শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০১৩

তিনিই উত্তম যিনি সমালোচক


টেলিভেশনের আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী আলোচকদের ক্রমাগত হুমকি প্রদানের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশিষ্ট আলোচকসহ দেশের বেশকিছু বিশিষ্ট নাগরিক। এক বিবৃতিতে তারা হুমকি ও সশস্ত্র হামলার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘কিছুদিন ধরে বিভিন্ন টেলিভিশন টকশো’র নিয়মিত আলোচক ও অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের ক্রমাগত আক্রমণাত্মক বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা সংঘটিত হয়ে চলেছে। সর্বশেষ গত ১০ জুন রাজধানীর কাওরান বাজার এলাকায় ড. তুহিন মালিকের গাড়িতে সশস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। এ সময় তিনি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারিত টকশোতে অংশগ্রহণরত ছিলেন।  হামলাকারীরা তাঁকে খোঁজখুজি করে না পেয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ ও হত্যার হুমকি প্রদান করে এবং ভবিষ্যতে আর টকশোতে অংশ না নেয়ার জন্য শাসিয়ে দেয়। তাদের হামলায় ড. তুহিন মালিকের গাড়ির চালক গুরুত্বর আহত হয় এবং গাড়িটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
এর আগে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ও ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. পিয়াস করিমকে টেলিফোনে প্রাণ নাশের হুমকি প্রদান এবং টেলিভিশন টকশোতে আর অংশ না নেয়ার জন্য শাসায়। এ ছাড়া ইতিপূর্বে দৈনিক নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবিরকেও নানাভাবে হুমকি দেয়া হয়।
বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘আমরা পরিষ্কারভাবে মনে করি যে, এসব সন্ত্রাসী তৎপরতা মত প্রকাশের অধিকার ও বাক-ব্যক্তির স্বাধীনতার প্রতি চরম আঘাত এবং নাগরিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ওপর মারাত্মক হুমকি। আমরা এই সব ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই এবং এ ধরণের সন্ত্রাসী তৎপরতার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদেরকে শনাক্ত করে তাদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানাই। সেই সঙ্গে আমরা দৃঢ়চিত্তে জানাতে চাই যে, কোন ধরণের ধমক বা হুমকি টেলিভিশন টকশো’র মাধ্যমে জনসাধারণের ইচ্ছার প্রতিধ্বনি ঘটানো থেকে আমাদের বিচ্যুত করতে পারবে না।’
বিবৃতি প্রদান করেছেন প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মুসা, প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক, তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান, সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন আহমদ, মতিউর রহমান চৌধুরী, রাজনীতিবিদ মাহমুদুর রহমান মান্না, বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন, সাংবাদিক আফসান চৌধুরী, সাংবাদিক নূরুল কবির, শিক্ষাবিদ ড. পিয়াস করিম, ড. আসিফ নজরুল, রাজনীতিক গোলাম মওলা রনি এমপি, ব্যাংকার মামুন রশীদ, শিক্ষাবিদ ড. আমেনা মহসিন, ড. মামুন আহমদ, ফেরদৌস হোসেন, সাংবাদিক নঈম নিজাম, আবু সাঈদ খান, পীর হাবিবুর রহমান, সালেহউদ্দিন, মনির হায়দার, অঞ্জন রায়, গোলাম মোর্তজা, খালেদ মুহিউদ্দিন ও রোবায়েত ফেরদৌস।
আরো একটু পেছনে গেলে দেখতে পাই, দেশে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিয়ে যখন সংশ্লিষ্ট বিভাগের লেজেগুবরে অবস্থা ঠিক তখন টকেশোতে আলোচনায় বিষয়টি উঠে আসলে নির্দেশ আসে বিদ্যুতের বিরুদ্ধে সমালোচকদের বাসার বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়ার। গত ২৪ এপ্রিল ২০১৩ সাভারে রানা প্লাজা ধ্বসে কয়েক হাজার মানুষ নিহত, আহত ও আটকা পড়লে বিষয়টি নিয়ে টকশোতে আলোচনা হয়। তখন নির্দেশ আসে মধ্যরাতে মানুষের ঘুম হারাম না করে সাভারে গিয়ে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়ার। এভাবে টকশোতে কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা হলে তখন নেমে আসে উপদেশ খয়রাত, নয়তো নির্দেশ, নয়তো টেলিফোন বা মোবাইলে হুমকি, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরাসরি হুমকি। এমনকি শারীরিক ভাবে লাঞ্চিত করার ঘটনাও ঘটেছে। একটি টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দলের একজন মন্ত্রীর হাতে একজন আলোচক নাজেহাল হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। টকশোতে অংশ গ্রহণ করে সরকারের সমালোচনা করার অপরাধে (?) বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীকে (মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে বেসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোচ্চ খেতাবপ্রাপ্ত) নব্য রাজাকার আখ্যাািয়ত করা হয়। সামগ্রিক ভাবে বিষয়টি পর্যালোচনা করলে এটা বুঝতে কারো কষ্ট হয় না যে, টেলিভিশন বা কোন মিডিয়ায় বা প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন সরকারের সমালোচনা করলেই আলোচকদের উপর নেমে আসে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে হুমকি নয়তো রাজাকার বা নব্য রাজাকার লকব লাগানো হয়। রাজাকার, নব্য রাজাকার বা যুদ্ধ অপরাধী লকব সবচেয়ে বড় দাওয়াই। এই লবক লাগিয়ে দেওয়ার আতঙ্কে লোকজন বিষয়টিকে নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করতে চায় না।   
সমালোচনা তো কোন খারাপ কিছু নয়। মানুষের মাঝে তিনটি শ্রেণীর মানুষ রয়েছে। এক. স্থাবক, দুই. নিন্দুক ও তিন. সমালোচক। তিনিই উত্তম মানুষ যিনি সমালোচক। যিনি তল্পিবাহক তিনি স্থাবক, ভাল কাজ করার পরেও অপছন্দ করে নিন্দা করে তিনি নিন্দুক। যিনি ভাল-খারাপ দুইদিক নিয়ে আলোচনা করার দক্ষতা ও জ্ঞান রাখেন তিনি সমালোচক। সমালোচনার অন্যতম শর্ত হচ্ছে সত্য কথা বলা। যা ইসলামের মূল বৈশিষ্ট্য। ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে ন্যায়নিষ্ট হওয়া, নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া এবং সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমিকা রাখা। বর্তমান সমাজে তথা দেশের অবস্থা এমন হয়েছে সমালোচকের স্থান কোথাও নেই। সমালোচকরাই যেন সব অনিষ্টের মূল। ফলে সমোলোচক পেলেই তাকে খেদাও। তাঁকে ধরো, তাঁকে পারলে মারো। এটাতো সামাজিক রীনিনীতি হতে পারে না, পারে না গণতান্ত্রিক রীতিনীতি হতে। এই প্রক্রিয়া হচ্ছে মানুষকে দাবিয়ে রাখার, মানুষের বাক-স্বাধীনতাকে গলা টিপে হত্যা করার প্রচেষ্টা। যা কোন অবস্থাতেই দেশের জন্য, দশের জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না।
এপ্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, প্রায় দেড় হাজার বছর আগে আবর উপদ্বীপের মক্কার দিকে ফিরে থাকালে আমরা কী দেখতে পাই? ইসলামের শুরুতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা স. এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেওয়া মুসলমানেরা মুশরিকদের লাত ও ওয্যা সম্পর্কে সমালোচনা করলে কুরাইশরা তা সহ্য করত না। কুরাইশরা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠত। পারলে সমালোচকদের ধরে মারপিট করত। লাত, ওয্যা ছিল মামুলী মূর্তি। এসব মূর্তির ছিল না কোন বোধ শক্তি, না ছিল কোন কিছু করার ক্ষমতা। কারো উপকারও করতে পারতো না, না পারতো কারো অপকারও করতে। যে বিষয়ে আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কুরআন মজিদের বিভিন্ন স্থানে বর্ণনা করেছেন। পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল ফুরকানের তিন নম্বর আয়াতে বর্ণনা করেছেন এভাবে, “লোকেরা তাঁকে ত্যাগ করে এমন সব উপাস্য গড়ে নিয়েছে যেগুলো কোনো জিনিস সৃষ্টি করে না, বরং নিজেরাই সৃষ্ট, যেগুলো নিজেদের জন্যও কোনো উপকার বা অপকার করার ক্ষমতা রাখে না, যেগুলো না জীবন-মৃত্যু দান করতে পারে আর না মৃতদেরকে আবার জীবিত করতে পারে।” 
মক্কাসহ আরব উপদ্বীপের কুরাইশসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মুশরিকরা এসব মূর্তির পূজা করতো। যেসব মূর্তি তারা নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছিল। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর পিয়ারা হাবিব শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা স.কে নবুয়ত প্রদান করার পরেই মক্কার কিছু কিছু মুশরিক এবং কিছু কিছু ইহুদী, খ্রীস্টান তাদের পূর্বতন ধর্মত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার ফলে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি, তার সাথে লাত ও ওয্যাসহ সমস্ত মূর্তির সমালোচনা বেড়ে যাওয়ার ফলে মুসলমানদের উপর নেমে আসে কুরাইশদের সীমাহীন নির্যাতন-নিপীড়ন। কুরাইশরা মুসলমানদের বিধর্মী নামে আখ্যায়িত করত। একপর্যায়ে কুরাইশরা মুসলমানদের রশি অথবা শিকল দিয়ে বেঁধে বর্বর নির্যাতন-নিপীড়ন চালাত, এমনকি মরুর তপ্ত বালু-পাথরের উপর শুয়ে রেখে বুকে পাথর চাপা দিত (হযরত বেলাল রা. তার দৃষ্টান্ত)। নির্যাতন-নিপীড়নের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের তাদের পূর্বতন ধর্মে (মূর্তিপূজক হিসেবে) ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। কুরাইশরা হাতেগোনা দু’একটি ক্ষেত্রে সফলকাম হলেও সংখ্যা গরিষ্ট ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেওয়া লোকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। ইসলামের বিজয় পতাকা ফৎ ফৎ করে উড়তে লাগল। 
কুরাইশ মুশরিক কর্তৃক আল্লাহ্র নবী স. ও মুসলমানদের উপর যুলুম অত্যাচার ও নির্যাতন নিপীড়নের এ ধারা নবুয়তের চতুর্থ বছরের মাঝামাঝি বা শেষদিকে আরম্ভ হয়েছিল। প্রথম দিকে কুরাইশদের অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন সহনীয় পর্যায়ে ছিল কিন্তু দিনে দিনে এর তীব্রতা বাড়তে থাকে। নবুয়তের পঞ্চম বছরের মধ্যবর্তী সময়ে তা তীব্র আকার ধারণ করল। ফলে মক্কায় অবস্থান করা মুসলমানদের জন্যে অসম্ভব হয়ে উঠল। 
এপ্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা ঝুমার অবতীর্ণ করেন। এতে হিজরতের ব্যাপারে ইঙ্গিত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ সা. জানতেন যে, হাবশার বাদশাহ আসহামা নাজ্জাশী একজন ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ। নাজ্জাশী ছিলেন খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী। তার রাজ্যে কারো ওপর কোন যুলুম নির্যাতন করা হয় না। এ কারণে আল্লাহ্র রাসূল স. নওমুসলমানদের দ্বীনের হেফাজতের জন্যে হাবশায় হিজরতের আদেশ প্রদান করলেন। প্রথম পর্যায়ে হযরত ওসমান বিন আফফান রা. নেতৃত্বে মোট ১২জন পুরুষ ও ৪জন মহিলা কুরাইশদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে হাবশায় হিজরত করেন। রাতের আঁধারে সংগোপনে মুসলমানেরা গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে যান। কুরাইশদের জানতে না দেয়ার জন্যই এ ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করা হয়। তাঁদের চলে যাওয়ার পরে কুরাইশরা খবর পেয়ে সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত ছুটে যায় তাদেরকে আটক করে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম রা. আগেই চলে গিয়েছিলেন। ফলে তারা ব্যর্থ হয়ে প্রত্যাবর্তন করে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পরে মুসলমানরা তাদের ভিটিবাড়ি ত্যাগ করে হিজরত করলেও কুরাইশদের আপত্তি ছিল। আপত্তি ছিল একারণে যে, নতুন ধর্ম ইসলামের অনুসারী বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং লাত ও ওয্যার উপর বিশ্বাস স্থাপনকারীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। পরবর্তীতে হযরত আম্মার রা. নেতৃত্বে ১৮জন মহিলাসহ ৮৩ জনের আরো একটি দল হাবশায় হিজরত করেন। প্রথম বারের হিজরতের চেয়ে এটা ছিল কঠিন। কেননা, কুরাইশ পৌত্তলিকরা এবার ছিল অনেক বেশি সতর্ক। তাদের ফাঁকি দিয়ে মুসলমানরা অন্যত্র গমন করে নিরাপদে জীবন অতিবাহিত করবে এটা তারা ভাবতেই পারছিল না। কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলার অসীম রাহমতে মুসলমানেরা কুরাইশদের চোখ ফাঁকি দিয়ে হাবশায় পৌঁছে গেল। পরবর্তীতে কুরাইশরা পরামর্শক্রমে হাবশায় হিজরতকারী মুসলমানদের (কুরাইশদের ভাষায় বিধর্মী) ফিরিয়ে আনতে কুরাইশদের দুইজন প্রতিনিধি হাবশায় ইহুদী বাদশাহ নাজ্জাশীর কাছে প্রেরণ করে। কিন্তু নাজ্জাশী মুসলমানদেরকে কুরাইশ প্রতিনিধিদের হাতে অর্পন করেননি।
কুরাইশ প্রতিনিধি আমর ইবনুল আস ইবনে ওয়ায়েল এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে আবু রাবী’য়াকে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হাবশা থেকে অপমানিত ও লজ্জিত হয়ে মক্কা ফিরে আসলে কুরাইশরা জানতে পারে মুসলমানরা সেখানে বেশ শান্তিতে ও নিরাপদে স্বাধীনভাবে জীবন-যাপন করছে এবং তাদের কোন কূট-কৌশলই কোন ফলোদয় হয়নি। অবশেষে তারা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, মক্কার সকল গোত্রের একসঙ্গে এই মর্মে ওয়াদাবদ্ধ হতে হবে যে, তারা বনূ মুত্তালিব ও বনূ হাশিমের (বনূ হাশিম ও বনূ মুত্তালিব যেহেতু আল্লাহ্র রাসূল স.কে নিরাপত্তা প্রদান করছে। ইসলাম প্রচারে বাঁধা না দিয়ে বরঞ্চ উল্টো সহায়তা প্রদান করছে সে কারণে) সাথে সামাজিক বয়কট করে সকল সম্পর্কছেদ করবে। সুতরাং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি সাদা কাগজে চুক্তিনামার বিষয়বস্তু লিপিবদ্ধ করে এবং সকলে একযোগে তাতে স্বাক্ষর প্রদান করে। চুক্তিনামার বিষয়বস্তু ছিল বনূ হাশিম ও বনূ মুত্তালিবের রমণীদের সাথে কেউ পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হতে পারবে না এবং অনুরূপভাবে কোন নারীকেও তাদের নিকট বিবাহ প্রদান করা যাবে না, তাদের কোন পণ্যদ্রব্য খরিদ করা যাবে না এবং অনুরূপভাবে তাদের নিকট কোন দ্রব্য-সামগ্রী বিক্রি করা যাবে না।
যখন চুক্তিনামা লিপিবদ্ধের কাজ সম্পূর্ণ হয় তখন তাকে আরো পাকাপোক্ত করার নিমিত্তে কাফিরগণ তা কা’বা গৃহের সাথে লটকিয়ে দেয়। বনূ মুত্তালিব ও বনূ হাশিম আবু তালিবের নিকট আগমন করে। তিনি তাদের এবং রাসূলুল্লাহ্ সা.সহ শা’বে আবু তালিব নামক স্থানে গমন করেন। এ স্থানে বনূ হাশিম ও বনূ মুত্তালিব গোত্রের লোকজন একাধারে তিন বছর অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এ বয়কটে পরিস্থিতি গুরুত্বর হয়ে উঠল। খাদ্যসামগ্রীর সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হল। যা-ও বা মক্কায় আসত মুশরিক কুরাইশরা তড়িগড়ি সেগুলো খরিদ করে নিত। ফলে অবরুদ্ধ মুসলিম-অমুসলিম কারো কাছে কোন কিছু স্বাভাবিক উপায়ে পৌঁছতে পারত না। তারা গাছের পাতা, গাছের বাকল (চামড়া) খেয়ে জীবন ধারণ করতেন। ক্ষুধার জ্বালা এত মারাত্মক ছিল যে, ক্ষুধার্ত নারী ও শিশুর কাতর ক্রন্দন শা’বে আবু তালিবের বাইরে থেকে শোনা যেত। তাদের নিকট কোন খাদ্যসামগ্রী পৌঁছার সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ। যা কিছু পৌঁছত সেসব সংগোপনে পৌঁছত। এই অবরোধের কারণ ছিল শুধু একটি, তা হচ্ছে, আল্লাহ্র নবী স. যাতে ইসলাম প্রচার বন্ধ করেন। নয়তো বনূ হাশিম ও বনূ মুত্তালিব আল্লাহ্র রাসূলকে প্রদত্ত নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে নেন। 
রাসূলুল্লাহ্ সা. পৌত্তলিকতার নোংরামি ও অকল্যাণসমূহ প্রকাশ্যে তুলে ধরে মিথ্যার পর্দা উন্মোচিত করেন। তিনি মূর্তিসমূহের অন্তসারশূন্যতা ও মূল্যহীনতা তুলে ধরে তাদের স্বরূপ ও উম্মোচন করেন। তিনি দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝাতে থাকেন যে, মূর্তিসমূহ নিরর্থক এবং শক্তিহীন। তিনি আরো জানান যে, তারা সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে নিমজ্জিত।
মূর্তির উপাস্যদেরকে পথভ্রষ্ট বলা হয়েছে একথা শোনার পর মক্কার অধিবাসীরা ক্রোধে দিশেহারা হয়ে পড়ল। তাদের ওপর যেন বজ্রপাত হল, তাদের নিরুদ্বেগ শান্তিপূর্ণ জীবনে যেন ঝড়ের তান্ডব দেখতে পেল। এ কারণেই কুরাইশরা অকম্মাৎ উৎসারিত ইসলামের এই বিপ্লবের শেকড় উৎপাটনের জন্যে উঠে পড়ে লাগল। কেননা, এ বিপ্লবের দ্বারা তাদের পৌত্তলিক রুসম-রেওয়াজ নির্মূল হতে চলেছে।
কুরাইশরা এতে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। হিজরতকারীদের পদে পদে বাঁধা প্রদান করতে থাকে। এপ্রসঙ্গে আরো দু’টি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে যে, হযরত উম্মে সালামাহ রা. ও তাঁর স্বামী আবু সালামাহ রা. নিজেদের দুধের বাচ্চাটিকে নিয়ে আল-মদিনা আল-মুনওয়ারায় হিজরত করার জন্য বের হয়ে পড়েন। বনূ মুগীরাহ (উম্মে সালামাহর পরিবারের লোকেরা) তাদের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। তারা আবু সালামাহকে বলে, তোমরা যেখানে ইচ্ছা যেতে পারো কিন্তু আমাদের মেয়েকে নিয়ে যেতে পারো না। বাধ্য হয়ে তিনি স্ত্রীকে রেখে চলে যান। এরপর বনী আবদুল আসাদ (আবু সালামাহর বংশের লোকেরা) এগিয়ে আসে এবং তারা বলে, শিশুটি আমাদের গোত্রের। তাকে আমাদের কাছে দিয়ে দাও। এভাবে মা ও বাপ উভয়ের কাছ থেকে শিশু সন্তানকেও ছিনিয়ে নেয়া হয়। প্রায় এক বছর পর্যন্ত হযরত উম্মে সালামাহ রা. স্বামী ও সন্তানের শোকে ছটফট করতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত বড়ই কঠিন বিপদের মধ্য দিয়ে নিজের শিশু সন্তানটি পুনরুদ্ধার করে মক্কা থেকে এমন অবস্থায় আল-মদিনা আল-মুনওয়ারার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়েন যে, একজন নিঃসঙ্গ স্ত্রীলোক কোলে একটি ছোট বাচ্চা নিয়ে উটের পিঠে বসে আছেন। এমন পথ দিয়ে তিনি চলছেন যেখান দিয়ে সশস্ত্র কাফেলা চলাচল করেত ভয় পেতো।
আইয়াশ ইবনে রাবীআহ আবু জেহেলের বৈপিত্রেয় ভাই ছিলেন। তিনি হযরত উমর রা.-এর সাথে হিজরত করে মদিনায় পৌঁছে যান। পিছে পিছে আবু জেহেল নিজে এক ভাইকে সাথে নিয়ে সেখানে পৌঁছে যায়। সে মায়ের নামে মিথ্যা বানিয়ে বলে, আম্মাজান কসম খেয়েছেন আইয়াশের চেহারা না দেখা পর্যন্ত রোদ থেকে ছায়ায় যাবে না এবং মাথায় চিরুনীও লাগাবেন না। কাজেই তুমি গিয়ে একবার শুধু তাকে চেহারা দেখিয়ে দাও তারপর চলে এসো। তিনি মায়ের প্রতি ভালোবাসা ও মাতৃভক্তির আতিশয্যে তাদের সঙ্গ নেন। পথে দুই ভাই মিলে তাকে বন্দী করে এবং তাকে নিয়ে মক্কায় এমন অবস্থায় প্রবেশ করে যখন তার হাত-পা রশি দিয়ে বাঁধা ছিল এবং দুই ভাই চিৎকার করে যাচ্ছিল, “হে মক্কাবাসী! নিজেদের নালায়েক ছেলেদেরকে এমনিভাবে শায়েস্তা করো যেমন আমরা করেছি।” দীর্ঘ দিন পর্যন্ত তিনি বন্দী থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত একজন দুঃসাহাসী মুসলমান তাকে উদ্ধার করে আল-মদিনা আল-মুনওয়ারায় নিয়ে আসতে সক্ষম হন।
মক্কা মোকাররামা থেকে আল-মদিনা আল-মুনওয়ারায় যারা হিজরত করেন তাদের প্রায় সবাইকে এ ধরনের জুলুম-নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ঘর-বাড়ি ছেড়ে আসার সময়ও জালেমরা তাদেরকে নিশ্চিন্তে ও নিরাপদে আসতে দেয়নি।
এইতো গেল হাবশা এবং আল-মদিনা আল-মুনওয়ারায় হিজরতকারীদেকে ফেরৎ আনার কুরাইশদের চক্রান্ত। তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ হওয়ার পরে তারা আল্লাহ্র রাসূল সা.-কে পর্যন্ত হত্যা করার পরিকল্পনা করে। এমনকি মসজিদুল হারামে নামাযরত অবস্থায় পাথর মেরে মাথা গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য আবু জেহেল প্রস্তুতি নিয়ে ছিল। কিন্তু তাঁকে স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা কাফের আবু জেহেলের কবল থেকে রক্ষা করেন।
আল্লাহ্র নবী সা. সত্য বলেছিলেন, সত্য প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছিলেন সে কারণেই কুরাইশরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। কুরাইশরা  চেয়েছিল ছিল অন্ধকার যুগ, জাহেলিয়ার যুগ। কিন্তু জাহেলিয়া, অসত্য উড়ে গেছে সত্যের ফুৎকারে।
এতসবের পরেও মুশরিক কুরাইশরা মুসলমানদের আটকাতে ব্যর্থ হয়। পরে কুরাইশরা মুসলমানদের সাথে আপোষ করতে চেষ্টা করে। এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, ওলীদ ইবনে মুগীরা, আস ইবনে ওয়ায়েল, আসওয়াদ ইবনে আবদুল মোত্তালিব ও উমাইয়া ইবনে খলফ প্রমুখ মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কয়েকজন একবার রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর কাছে এসে বলল ঃ আসুন, আমরা পরস্পরের মধ্যে এই শান্তিচুক্তি করি যে, একবছর আপনি আমাদের উপাস্যদের এবাদত করবেন এবং একবছর আমরা আপনার উপাস্যদের এবাদত করব। তিবরানীর রেওয়ায়েতে ইবনেÑআব্বাস রা. বর্ণনা করেন, কাফেররা প্রথমে পারস্পরিক শান্তির স্বার্থে রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর সামনে এই প্রস্তাব রাখল যে, আমরা আপনাকে বিপুল পরিমাণে ধনৈশ্বর্য দেব, ফলে আপনি মক্কার সর্বাধিক ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে যাবেন। আপনি যে মহিলাকে ইচ্ছা বিবাহ করতে পারবেন। বিনিময়ে আপনি শুধু আমাদের উপাস্যদেরকে মন্দ বলবেন না। যদি আপনি এটাও মেনে না নেন, তবে একবছর আমরা আপনার উপাস্যদের এবাদত করব এবং একবছর আপনি আমাদের উপাস্যদের এবাদত করবেন।
আবু সালেহ্-এর রেওয়ায়েতে ইবনে আব্বাস রা. বলেন ঃ মক্কার কাফেররা পারস্পরিক শান্তির লক্ষ্যে এই প্রস্তাব দিল যে, আপনি আমাদের কোন প্রতিমার গায়ে কেবল হাত লাগিয়ে দিন, আমরা আপনাকে সত্য বলব। 
এরপ্রেক্ষিতে পবিত্র কুরআন মজিদে সূরা কাফিরূন নাযিল হয়েছে। ১. বলুন, হে কাফেরকুল, ২. আমি এবাদত করিনা তোমরা যার এবাদত কর। ৩. এবং তোমরাও এবাদতকারী নও যার এবাদত আমি করি ৪. এবং আমি এবাদতকারী নই যার এবাদত তোমরা কর। ৫. তোমরা এবাদতকারী নও যার এবাদত আমি করি। ৬. তোমাদের কর্ম ও কর্মফল তোমাদের জন্যে এবং আমার কর্ম ও কর্মফল আমার জন্যে। 
সেসময় ইসলামের আলোতে মক্কার কুরাইশদের মুশরিকি, কুফরী, বাতেনি ভেসে যাচ্ছিলো বলেই সমালোচনাকে ভয় পেতো। কিন্তু এখন ভয় পাওয়ার কী আছে? বরঞ্চ সমালোচনাকে স্বাগত জানানো উচিত। বৃহত্তর চট্টগ্রামের একটি প্রবাদ দিয়েই লেখা শেষ করব, আর তা হচ্ছে, “মানুষ ধাক্কা খেলে পাক্কা হয়”। সমালোচনা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত। সেটা সবার জন্য প্রযোজ্য। আশা করব সবার বোধোদয় হবে। আল্লাহ্ তাদেরকে এবং আমাদেরকে হেদায়ত দান করুন। আল্লাহ্ আমাদেরকে কবুল করুন। আমিন।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক।
islamcox56@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন