একটি হাড় নিয়ে মা হাওয়াকে সৃষ্টি করেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’আলা নারীকে পুরুষের জন্য, আর পুরুষকে নারীর জন্য জীবন সঙ্গি হিসেবে নির্ধারিত করে দিয়েছেন। তাঁদের প্রজনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁদের সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধি অব্যাহত রাখেন। অথচ হযরত আদম আ. ও মা হাওয়ার পরবর্তীতে লাখ লাখ বছর পরে আল্লাহ্ তা’আলার এক নেক্কার বান্দা, আল্লাহ্র প্রেরিত রাসূল হযরত লূত আ.-এর কওমেরা আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ ও হযরত লূ আ.-এর উপদেশ উপেক্ষা করে নারীকে বাদ দিয়ে পুরুষের কাছ থেকে যৌন ক্ষুধা মেটাবার ঘৃণ্য মাধ্যমকে বেছে নেয়। যে পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ হারাম, অবৈধ, জাহেলিয়াত, আল্লাহ্র দ্রোহিতা।
এব্যাপারে পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আশ শু’আরার ১৬৫ নম্বর আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘তোমরা কি গোটা দুনিয়ার মধ্যে পুরুষদের কাছে যাও’। এই আয়াতের মাধ্যমে একথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, সমগ্র সৃষ্টিকুলের মধ্য থেকে তোমরা শুধুমাত্র পুরুষদেরকে বাছাই করে নিয়েছো নিজেদের যৌনক্ষুধা চরিতার্থ করার জন্য, অথচ দুনিয়ায় বিপুল সংখ্যক নারী রয়েছে। সূরা আশ শু’আরার ১৬৬ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘এবং তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে তোমাদের রব তোমাদের জন্য যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা পরিহার করে থাকো? বরং তোমরা তো সীমা-ই অতিক্রম করে গেছো।’ এই আয়াতের মাধ্যমে বলা হয়েছে, আল্লাহ্ তা’আলা এ নারীদের মধ্যে এ ক্ষুধা পরিতৃপ্তির যে স্বাভাবিক পথ রেখেছেন তা বাদ দিয়ে তোমরা অস্বাভাবিক পথ অবলম্বন করছো। এই জালেমরা নিজেদের স্ত্রীদেরকেও প্রকৃতি বিরোধী পথে ব্যবহার করতো। তোমাদের কেবলমাত্র এ একটি অপরাধ নয়। তোমাদের জীবনের সমস্ত রীতিই সীমাতিরিক্ত ভাবে বিগড়ে গেছে। কুরআন মজিদের অন্যান্য স্থানে তাদের এ সাধারণ অবস্থা এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ঃ সূরা আনকাবূতের ২৯ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, ‘তোমরা কি এমনই বিকৃত হয়ে গেছো যে, পুরুষদের সাথে সংগম করছো, রাজপথে দস্যুতা করছো এবং নিজেদের মজলিসে প্রকাশ্যে খারাপ কাজ করছো?’
হযরত লূত আ. যখন তাঁর সম্প্রদায়ের লোকজনকে এই অপকর্ম থেকে সরে এসে স্বাভাবিক অবস্থা গ্রহণের আহবান জানালে সম্প্রদায়ের অবাধ্য লোকেরা তাঁকে প্রকাশ্যে হুমকি দিল। সূরা আশ শু’আরার ১৬৭ নম্বর আয়াতে এই হুমকির কথা বর্ণিত হয়েছে এভাবে, ‘তারা বললো, “হে লূত! যদি তুমি এসব কথা থেকে বিরত না হও, তাহলে আমাদের জনপদসমূহ থেকে যেসব লোককে উচ্ছেদ করা হয়েছে তুমিও নির্ঘাত তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।”
সূরা আশ শু’আরার ১৭২ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘তারপর অবশিষ্ট লোকদের আমি ধ্বংস করে দিলাম।’ তার ধারাবাহিকতায় সূরা আশ শু’আরার ১৭৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘এবং তাদের ওপর বর্ষণ করলাম একটি বৃষ্টিধারা, যাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল তাদের ওপর বর্ষিত এ বৃষ্টি ছিলো অত্যন্ত নিকৃষ্ট।’ এই আয়াতের মাধ্যমে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে- এটা স্বাভাবিক পানির বৃষ্টি ছিল না, ছিল পাথরের বৃষ্টি। কুরআন মজিদের অন্যান্য স্থানে এ আযাবের যে বর্ণনা রয়েছে তাতে বলা হয়েছে, হযরত লূত আ. যখন আল্লাহ্র নির্দেশে রাতের শেষ প্রহরে ওই জনপদ ছেড়ে নিজের সন্তান-পরিজনদের নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেছেন তখন ভোরের আলো ফুটতেই সহসা একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটলো। একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প তাদের জনপদকে লণ্ডভণ্ড করে দিলো। একটি ভয়ংকর আগ্নেগিরির অগ্নুৎপাতের মাধ্যমে তাদের ওপর পোড়ামাটির পাথর বর্ষণ করা হলো। এবং একটি ঝড়ো হাওয়ার মাধ্যমেও তাদের ওপর পাথর বর্ষণ করা হয়েছে।
বাইবেলের বর্ণনাসমূহ, প্রাচীন গ্রীক ও ল্যাটিন রচনাবলী, আধুনিক ভূমিস্তর গবেষণা এবং প্রতœতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ থেকে আযাবের যে বর্ণনা জানা যায় তা হচ্ছে, মরু সাগরের দক্ষিণ ও পশ্চিমে যে এলাকাটি বর্তমানে একেবারেই বিরাণ ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে সেখানে বিপুল সংখ্যক পুরাতন জনপদের ঘর-বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। এগুলো প্রমাণ করে যে, এটি এক সময় ছিলো অত্যন্ত জনবহুল এলাকা। আজ সেখানে হাজার হাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত পল্লীর চিহ্ন পাওয়া যায়। অথচ বর্তমানে এ এলাকাটি আর তেমন শস্য-শ্যামল নয়। ফলে এ পরিমাণ জনবসতি লালন করার ক্ষমতা আর এর নেই। প্রতœতত্ত্ব বিশেষজ্ঞগণের ধারণা, খৃস্টপূর্ব ২৩০০ থেকে খৃস্টপূর্ব ১৯০০ সাল পর্যন্ত এটি ছিলো বিপুল জনবসতি ও প্রাচুর্যপূর্ণ এলাকা। আর হযরত ইবরাহীম আ.-এর আমল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের অনুমান, সেটি ছিলো খৃস্টপূর্ব দু’হাজার সালের কাছাকাছি সময়। এদিক দিয়ে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের সাক্ষ্য একথা সমর্থন করে যে, এ এলাকাটি হযরত ইবরাহীম আ. ও তাঁর ভাতিজা হযরত লূত আ.-এর সময় ধ্বংস হয়েছিল।
বাইবেল, পুরাতন গ্রীক ও ল্যাটিন রচনাবলী থেকে আরো জানা যায়, এ এলাকার বিভিন্ন স্থানে নাফাত (পেট্রোল) ও স্পল্টের কুয়া ছিলো। অনেক জায়গায় ভূগর্ভ থেকে অগ্নিউদ্দীপক গ্যাসও বের হতো। এখানে সেখানে ভূগর্ভে পেট্রোল ও গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়। ভূস্তর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অনুমান করা হয়েছে, ভূমিকম্পের প্রচণ্ড ঝাকুনীর সাথে পেট্রোল, গ্যাস ও স্পল্ট ভূ-গর্ভ থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে জ্বলে ওঠে এবং সমগ্র এলাকা ভস্মীভূত হয়ে যায়। বাইবেলের বর্ণনামতে, এ ধ্বংসের খবর পেয়ে হযরত ইবরাহীম আ. হিব্রোন থেকে এ উপত্যকার অবস্থা দেখতে আসেন। তখন মাটির মধ্য থেকে কামারের ভাটির ধোঁয়ার মতো ধোঁয়া উঠছিল। (আদিপুস্তক ১৯ঃ ২৮)।
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আন নামল এর ৫৪ ও ৫৫ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘আর লূতকে আমি পাঠালাম। স্মরণ করো তখনকার কথা যখন সে তার জাতিকে বললো, “তোমরা জেনে বুঝে এ কি অশ্লিল কাজ করছো? ৫৫. তোমাদের কি এটাই রীতি যে, কাম-তৃপ্তির জন্য তোমরা নারীদেরকে বাদ দিয়ে পুরুষদের কাছে যাও? আসলে তোমরা ভয়ানক মূর্খতায় লিপ্ত হয়েছো।”
লূত জাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল আ’রাফ ৮০-৮৪ নম্বর আয়াত, সূরা হূদ ৭৪-৮৩ নম্বর আয়াত, সূরা আল হিজর ৫৭-৭৭ নম্বর আয়াত, সূরা আল আম্বিয়া ৭১-৭৫ নম্বর আয়াত, সূরা আল আনকাবূত ২৮-৩৫ নম্বর আয়াত, সূরা আস সাফ্ফাত ১৩৩-১৩৮ নম্বর আয়াত, সূরা আল কামার ৩৩-৩৯ নম্বর আয়াতসমূহ নাযিল হয়েছে।
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা হূদ-এ হযরত লূত আ.-এর উম্মতগণের কাহিনী ও নবীদের বিরুদ্ধাচরণ করার কারণে তাদের উপর বিভিন্ন প্রকার আসমানী আযাব অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। আলোচ্য আয়াতসমূহে হযরত লূত আ. ও তাঁর দেশবাসীর অবস্থা ও দেশবাসীর উপর কঠিন আযাবের বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
হযরত লূত আ.-এর কওম একে তো কাফের ছিল, অধিকন্তু তারা এমন এক জঘন্য অপকর্ম ও লজ্জাকর অনাচারে লিপ্ত ছিল, যা পূর্ববর্তী কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে পাওয়া যায় নাই, বন্য পশুরাও যা ঘৃণা করে থাকে। অর্থাৎ, পুরুষ কর্তৃক অন্য পুরুষের সাথে যৌন সংগম বা মৈথুন করা। ব্যভিচারের চেয়েও ইহা জঘন্য অপরাধ। এ জন্যই তাদের উপর কঠিন আযাব অবতীর্ণ হয়েছে, যা অন্য কোন অপকর্মকারীদের উপর কখনো অবতীর্ণ হয় না।
হযরত লূত আ.-এর ঘটনা পবিত্র কুরআন মজিদের বিভিন্ন সূরার আয়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে, তা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা হযরত জিবরাঈল আ. সহ কতিপয় ফেরেশতাকে কওমে লূতের উপর আযাব নাযিল করার জন্য প্রেরণ করেন। যাত্রাপথে তাঁরা ফিলিস্তিনে প্রথমে হযরত ইবরাহীম আ.-এর সমীপে উপস্থিত হন।
আল্লাহ্ তা’আলার যখন কোন জাতিকে আযাব দ্বারা ধ্বংস করেন, তখন তাদের কার্যকলাপের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আযাবই নাযিল করে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও ফেরেশতাগণকে সুশ্রী নওজোয়ান রূপে প্রেরণ করেন। হযরত লূত আ. ও তাঁদেরকে মানুষ মনে করে তাদের নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন হলেন। কারণ মেহমানের আতিথেয়তা করা ইসলামেতো বটেই নবীর নৈতিক দায়িত্ব। পক্ষান্তরে দেশবাসীর কু-স্বভাব বা চরিত্র তাঁর অজানা ছিল না। উভয় সংকটে পড়ে তিনি স্বগতোক্তি করলেন, “আজকের দিনটি বড় সংকটময় দিন।”
আল্লাহ্ তা’আলা এ দুনিয়াকে আজব শিক্ষাক্ষেত্র বানিয়েছেন। যার মধ্যে তাঁর অসীম কুদরত ও অফুরন্ত হেকমতের ভুরি ভুরি নির্দশন রয়েছে। মূর্তিপূজারী আযরের গৃহে আপন অন্তরঙ্গ বন্ধু ইবরাহীম খলিলুল্লাহ্ আ.কে পয়দা তিনি করেছেন। হযরত লূত আ.-এর মত একজন বিশিষ্ট পয়গম্বরের স্ত্রী নবীর বিরুদ্ধাচরণ করে কাফেরদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করত। সম্মানিত ফেরেশতাগণ সুদর্শন নওজোয়ান আকৃতিতে যখন হযরত লূত আ.-এর গৃহে উপস্থিত হলেন, তখন তাঁর স্ত্রী সমাজের দুষ্ট লোকদেরকে খবর দিল যে, আজ আমাদের গৃহে এরূপ মেহমান এসেছেন।
হযরত লূত আ.-এর আশঙ্কা যথার্থ প্রমাণিত হল। যার বর্ণনা পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা হূদ-এর ৭৮ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “আর তাঁর কওমের লোকেরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে তাঁর (গৃহ) পানে ছুটে আসতে লাগল। পূর্ব থেকেই তারা কু-কর্মে তৎপর ছিল। লূত আ. বললেন, ‘হে আমার কওম, এ আমার কন্যারা রয়েছে, এরা তোমাদের জন্য অধিক পবিত্রতমা। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, এবং অতিথিদের ব্যাপারে আমাকে লজ্জিত করো না, তোমাদের মধ্যে কি কোন ভাল-মানুষ নেই’।”
এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, জঘন্য কু-কর্মের প্রভাবে তারা এতদূর চরম নির্লজ্জ হয়েছিল যে, হযরত লূত আ.-এর মত একজন সম্মানিত পয়গম্বরের বাড়িতে প্রকাশ্য ভাবে অবরোধ করেছিল।
হযরত লূত আ. যখন দেখলেন যে, তাদেরকে প্রতিরোধ করা দুষ্কর, তখন তাদেরকে দুষ্কৃতি হতে বিরত রাখার জন্য তাদের সর্দারদের নিকট স্বীয় কন্যাদের বিবাহ দেয়ার প্রস্তাব দিলেন। তৎকালে কাফের পাত্রের সাথে মুসলিম পাত্রীর বিবাহ-বন্ধন বৈধ ছিল। হুযুরে আকরাম হযরত মুহাম্মদ সা.-এর প্রাথমিক যুগ পর্যন্ত এ হুকুম বহাল ছিল। এ জন্যই হযরত নবী করীম সা. স্বীয় দুই কন্যাকে প্রথমে উতবা ইবনে আবু লাহাব ও আবুল আস ইবনে রবী’র কাছে বিবাহ দিয়েছিলেন। অথচ তারা উভয়ে কুফরী হালতে ছিল। পরবর্তীকালে ওহীর মাধ্যমে কাফেরের সাথে মুসলমান মেয়েদের বিবাহ হারাম ঘোষণা হয়।
হযরত লূত আ.-এর কথার অর্থ হল, তোমরা নিজের কদাকার হতে বিরত হও এবং ভদ্রভাবে কওমের কন্যাদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে বৈধভাবে স্ত্রীরূপে ব্যবহার কর।
অতঃপর হযরত লূত আ. তাদেরকে আল্লাহ্র আযাবের ভীতি প্রদর্শন করে বললেন, “আল্লাহকে ভয় কর” এবং কাকুতি-মিনতি করে বললেন, “আমার মেহমানদের ব্যাপারে আমাকে অপমানিত করো না।” তিনি আরো বললেন, “তোমাদের মাঝে কি কোন ন্যায়নিষ্ঠ ভাল মানুষ নেই? আমার আকুল আবেদনে যার অন্তরে এতটুকু করুণার সৃষ্টি হবে।”
কিন্তু তাদের মধ্যে শালীনতা ও মনুষ্যত্বের লেশমাত্র ছিল না। তারা একযোগে বলে উঠল, “আপনি তো জানেনই যে, আপানর বধূ-কন্যাদের প্রতি আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। আর আমরা কি চাই, তাও আপনি অবশ্যই জানেন।”
হযরত লূত আ. এক সংকটজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন। তিনি স্বতঃস্ফুর্তভাবে বলে উঠলেন- হায়, আমি যদি তোমাদের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী হতাম, অথবা আমার আত্মীয়-স্বজন যদি এখানে থাকত, যারা এই জালেমদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করতো, তাহলে কত ভালো হতো।
ফেরেশতাগণ হযরত লূত আ.-এর অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করে প্রকৃত রহস্য ব্যক্ত করলেন এবং বললেনÑআপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনার দলই সুদৃঢ় ও শক্তিশালী। আমরা মানুষ নই, বরং আল্লাহ্র প্রেরিত ফেরেশতা। তারা আমাদেরকে কাবু করতে পারবে না বরং আযাব নাযিল করে দূরাত্মা-দূরাচারদের নিপাত সাধনের জন্যেই আমরা আগমন করেছি।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত আছে যে, দুর্বৃত্তরা যখন হযরত লূত আ.-এর গৃহদ্বারে সমবেত হল, তখন তিনি গৃহদ্বার রুদ্ধ করেছিলেন। ফেরেশতাগণ গৃহে অবস্থান করছিলেন। আড়াল হতে দুষ্টদের কথাবার্তা শুনা যাচ্ছিল। তারা দেয়াল টপকে ভিতরে প্রবেশ করে কপাট ভাঙ্গতে উদ্যোগী হল। এমন সংগীন মুহূর্তে হযরত লূত আ. পূর্বোক্ত বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন। ফেরেশতাগণ তাঁকে অভয় দান করলেন এবং গৃহদ্বার খুলে দিতে বললেন। তিনি গৃহদ্বার খুলে দিলেন। হযরত জিবরাঈল আ. ওদের প্রতি তাঁর পাখার ঝাপটা দিলেন। ফলে তারা অন্ধ হয়ে গেল এবং পালিয়ে যেতে লাগল।
তখন ফেরেশতাগণ আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশক্রমে হযরত লূত আ.-কে বললেন, আপনি কিছুটা রাত থাকতে আপনার লোকজনসহ এখান থেকে অন্যত্র সরে যান এবং সবাইকে সতর্ক করে দিন যে, তাদের কেউ যেন পেছনে ফিরে না তাকায়, তবে আপনার স্ত্রী ব্যতীত। কারণ, অন্যদের উপর যে আযাব আপতিত হবে, তাকেও সে আযাব ভোগ করতে হবে।
কোনো কোনো বর্ণনায় আছে যে, তাঁর স্ত্রীও সাথে যাচ্ছিল। কিন্তু পাপিষ্ঠদের উপর আযাব নাযিল হওয়ার ঘটনাটা শুনে পশ্চাতে ফিরে থাকাল এবং কওমের শোচনীয় পরিণতি দেখে দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল। তৎক্ষণাৎ একটি প্রস্তরের আঘাতে সেও মারা গেল। যা এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
অতঃপর উক্ত আযাবের ধরন সম্পর্কে পবিত্র কুরআন মজিদে বর্ণিত রয়েছে, যখন আযাবের হুকুম কার্যকরী করার সময় হল, তখন আমি তাদের বসতির উপরিভাগকে নীচে করে দিলাম এবং তাদের উপর অবিশ্রান্তভাবে এমন পাথর বর্ষণ করলাম, যার প্রত্যেকটি পাথর এক এক জনের নামে চিহ্নিত ছিল।
বর্ণিত আছে যে, চারটি বড় বড় শহরে তাদের বসতি ছিল। ঐসব জনপদকেই কুরআন পাকের আয়াতে ‘মুতাফেকাত’ নামে অবিহিত করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলাহার নির্দেশ পাওয়া মাত্র জিবরাঈল আ. তাঁর পাখা উক্ত শহর চতুষ্টয়ের যমীনের তলদেশে প্রবিষ্ট করতঃ এমনভাবে মাহশূন্যে উত্তোলন করলেন যে, সবকিছু নিজ নিজ স্থানে স্থির ছিল। এমনকি পানি ভর্তি পাত্র হতে এক বিন্দু পানিও পড়ল না বা নড়ল না। মহাশূন্য হতে কুকুর জানোয়ার ও মানুষের চিৎকার ভেসে আসছিল। ঐসব জনপদকে সোজাভাবে আকাশের দিকে তুলে উল্টিয়ে যথাস্থানে নিক্ষেপ করা হল। তারা আল্লাহ্র আইন ও প্রাকৃতিক বিধানকে উল্টিয়ে ছিল, তাই এটা ছিল তাদের উপযুক্ত শাস্তি।
পবিত্র কুরআন মজিদের বক্তব্য অনুযায়ী হযরত লূত আ.-এর ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদসমূহ আজও আরব থেকে সিরিয়াগামী রাস্তার পার্শ্বে জর্দানের এলাকায় সমুদ্রের উপরিভাগ থেকে যথেষ্ট নীচের দিকে একটি বিরাট মরুভূমির আকারে বিদ্যমান রয়েছে। এর একটি বিরাট পরিধিতে বিশেষ এক প্রকার পানি নদীর আকার ধারণ করে আছে। এ পানিতে কোন মাছ, ব্যাঙ, ইত্যাদি জন্তু জীবিত থাকতে পারে না। এ জন্যেই একে ‘মৃত সাগর’ ও ‘লূত সাগর’ নামে অভিহিত করা হয়। অনুসন্ধানের পর জানা গেছে যে, এতে পানির অংশ খুব কম এবং তেল জাতীয় উপাদান অধিক পরিমাণে বিদ্যমান। তাই এতে কোন সামুদ্রিক জন্তু জীবিত থাকতে পারে না।
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আস সাজদাহ-এর ২১ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, “সেই ভয়ানক শাস্তির পূর্বে আমি এ দুনিয়াতেই (কোনো না কোনো) হালকা শাস্তির স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করাতে থাকবো, হয়তো তারা (নিজেদের বিদ্রোহাত্মক আচরণ থেকে) বিরত হবে।”
এখানে ‘ভয়ানক শাস্তি’ বলতে আখেরাতের শাস্তিকে বুঝানো হয়েছে। কুফরী ও ফাসেকীর অপরাধে এ শাস্তি দেয়া হবে, এর বিপরীতে ‘হালকা শাস্তি’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ অর্থ হচ্ছে, এ দুনিয়ায় মানুষ যেসব কষ্ট পায় সেগুলো। যেমন ব্যক্তিগত জীবনে কঠিন রোগ, নিজের প্রিয়তম লোকদের মৃত্যু, ভয়াবহ দুর্ঘটনা, মারাত্মক ক্ষতি, ব্যর্থতা ইত্যাদি। সামাজিক জীবনে ঝড়-তুফান, ভূমিকম্প, বন্যা, খরা, অনাবৃষ্টি, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, দাংগা, যুদ্ধ এবং আরো বহু আপদ-বিপদ, যা লাখো লাখো কোটি কোটি মানুষকে প্রভাবিত করে।
মূলতঃ এসব বিপদ আখেরাতের বিচারের মুখোমুখি হয়ে জাহান্নামে যাওয়ার তুলনায় কোনো বিপদ নয়। বরং আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে তার বান্দার জন্য সতর্ক সংকেত। মানুষকে সত্য জানাবার এবং বিভ্রান্তি দূর করার জন্য তা পাঠানো হয়। তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে যদি মানুষ দুনিয়াতেই নিজের বিশ্বাস ও কর্ম শুধরে নেয় তাহলে আখেরাতে আল্লাহ্ গুরুত্বর শান্তির মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন দেখা দেবে না।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বিগত ২রা জুন ২০১৩ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্যে এক ভয়াবহ টর্নেডোর নামে আসমানী গজব আঘাত করেছে। এতে প্রাণহানি ছাড়াও কোটি কোটি টাকার সম্পদ হানি হয়েছে। শুধু কি তাই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোথাও না কোথাও আসমানী গজব লেগেই আছে। এদিকে চলতি সপ্তাহে যুক্তরাজ্যে ভয়াবহ তাপদাহে প্রায় সাতশত মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। গতকাল চীনের গুয়াংজু প্রদেশে ভূমিকম্পে প্রাণহানি ছাড়াও হয়েছে সম্পদ হানি। এসব আসমানী গজব ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা এসব কিছুকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে আখ্যায়িত করি। প্রশ্ন আসে প্রকৃতি কী? এই প্রকৃতিকে কে নিয়ন্ত্রণ করেন? এসব প্রশ্নের একটি মাত্র উত্তর তা হচ্ছে প্রকৃতির একমাত্র নিয়ন্ত্রক লা-শরিক আল্লাহ্। এই বিশ্বভ্রমান্ডের আলো, বাতাস, পানি, আগুন, মাটি থেকে শুরু করে যা কিছু আছে তার সবই আল্লাহ্র নির্দেশে নিয়ন্ত্রিত। আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ ছাড়া একটি বালুও নড়ে না। মানুষ যে ধর্মেরই হোক না কেনো এই সত্যকে মানতে হবে। আমরা এই সত্যকে মানছি না বলেই দুনিয়াব্যাপী নেমে আসছে আসমানী গজব, আসমানী বালা-মুছিবত। মূলত আল্লাহ্র তা’আলার নির্দেশ, আহকাম অমান্য করার শাস্তি নেমে আসছে আকাশ থেকে বা পাতাল থেকে উপরের দিকে উঠে আসছে। এসব হালকা শাস্তির মাধ্যমে মানুষ সচেতন হলে, আল্লাহ্ ভীতি জাগলে, আল্লাহ্র আ’আলার একত্ববাদের প্রতি আস্থাশীল হলেই মঙ্গল। অন্যতায় পরকালে ভয়ানক শাস্তি অবধারিত।
সমকামিতার মতো ঘৃণিত ও জঘন্য কাজের ফলে সমাজে নেমে আসছে অস্থিরতা, ভেঙ্গে পড়ছে সামাজিক শৃংঙ্খলা। এক শ্রেণীর মানুষ দিন দিন গুমরাহ্ হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে সমকামিতার ফলে এইডস ছড়ানোর বিষয়টি দ্রুততর হচ্ছে। একই সাথে সিফিলিস, গনোরিয়াসহ অন্যান্য যৌন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা শতভাগ। অপরদিকে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য বংশ বৃদ্ধি থেমে যাচ্ছে।
সমকামিতার মত ভয়াবহ অপরাধের জন্য লঘু শাস্তি ও ভয়াবহ শাস্তি অবধারিত। হযরত লূত আ.-এর কওমকে পৃথিবীর বুকে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে তা মূলত একটি লঘু শাস্তি। পরকালে তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি। পৃথিবীর অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজন যাতে হযরত লূত আ.-এর কওম ধ্বংসের ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে সে জন্য পৃথিবীর বুকে শাস্তি প্রদান করা হয়। আল্লাহ্র অবাধ্য হওয়ার শাস্তি হিসেবে পৃথিবী থেকে আদ জাতি, সামুদ জাতি, ফেরাউন, হযরত নূহ আ.-এর কওমকে ধ্বংস করেছেন। আল্লাহ্ তা’আলা অবাধ্য ও জালিম বনি-ইসরাঈলের অবাধ্য লোকজনকে শুকর ও বানর বানিয়ে দিয়েছিলেন।
সবশেষে বলতে চাই, কিয়ামত প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর রা.-এর বক্তব্য হচ্ছে, যখন দুনিয়ার বুকে সৎকাজের আদেশ দেয়া ও অসৎকাজ থেকে বিরত রাখার মতো কোনো লোক থাকবে না তখনই কিয়ামত হবে। আসুন আল্লাহ্কে ভয় করি, আল্লাহ্র ভয়াবহ শাস্তি সম্পর্কে আস্থাশীল হয়ে আল্লাহ্ তা’আলার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করি। হযরত লূত আ.-এর সম্প্রদায়ের ধ্বংস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে চেষ্টা করি। আল্লাহ্ সবাইকে হেদায়ত দান করুন।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক।
islamcox56@gmail.com
এদিকে বিশ্বের যে ক’টি দেশের মধ্যে সমকামিতা আইন স্বীকৃতি পেয়েছে সেই সব দেশগুলো হচ্ছে যথাক্রমে- আর্জেটিনা, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, পর্তুগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেইন, সুইডেন ও উরুগুয়ে।
এদিকে ইসরাইলসহ আরো কয়েকটি দেশে সমকামিতা বৈধতা পেলেও তা কার্যকর করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি বাংলাদেশেও দুই নারী সমকামিতার খবর সংবাদপত্রে এসেছে।
সমকামি বল্লেই ব্যাপারটি অনুমান করতে কষ্ট হয় না। স্পষ্ট করে বলা যেতে পারে যে, পুরুষের সাথে পুরুষের বিয়ে, নারীর সাথে নারীর বিয়ে। যা সরাসরি আল্লাহ্র আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া। বলা যেতে পারে আল্লাহ্র সাথে যুদ্ধ করা। আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগ বলতে যাকে বুঝায় সেসময়ও সমকামিতা ছিল না। আইয়ামে জাহেলিয়া বলতে বুঝি আরবরা কন্যা শিশুকে জীবন্ত কবর দিত। আরবের কুরাইশরা, মুশরিকরা সরাসরি আল্লাহ্র নির্দেশ অমান্যকারী, তারা ছিল জালেম, তারা আল্লাহ্র তা’আলার একত্ববাদ ছেড়ে ৩৬০টি মূর্তির পূজা নিয়ে সদা ব্যস্ত থাকত। হালাল কি তারা চিনতো না। হারামের সাথে ছিল তাদের বসবাস। আল্লাহ্র আইন, আল্লাহ্র নির্দেশ অমান্যকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়কে আল্লাহ্ তা’আলা শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও কোন সম্প্রদায় তার থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করেনি। বরঞ্চ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ অমান্য করার জন্য প্রতিযোগিতা করেছে। আল্লাহ্র প্রেরিত নবী, রাসূল, ওহী, কিতাবকে তারা করেছে উপেক্ষা। এমনকি কোনো কোনো সম্প্রদায়ের লোকজন আল্লাহ্র প্রেরিত নবী, রাসূলকে হত্যা পর্যন্ত করেছে।
আদি মানব হযরত আদম আ.-কে সৃষ্টি করার পরেই আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর বাম পাশের পাজর থেকে একটি হাড় নিয়ে মা হাওয়াকে সৃষ্টি করেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’আলা নারীকে পুরুষের জন্য, আর পুরুষকে নারীর জন্য জীবন সঙ্গি হিসেবে নির্ধারিত করে দিয়েছেন। তাঁদের প্রজনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁদের সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধি অব্যাহত রাখেন। অথচ হযরত আদম আ. ও মা হাওয়ার পরবর্তীতে লাখ লাখ বছর পরে আল্লাহ্ তা’আলার এক নেক্কার বান্দা, আল্লাহ্র প্রেরিত রাসূল হযরত লূত আ.-এর কওমেরা আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ ও হযরত লূ আ.-এর উপদেশ উপেক্ষা করে নারীকে বাদ দিয়ে পুরুষের কাছ থেকে যৌন ক্ষুধা মেটাবার ঘৃণ্য মাধ্যমকে বেছে নেয়। যে পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ হারাম, অবৈধ, জাহেলিয়াত, আল্লাহ্র দ্রোহিতা।
এব্যাপারে পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আশ শু’আরার ১৬৫ নম্বর আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘তোমরা কি গোটা দুনিয়ার মধ্যে পুরুষদের কাছে যাও’। এই আয়াতের মাধ্যমে একথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, সমগ্র সৃষ্টিকুলের মধ্য থেকে তোমরা শুধুমাত্র পুরুষদেরকে বাছাই করে নিয়েছো নিজেদের যৌনক্ষুধা চরিতার্থ করার জন্য, অথচ দুনিয়ায় বিপুল সংখ্যক নারী রয়েছে। সূরা আশ শু’আরার ১৬৬ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘এবং তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে তোমাদের রব তোমাদের জন্য যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা পরিহার করে থাকো? বরং তোমরা তো সীমা-ই অতিক্রম করে গেছো।’ এই আয়াতের মাধ্যমে বলা হয়েছে, আল্লাহ্ তা’আলা এ নারীদের মধ্যে এ ক্ষুধা পরিতৃপ্তির যে স্বাভাবিক পথ রেখেছেন তা বাদ দিয়ে তোমরা অস্বাভাবিক পথ অবলম্বন করছো। এই জালেমরা নিজেদের স্ত্রীদেরকেও প্রকৃতি বিরোধী পথে ব্যবহার করতো। তোমাদের কেবলমাত্র এ একটি অপরাধ নয়। তোমাদের জীবনের সমস্ত রীতিই সীমাতিরিক্ত ভাবে বিগড়ে গেছে। কুরআন মজিদের অন্যান্য স্থানে তাদের এ সাধারণ অবস্থা এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ঃ সূরা আনকাবূতের ২৯ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, ‘তোমরা কি এমনই বিকৃত হয়ে গেছো যে, পুরুষদের সাথে সংগম করছো, রাজপথে দস্যুতা করছো এবং নিজেদের মজলিসে প্রকাশ্যে খারাপ কাজ করছো?’
হযরত লূত আ. যখন তাঁর সম্প্রদায়ের লোকজনকে এই অপকর্ম থেকে সরে এসে স্বাভাবিক অবস্থা গ্রহণের আহবান জানালে সম্প্রদায়ের অবাধ্য লোকেরা তাঁকে প্রকাশ্যে হুমকি দিল। সূরা আশ শু’আরার ১৬৭ নম্বর আয়াতে এই হুমকির কথা বর্ণিত হয়েছে এভাবে, ‘তারা বললো, “হে লূত! যদি তুমি এসব কথা থেকে বিরত না হও, তাহলে আমাদের জনপদসমূহ থেকে যেসব লোককে উচ্ছেদ করা হয়েছে তুমিও নির্ঘাত তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।”
সূরা আশ শু’আরার ১৭২ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘তারপর অবশিষ্ট লোকদের আমি ধ্বংস করে দিলাম।’ তার ধারাবাহিকতায় সূরা আশ শু’আরার ১৭৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘এবং তাদের ওপর বর্ষণ করলাম একটি বৃষ্টিধারা, যাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল তাদের ওপর বর্ষিত এ বৃষ্টি ছিলো অত্যন্ত নিকৃষ্ট।’ এই আয়াতের মাধ্যমে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে- এটা স্বাভাবিক পানির বৃষ্টি ছিল না, ছিল পাথরের বৃষ্টি। কুরআন মজিদের অন্যান্য স্থানে এ আযাবের যে বর্ণনা রয়েছে তাতে বলা হয়েছে, হযরত লূত আ. যখন আল্লাহ্র নির্দেশে রাতের শেষ প্রহরে ওই জনপদ ছেড়ে নিজের সন্তান-পরিজনদের নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেছেন তখন ভোরের আলো ফুটতেই সহসা একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটলো। একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প তাদের জনপদকে লণ্ডভণ্ড করে দিলো। একটি ভয়ংকর আগ্নেগিরির অগ্নুৎপাতের মাধ্যমে তাদের ওপর পোড়ামাটির পাথর বর্ষণ করা হলো। এবং একটি ঝড়ো হাওয়ার মাধ্যমেও তাদের ওপর পাথর বর্ষণ করা হয়েছে।
বাইবেলের বর্ণনাসমূহ, প্রাচীন গ্রীক ও ল্যাটিন রচনাবলী, আধুনিক ভূমিস্তর গবেষণা এবং প্রতœতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ থেকে আযাবের যে বর্ণনা জানা যায় তা হচ্ছে, মরু সাগরের দক্ষিণ ও পশ্চিমে যে এলাকাটি বর্তমানে একেবারেই বিরাণ ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে সেখানে বিপুল সংখ্যক পুরাতন জনপদের ঘর-বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। এগুলো প্রমাণ করে যে, এটি এক সময় ছিলো অত্যন্ত জনবহুল এলাকা। আজ সেখানে হাজার হাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত পল্লীর চিহ্ন পাওয়া যায়। অথচ বর্তমানে এ এলাকাটি আর তেমন শস্য-শ্যামল নয়। ফলে এ পরিমাণ জনবসতি লালন করার ক্ষমতা আর এর নেই। প্রতœতত্ত্ব বিশেষজ্ঞগণের ধারণা, খৃস্টপূর্ব ২৩০০ থেকে খৃস্টপূর্ব ১৯০০ সাল পর্যন্ত এটি ছিলো বিপুল জনবসতি ও প্রাচুর্যপূর্ণ এলাকা। আর হযরত ইবরাহীম আ.-এর আমল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের অনুমান, সেটি ছিলো খৃস্টপূর্ব দু’হাজার সালের কাছাকাছি সময়। এদিক দিয়ে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের সাক্ষ্য একথা সমর্থন করে যে, এ এলাকাটি হযরত ইবরাহীম আ. ও তাঁর ভাতিজা হযরত লূত আ.-এর সময় ধ্বংস হয়েছিল।
বাইবেল, পুরাতন গ্রীক ও ল্যাটিন রচনাবলী থেকে আরো জানা যায়, এ এলাকার বিভিন্ন স্থানে নাফাত (পেট্রোল) ও স্পল্টের কুয়া ছিলো। অনেক জায়গায় ভূগর্ভ থেকে অগ্নিউদ্দীপক গ্যাসও বের হতো। এখানে সেখানে ভূগর্ভে পেট্রোল ও গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়। ভূস্তর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অনুমান করা হয়েছে, ভূমিকম্পের প্রচণ্ড ঝাকুনীর সাথে পেট্রোল, গ্যাস ও স্পল্ট ভূ-গর্ভ থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে জ্বলে ওঠে এবং সমগ্র এলাকা ভস্মীভূত হয়ে যায়। বাইবেলের বর্ণনামতে, এ ধ্বংসের খবর পেয়ে হযরত ইবরাহীম আ. হিব্রোন থেকে এ উপত্যকার অবস্থা দেখতে আসেন। তখন মাটির মধ্য থেকে কামারের ভাটির ধোঁয়ার মতো ধোঁয়া উঠছিল। (আদিপুস্তক ১৯ঃ ২৮)।
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আন নামল এর ৫৪ ও ৫৫ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘আর লূতকে আমি পাঠালাম। স্মরণ করো তখনকার কথা যখন সে তার জাতিকে বললো, “তোমরা জেনে বুঝে এ কি অশ্লিল কাজ করছো? ৫৫. তোমাদের কি এটাই রীতি যে, কাম-তৃপ্তির জন্য তোমরা নারীদেরকে বাদ দিয়ে পুরুষদের কাছে যাও? আসলে তোমরা ভয়ানক মূর্খতায় লিপ্ত হয়েছো।”
লূত জাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল আ’রাফ ৮০-৮৪ নম্বর আয়াত, সূরা হূদ ৭৪-৮৩ নম্বর আয়াত, সূরা আল হিজর ৫৭-৭৭ নম্বর আয়াত, সূরা আল আম্বিয়া ৭১-৭৫ নম্বর আয়াত, সূরা আল আনকাবূত ২৮-৩৫ নম্বর আয়াত, সূরা আস সাফ্ফাত ১৩৩-১৩৮ নম্বর আয়াত, সূরা আল কামার ৩৩-৩৯ নম্বর আয়াতসমূহ নাযিল হয়েছে।
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা হূদ-এ হযরত লূত আ.-এর উম্মতগণের কাহিনী ও নবীদের বিরুদ্ধাচরণ করার কারণে তাদের উপর বিভিন্ন প্রকার আসমানী আযাব অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। আলোচ্য আয়াতসমূহে হযরত লূত আ. ও তাঁর দেশবাসীর অবস্থা ও দেশবাসীর উপর কঠিন আযাবের বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
হযরত লূত আ.-এর কওম একে তো কাফের ছিল, অধিকন্তু তারা এমন এক জঘন্য অপকর্ম ও লজ্জাকর অনাচারে লিপ্ত ছিল, যা পূর্ববর্তী কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে পাওয়া যায় নাই, বন্য পশুরাও যা ঘৃণা করে থাকে। অর্থাৎ, পুরুষ কর্তৃক অন্য পুরুষের সাথে যৌন সংগম বা মৈথুন করা। ব্যভিচারের চেয়েও ইহা জঘন্য অপরাধ। এ জন্যই তাদের উপর কঠিন আযাব অবতীর্ণ হয়েছে, যা অন্য কোন অপকর্মকারীদের উপর কখনো অবতীর্ণ হয় না।
হযরত লূত আ.-এর ঘটনা পবিত্র কুরআন মজিদের বিভিন্ন সূরার আয়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে, তা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা হযরত জিবরাঈল আ. সহ কতিপয় ফেরেশতাকে কওমে লূতের উপর আযাব নাযিল করার জন্য প্রেরণ করেন। যাত্রাপথে তাঁরা ফিলিস্তিনে প্রথমে হযরত ইবরাহীম আ.-এর সমীপে উপস্থিত হন।
আল্লাহ্ তা’আলার যখন কোন জাতিকে আযাব দ্বারা ধ্বংস করেন, তখন তাদের কার্যকলাপের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আযাবই নাযিল করে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও ফেরেশতাগণকে সুশ্রী নওজোয়ান রূপে প্রেরণ করেন। হযরত লূত আ. ও তাঁদেরকে মানুষ মনে করে তাদের নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন হলেন। কারণ মেহমানের আতিথেয়তা করা ইসলামেতো বটেই নবীর নৈতিক দায়িত্ব। পক্ষান্তরে দেশবাসীর কু-স্বভাব বা চরিত্র তাঁর অজানা ছিল না। উভয় সংকটে পড়ে তিনি স্বগতোক্তি করলেন, “আজকের দিনটি বড় সংকটময় দিন।”
আল্লাহ্ তা’আলা এ দুনিয়াকে আজব শিক্ষাক্ষেত্র বানিয়েছেন। যার মধ্যে তাঁর অসীম কুদরত ও অফুরন্ত হেকমতের ভুরি ভুরি নির্দশন রয়েছে। মূর্তিপূজারী আযরের গৃহে আপন অন্তরঙ্গ বন্ধু ইবরাহীম খলিলুল্লাহ্ আ.কে পয়দা তিনি করেছেন। হযরত লূত আ.-এর মত একজন বিশিষ্ট পয়গম্বরের স্ত্রী নবীর বিরুদ্ধাচরণ করে কাফেরদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করত। সম্মানিত ফেরেশতাগণ সুদর্শন নওজোয়ান আকৃতিতে যখন হযরত লূত আ.-এর গৃহে উপস্থিত হলেন, তখন তাঁর স্ত্রী সমাজের দুষ্ট লোকদেরকে খবর দিল যে, আজ আমাদের গৃহে এরূপ মেহমান এসেছেন।
হযরত লূত আ.-এর আশঙ্কা যথার্থ প্রমাণিত হল। যার বর্ণনা পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা হূদ-এর ৭৮ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “আর তাঁর কওমের লোকেরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে তাঁর (গৃহ) পানে ছুটে আসতে লাগল। পূর্ব থেকেই তারা কু-কর্মে তৎপর ছিল। লূত আ. বললেন, ‘হে আমার কওম, এ আমার কন্যারা রয়েছে, এরা তোমাদের জন্য অধিক পবিত্রতমা। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, এবং অতিথিদের ব্যাপারে আমাকে লজ্জিত করো না, তোমাদের মধ্যে কি কোন ভাল-মানুষ নেই’।”
এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, জঘন্য কু-কর্মের প্রভাবে তারা এতদূর চরম নির্লজ্জ হয়েছিল যে, হযরত লূত আ.-এর মত একজন সম্মানিত পয়গম্বরের বাড়িতে প্রকাশ্য ভাবে অবরোধ করেছিল।
হযরত লূত আ. যখন দেখলেন যে, তাদেরকে প্রতিরোধ করা দুষ্কর, তখন তাদেরকে দুষ্কৃতি হতে বিরত রাখার জন্য তাদের সর্দারদের নিকট স্বীয় কন্যাদের বিবাহ দেয়ার প্রস্তাব দিলেন। তৎকালে কাফের পাত্রের সাথে মুসলিম পাত্রীর বিবাহ-বন্ধন বৈধ ছিল। হুযুরে আকরাম হযরত মুহাম্মদ সা.-এর প্রাথমিক যুগ পর্যন্ত এ হুকুম বহাল ছিল। এ জন্যই হযরত নবী করীম সা. স্বীয় দুই কন্যাকে প্রথমে উতবা ইবনে আবু লাহাব ও আবুল আস ইবনে রবী’র কাছে বিবাহ দিয়েছিলেন। অথচ তারা উভয়ে কুফরী হালতে ছিল। পরবর্তীকালে ওহীর মাধ্যমে কাফেরের সাথে মুসলমান মেয়েদের বিবাহ হারাম ঘোষণা হয়।
হযরত লূত আ.-এর কথার অর্থ হল, তোমরা নিজের কদাকার হতে বিরত হও এবং ভদ্রভাবে কওমের কন্যাদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে বৈধভাবে স্ত্রীরূপে ব্যবহার কর।
অতঃপর হযরত লূত আ. তাদেরকে আল্লাহ্র আযাবের ভীতি প্রদর্শন করে বললেন, “আল্লাহকে ভয় কর” এবং কাকুতি-মিনতি করে বললেন, “আমার মেহমানদের ব্যাপারে আমাকে অপমানিত করো না।” তিনি আরো বললেন, “তোমাদের মাঝে কি কোন ন্যায়নিষ্ঠ ভাল মানুষ নেই? আমার আকুল আবেদনে যার অন্তরে এতটুকু করুণার সৃষ্টি হবে।”
কিন্তু তাদের মধ্যে শালীনতা ও মনুষ্যত্বের লেশমাত্র ছিল না। তারা একযোগে বলে উঠল, “আপনি তো জানেনই যে, আপানর বধূ-কন্যাদের প্রতি আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। আর আমরা কি চাই, তাও আপনি অবশ্যই জানেন।”
হযরত লূত আ. এক সংকটজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন। তিনি স্বতঃস্ফুর্তভাবে বলে উঠলেন- হায়, আমি যদি তোমাদের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী হতাম, অথবা আমার আত্মীয়-স্বজন যদি এখানে থাকত, যারা এই জালেমদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করতো, তাহলে কত ভালো হতো।
ফেরেশতাগণ হযরত লূত আ.-এর অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করে প্রকৃত রহস্য ব্যক্ত করলেন এবং বললেনÑআপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনার দলই সুদৃঢ় ও শক্তিশালী। আমরা মানুষ নই, বরং আল্লাহ্র প্রেরিত ফেরেশতা। তারা আমাদেরকে কাবু করতে পারবে না বরং আযাব নাযিল করে দূরাত্মা-দূরাচারদের নিপাত সাধনের জন্যেই আমরা আগমন করেছি।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত আছে যে, দুর্বৃত্তরা যখন হযরত লূত আ.-এর গৃহদ্বারে সমবেত হল, তখন তিনি গৃহদ্বার রুদ্ধ করেছিলেন। ফেরেশতাগণ গৃহে অবস্থান করছিলেন। আড়াল হতে দুষ্টদের কথাবার্তা শুনা যাচ্ছিল। তারা দেয়াল টপকে ভিতরে প্রবেশ করে কপাট ভাঙ্গতে উদ্যোগী হল। এমন সংগীন মুহূর্তে হযরত লূত আ. পূর্বোক্ত বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন। ফেরেশতাগণ তাঁকে অভয় দান করলেন এবং গৃহদ্বার খুলে দিতে বললেন। তিনি গৃহদ্বার খুলে দিলেন। হযরত জিবরাঈল আ. ওদের প্রতি তাঁর পাখার ঝাপটা দিলেন। ফলে তারা অন্ধ হয়ে গেল এবং পালিয়ে যেতে লাগল।
তখন ফেরেশতাগণ আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশক্রমে হযরত লূত আ.-কে বললেন, আপনি কিছুটা রাত থাকতে আপনার লোকজনসহ এখান থেকে অন্যত্র সরে যান এবং সবাইকে সতর্ক করে দিন যে, তাদের কেউ যেন পেছনে ফিরে না তাকায়, তবে আপনার স্ত্রী ব্যতীত। কারণ, অন্যদের উপর যে আযাব আপতিত হবে, তাকেও সে আযাব ভোগ করতে হবে।
কোনো কোনো বর্ণনায় আছে যে, তাঁর স্ত্রীও সাথে যাচ্ছিল। কিন্তু পাপিষ্ঠদের উপর আযাব নাযিল হওয়ার ঘটনাটা শুনে পশ্চাতে ফিরে থাকাল এবং কওমের শোচনীয় পরিণতি দেখে দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল। তৎক্ষণাৎ একটি প্রস্তরের আঘাতে সেও মারা গেল। যা এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
অতঃপর উক্ত আযাবের ধরন সম্পর্কে পবিত্র কুরআন মজিদে বর্ণিত রয়েছে, যখন আযাবের হুকুম কার্যকরী করার সময় হল, তখন আমি তাদের বসতির উপরিভাগকে নীচে করে দিলাম এবং তাদের উপর অবিশ্রান্তভাবে এমন পাথর বর্ষণ করলাম, যার প্রত্যেকটি পাথর এক এক জনের নামে চিহ্নিত ছিল।
বর্ণিত আছে যে, চারটি বড় বড় শহরে তাদের বসতি ছিল। ঐসব জনপদকেই কুরআন পাকের আয়াতে ‘মুতাফেকাত’ নামে অবিহিত করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলাহার নির্দেশ পাওয়া মাত্র জিবরাঈল আ. তাঁর পাখা উক্ত শহর চতুষ্টয়ের যমীনের তলদেশে প্রবিষ্ট করতঃ এমনভাবে মাহশূন্যে উত্তোলন করলেন যে, সবকিছু নিজ নিজ স্থানে স্থির ছিল। এমনকি পানি ভর্তি পাত্র হতে এক বিন্দু পানিও পড়ল না বা নড়ল না। মহাশূন্য হতে কুকুর জানোয়ার ও মানুষের চিৎকার ভেসে আসছিল। ঐসব জনপদকে সোজাভাবে আকাশের দিকে তুলে উল্টিয়ে যথাস্থানে নিক্ষেপ করা হল। তারা আল্লাহ্র আইন ও প্রাকৃতিক বিধানকে উল্টিয়ে ছিল, তাই এটা ছিল তাদের উপযুক্ত শাস্তি।
পবিত্র কুরআন মজিদের বক্তব্য অনুযায়ী হযরত লূত আ.-এর ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদসমূহ আজও আরব থেকে সিরিয়াগামী রাস্তার পার্শ্বে জর্দানের এলাকায় সমুদ্রের উপরিভাগ থেকে যথেষ্ট নীচের দিকে একটি বিরাট মরুভূমির আকারে বিদ্যমান রয়েছে। এর একটি বিরাট পরিধিতে বিশেষ এক প্রকার পানি নদীর আকার ধারণ করে আছে। এ পানিতে কোন মাছ, ব্যাঙ, ইত্যাদি জন্তু জীবিত থাকতে পারে না। এ জন্যেই একে ‘মৃত সাগর’ ও ‘লূত সাগর’ নামে অভিহিত করা হয়। অনুসন্ধানের পর জানা গেছে যে, এতে পানির অংশ খুব কম এবং তেল জাতীয় উপাদান অধিক পরিমাণে বিদ্যমান। তাই এতে কোন সামুদ্রিক জন্তু জীবিত থাকতে পারে না।
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আস সাজদাহ-এর ২১ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, “সেই ভয়ানক শাস্তির পূর্বে আমি এ দুনিয়াতেই (কোনো না কোনো) হালকা শাস্তির স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করাতে থাকবো, হয়তো তারা (নিজেদের বিদ্রোহাত্মক আচরণ থেকে) বিরত হবে।”
এখানে ‘ভয়ানক শাস্তি’ বলতে আখেরাতের শাস্তিকে বুঝানো হয়েছে। কুফরী ও ফাসেকীর অপরাধে এ শাস্তি দেয়া হবে, এর বিপরীতে ‘হালকা শাস্তি’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ অর্থ হচ্ছে, এ দুনিয়ায় মানুষ যেসব কষ্ট পায় সেগুলো। যেমন ব্যক্তিগত জীবনে কঠিন রোগ, নিজের প্রিয়তম লোকদের মৃত্যু, ভয়াবহ দুর্ঘটনা, মারাত্মক ক্ষতি, ব্যর্থতা ইত্যাদি। সামাজিক জীবনে ঝড়-তুফান, ভূমিকম্প, বন্যা, খরা, অনাবৃষ্টি, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, দাংগা, যুদ্ধ এবং আরো বহু আপদ-বিপদ, যা লাখো লাখো কোটি কোটি মানুষকে প্রভাবিত করে।
মূলতঃ এসব বিপদ আখেরাতের বিচারের মুখোমুখি হয়ে জাহান্নামে যাওয়ার তুলনায় কোনো বিপদ নয়। বরং আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে তার বান্দার জন্য সতর্ক সংকেত। মানুষকে সত্য জানাবার এবং বিভ্রান্তি দূর করার জন্য তা পাঠানো হয়। তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে যদি মানুষ দুনিয়াতেই নিজের বিশ্বাস ও কর্ম শুধরে নেয় তাহলে আখেরাতে আল্লাহ্ গুরুত্বর শান্তির মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন দেখা দেবে না।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বিগত ২রা জুন ২০১৩ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্যে এক ভয়াবহ টর্নেডোর নামে আসমানী গজব আঘাত করেছে। এতে প্রাণহানি ছাড়াও কোটি কোটি টাকার সম্পদ হানি হয়েছে। শুধু কি তাই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোথাও না কোথাও আসমানী গজব লেগেই আছে। এদিকে চলতি সপ্তাহে যুক্তরাজ্যে ভয়াবহ তাপদাহে প্রায় সাতশত মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। গতকাল চীনের গুয়াংজু প্রদেশে ভূমিকম্পে প্রাণহানি ছাড়াও হয়েছে সম্পদ হানি। এসব আসমানী গজব ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা এসব কিছুকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে আখ্যায়িত করি। প্রশ্ন আসে প্রকৃতি কী? এই প্রকৃতিকে কে নিয়ন্ত্রণ করেন? এসব প্রশ্নের একটি মাত্র উত্তর তা হচ্ছে প্রকৃতির একমাত্র নিয়ন্ত্রক লা-শরিক আল্লাহ্। এই বিশ্বভ্রমান্ডের আলো, বাতাস, পানি, আগুন, মাটি থেকে শুরু করে যা কিছু আছে তার সবই আল্লাহ্র নির্দেশে নিয়ন্ত্রিত। আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ ছাড়া একটি বালুও নড়ে না। মানুষ যে ধর্মেরই হোক না কেনো এই সত্যকে মানতে হবে। আমরা এই সত্যকে মানছি না বলেই দুনিয়াব্যাপী নেমে আসছে আসমানী গজব, আসমানী বালা-মুছিবত। মূলত আল্লাহ্র তা’আলার নির্দেশ, আহকাম অমান্য করার শাস্তি নেমে আসছে আকাশ থেকে বা পাতাল থেকে উপরের দিকে উঠে আসছে। এসব হালকা শাস্তির মাধ্যমে মানুষ সচেতন হলে, আল্লাহ্ ভীতি জাগলে, আল্লাহ্র আ’আলার একত্ববাদের প্রতি আস্থাশীল হলেই মঙ্গল। অন্যতায় পরকালে ভয়ানক শাস্তি অবধারিত।
সমকামিতার মতো ঘৃণিত ও জঘন্য কাজের ফলে সমাজে নেমে আসছে অস্থিরতা, ভেঙ্গে পড়ছে সামাজিক শৃংঙ্খলা। এক শ্রেণীর মানুষ দিন দিন গুমরাহ্ হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে সমকামিতার ফলে এইডস ছড়ানোর বিষয়টি দ্রুততর হচ্ছে। একই সাথে সিফিলিস, গনোরিয়াসহ অন্যান্য যৌন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা শতভাগ। অপরদিকে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য বংশ বৃদ্ধি থেমে যাচ্ছে।
সমকামিতার মত ভয়াবহ অপরাধের জন্য লঘু শাস্তি ও ভয়াবহ শাস্তি অবধারিত। হযরত লূত আ.-এর কওমকে পৃথিবীর বুকে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে তা মূলত একটি লঘু শাস্তি। পরকালে তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি। পৃথিবীর অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজন যাতে হযরত লূত আ.-এর কওম ধ্বংসের ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে সে জন্য পৃথিবীর বুকে শাস্তি প্রদান করা হয়। আল্লাহ্র অবাধ্য হওয়ার শাস্তি হিসেবে পৃথিবী থেকে আদ জাতি, সামুদ জাতি, ফেরাউন, হযরত নূহ আ.-এর কওমকে ধ্বংস করেছেন। আল্লাহ্ তা’আলা অবাধ্য ও জালিম বনি-ইসরাঈলের অবাধ্য লোকজনকে শুকর ও বানর বানিয়ে দিয়েছিলেন।
সবশেষে বলতে চাই, কিয়ামত প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর রা.-এর বক্তব্য হচ্ছে, যখন দুনিয়ার বুকে সৎকাজের আদেশ দেয়া ও অসৎকাজ থেকে বিরত রাখার মতো কোনো লোক থাকবে না তখনই কিয়ামত হবে। আসুন আল্লাহ্কে ভয় করি, আল্লাহ্র ভয়াবহ শাস্তি সম্পর্কে আস্থাশীল হয়ে আল্লাহ্ তা’আলার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করি। হযরত লূত আ.-এর সম্প্রদায়ের ধ্বংস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে চেষ্টা করি। আল্লাহ্ সবাইকে হেদায়ত দান করুন।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক।
islamcox56@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন