রবিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৩

মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ বাংলা সাংবাদিকতার পথিকৃ


আজ ১৮ আগস্ট মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁর ৪৪তম মৃত্যু বার্ষিকী। তিনি বাংলা সংবাদপত্র ও বাঙালি সাংবাদিকতার পথিকৃত। মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং ইসলামী পণ্ডিত। তাঁকে বাংলা ভাষার সংবাদপত্রের জনক বললে অতুক্তি হবে না। তিনি বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদের (১৯৩৬-১৯৯২) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন।
আকরাম খান ১৮৬৮ সালে পশ্চিম বঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার হাকিমপুর এলাকায় জন্ম গ্রহন করেন।  প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর খুব বেশি ছিল না। পড়ালেখার জন্য তিনি ইউরোপ বা বৃটিশ যাননি। তিনি কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেন। খুব অল্প বয়সেই তাঁর সাংবাদিকতা পেশায় হাতেখড়ি।
১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ দৈনিক আজাদ পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করেন। সেই সময় বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল এবং দৈনিক আজাদ ছিল বাংলাভাষার প্রথম সংবাদপত্র। মুসলিম লীগের সমর্থন যোগাতে এই বাংলা পত্রিকাটি সেই সময় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ ১৯০৮ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত দি মোহাম্মদী ও আল-ইহসান পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। আহলে হাদীস ও মোহাম্মদী আকবর পত্রিকায় তাঁর সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। তিনি ১৯২০ থেকে ১৯২২ পর্যন্ত সময়ে কলকাতা থেকে জামানা ও সেবক পত্রিকা প্রকাশ করেন। তৎকালীন সময়ে তিনি সেবক পত্রিকার মাধ্যমে অসহযোগ আন্দোলন ও স্বদেশী আন্দোলন সমর্থন প্রদান করেন। এর মধ্য দিয়ে স্বদেশী আন্দোলন ও অনহযোগ আন্দোলন বেগবান হয়। একপর্যায়ে বেনিয়া ব্রিটিশ সেবক পত্রিকা বন্ধ করেন দেয় এবং তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
মাওলানা মুহম্মদ আকরাম খাঁ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে রাজনীতি শুরু করেন। মওলানা আকরাম ছিলেন ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগের একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯১৮ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি খেলাফত এবং অসহযোগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯২০ সালে ঢাকার আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে তিনি নিখিল ভারত খেলাফত আন্দোলন কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনে খেলাফত আন্দোলনের অন্যতম নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদি এবং মওলানা মজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। আকরাম খাঁনের দায়িত্ব ছিল তুর্কি খেলাফত থেকে ফান্ড সংগ্রহ করা। ১৯২০-১৯২৩ সময়ের মধ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন স্থানে জনসভা বা সম্মেলনের আয়োজন করে খেলাফত আন্দোলন এবং অসহযোগ আন্দোলন  গতিশীল করার চেষ্ঠা করেন। হিন্দু মুসলিম ভাতৃত্বের ক্ষেত্রে ১৯২২ সালে আকরাম খাঁ চিত্ত রঞ্জন দাসের স্বরাজ পার্টির পক্ষ নেন। এবং ১৯২৩ সালের বাংলা সন্ধির সময়ও তিনি একই পক্ষে ছিলেন। ১৯২৬-১৯২৭ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং অন্যান্য সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলীর কারণে আকরাম খাঁ ভারতীয় রাজনীতিতে তার বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন এবং তিনি স্বরাজ পার্টি এবং কংগ্রেস থেকে সরে দাঁড়ান। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যে তিনি গ্রাম্য রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩৬ সালে তিনি  গ্রাম্য রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে সক্রিয় ভাবে মুসলিম লীগের সাথে যুক্ত হন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের পর তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন এবং ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
মাওলানার সাহিত্য কর্মের মধ্যে রয়েছে, ১. সমস্যা ও সমাধান, ২. আমপারার বাংলা অনুবাদ, ৩. মোস্তফা-চরিত,
৪. মোস্তফা-চরিতের বৈশিষ্ট্য, ৫. বাইবেলের নির্দেশ ও প্রচলিত খ্রীষ্টান ধর্ম, ৬. মুসলীম বাংলার সামাজিক ইতিহাস, ৭. তাফসীরুল কোরআন (১-৫ খন্ড)।
মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ ১০১ বছর বয়সে ১৯৬৯ সালের ১৮ আগষ্ট রাজধানী বংশালে আহলে হাদীস মসজিদে নামাযরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। আমি তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। আল্লাহ্ তাঁকে বেহেস্তে নসীব করুন।
বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বাংলদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার (মরনোত্তর) স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, ১৯৮১ প্রদান করেন।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক।
islamcox56@gmail.com

রবিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৩

আহলি কিতাবীরা কী মুসলিম?


আহলি কিতাবীরা কী মুসলিম? আহলি কিতাবীদের ধর্ম কী ইসলাম? আহলি কিতাবী ঈসায়ী ও মূসায়ী তথা ইহুদী ও নাসারাদের সাথে উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর মধ্যকার বিয়ে কী বৈধ? এ প্রশ্ন এখন ঘুরে-ফিরে আসছেই। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে আলোচনার পরেই বিষয়টি আলোচিত। অনেক সম্মানিত মুফাস্সির মনে করেন যে, এটা একটি মিমাংসিত বিষয়। ফলে নতুন করে আলোচনা আসা কেন? 
শুরুতেই একটি বিষয় সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকা দরকার যে, আহলি কিতাব কী বা কারা আহলি কিতাব? পবিত্র কুরআন মজিদে বলা হয়েছে, “যাদের কাছে আগের নবীদের আনা কোন আসমানী কিতাব ছিল, তা যত বিকৃত আকারেই থাক না কেন, তারা তা মেনে চলতো, তাদেরকে বলা হয় আহলি কিতাব। আহলি কিতাব ও মুশরিক উভয় দলই কুফরী কর্মকাণ্ডে জড়িত হলেও দু’দলকে দু’টি পৃথক নামে ডাকা হয়। আর তা হচ্ছে আহলি কিতাব ও মুশরিক। যারা কোন নবীর অনুসারী ছিল না, কোন আসমানী কিতাবও মানতো না বা মানে না তারা মুশরিক।” কুরআন মজিদের বহু স্থানে আহলি কিতাবদের শিরকের উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন খ্রীস্টানদের (নাসারাদের) সম্পর্কে বলা হয়েছে ঃ “তারা বলে, আল্লাহ্ তিন খোদার একজন।” (সূরা আল মায়েদাহ ৭৩) “তারা মসীহকেও খোদা বলে।” (সূরা আল মায়েদাহ ১৭) “তারা মসীহকে আল্লাহ্র পুত্র গণ্য করে।” (সূরা আত তাওবা ৩০) আবার ইহুদিদের সম্পর্কে বলা হয়েছে ঃ “তারা উযাইরকে আল্লাহ্র পুত্র বলে” (সূরা আত তাওবা ৩০) কিন্তু এসব সত্ত্বেও কুরআনের কোথাও তাদের জন্য মুশরিক পরিভাষা ব্যবহার করা হয়নি। বরং তাদের উল্লেখ করা হয়েছে “আহলি কিতাব” বা “যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল” শব্দের মাধ্যমে। অথবা ইহুদী ও নাসারা শব্দদ্বয়ের মাধ্যমে। কারণ তারা আসল তাওহিদী ধর্ম মানতো, তারপর ক্রমান্বয়ে তারা শিরকে লিপ্ত হয়।   
এখানে তিনটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, আহলি কিতাবীরা মুসলিম (ছিলেন)। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, তাদের ধর্ম ইসলাম, এতে কোন সন্দেহ নেই। এবং তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, আহলি কিতাবী ঈশায়ী ও মূসায়ী বা ইহুদী ও নাসারাদের সাথে উম্মতে মুহাম্মদী সা.-এর মধ্যকার বিয়ে একসময় বৈধ ছিল। তবে এখন সেই বিয়ে বৈধ নয়। কোন আহলি কিতাবী উম্মতে মুহম্মদী স. হওয়ার পরেই বিয়ে বৈধ। আহলি কিতাবীরা মুসলিম ছিলেন। ব্রাকেট দিয়ে বলা হয়েছে ‘ছিলেন’। কেউ শিরকে লিপ্ত হলে মুসলিম থাকার প্রশ্নই আসে না।
উত্থাপিত প্রথম এবং দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর নিন্মের আলোচনা থেকে পেতে পারি। আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কুরআন মজিদে স্পষ্ট করে বলেছেন যে, আহলী কিতাবীরাও মুসলিম এবং তাদের ধর্মও ইসলাম।  
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল কাসাস-এর ৫২ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, “যাদেরকে আমি এর আগে কিতাব দিয়েছিলাম তারা এর (কুরআন) প্রতি ঈমান আনে।”
এর অর্থ এই নয় যে, সমস্ত আহলে কিতাব (ইহুদী ও ঈসায়ী) এর প্রতি ঈমান আনে। বরং এ সূরা নাযিল হবার সময় যে ঘটনা ঘটেছিলো এখানে আসলে সেদিকে ইশারা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মক্কাবাসীদেরকে লজ্জা দেয়াই উদ্দেশ্য যে, তোমাদের নিজেদের বাড়িতে যে নিয়ামত এসেছে তাকে তোমরা প্রত্যাখ্যান করছো। অথচ দূরদেশ থেকে লোকেরা এর খবর শুনে আসছে এবং এর মূল্য অনুধাবন করে এ থেকে লাভবান হচ্ছে। যেমন সে সময় হাবশা ও ইয়াসরীবের লোকজন এসে আল্লাহ্র নবী স.-এর কাছে বাইয়াত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। 
পবিত্র কুরআন মজিদ-এর সূরা আল কাসাস-এর ৫৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আর যখন তাদেরকে এটা শুনানো হয় তখন তারা বলে, “আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি, এটি যথার্থই সত্য আমাদের রবের পক্ষ থেকে, আমরা তো আগে থেকেই মুসলিম।”
এর মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এর আগেও আমরা নবীদের এবং আসমানী কিতাবের আনুগত্য করে এসেছি। তাই ইসলাম ছাড়া আমাদের অন্য কোনো দীন ছিলো না। আর এখন যে নবী আল্লাহ্র পক্ষ থেকে কিতাব নিয়ে এসেছেন তাকেও আমরা মেনে নিয়েছি। কাজেই মূলত আমাদের দীনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং আগেও যেমন আমরা মুসলমান ছিলাম তেমনি এখনও মুসলমান আছি।
একথা থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স. যে দীনের দাওয়াত দিয়েছেন তার নামই শুধু ইসলাম নয় এবং ‘মুসলিম’ পরিভাষাটি শুধুমাত্র নবী করীম স.-এর অনুসারীগণ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। বরং সব সময় এ ইসলামই ছিলো সকল নবীর দীন এবং সব জমানায় তাঁদের সবার অনুসারীগণ মুসলমানই ছিলেন। হযরত আদম আ. ছিলেন প্রথম মানুষ এবং প্রথম নবী। সেই থেকে শেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ স. পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলগণ ইসলামই প্রচার করেছেন। শেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ স. এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তাঁর মনোনীত জীবন বিধান পূর্ণাঙ্গ ইসলামেরই প্রচার করেছেন। তাই পরবর্তী যে কোন নবী-রাসূলের আনীত বিধানের সাথে পূর্ববর্তী কোন নবীর আনীত অবিকৃত ইসলামী বিধানের উপর বিশ্বাস স্থাপন ঈমানের অন্যতম শর্ত। মুসলমানরা যদি কখনো পরবর্তীকালে আগত কোনো সত্য নবীকে মানতে অস্বীকার করে থাকে তাহলে কেবল তখনই তারা কাফের হয়ে গিয়ে থাকবে। কিন্তু যারা পূর্বের নবীকে মানতো এবং পরের আগত নবীকেও মেনে নিয়েছে তাদের ইসলামে কোনো ছেদ পড়েনি। তারা পূর্বেও যেমন মুসলমান ছিলো, পরেও তেমনি মুসলমান।
প্রকৃত পক্ষে, পবিত্র কুরআন মজিদ কেবলমাত্র এই একটি স্থানেই নয়, বরং অসংখ্য জায়গায় এ সত্যটি বর্ণনা করেছেন। কুরআন বলছে, আসল দীন হচ্ছে একমাত্র ‘ইসলাম’ (আল্লাহ্র আনুগত্য) এবং আল্লাহ্র বিশ্ব-জাহানে আল্লাহ্র সৃষ্টির জন্য এছাড়া দ্বিতীয় কোনো দীন বা ধর্ম হতে পারে না। সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে যে নবীই মানুষকে পথনির্দেশ দেবার জন্য এসেছেন তিনি এ দীনই নিয়ে এসেছেন। আর নবীগণ হামেশাই নিজেরা মুসলিম থেকেছেন, নিজেদের অনুসারীদেরকে মুসলিম হয়ে থাকার তাকিদ দিয়েছেন এবং তাঁদের যেসব অনুসারী নবুওয়াতের মাধ্যমে আগত আল্লাহ্র ফরমানের সামনে আনুগত্যের শির নত করে দিয়েছেন তারাও প্রতিটি যুগে মুসলমিই ছিলেন। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত স্বরূপ শুধুমাত্র কয়েকটি আয়াত পেশ করা যায়-
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আলে ইমরানের ১৯ নম্বর আয়াতে বর্ণিত, “আসলে আল্লাহ্র কাছে ইসলামই একমাত্র দীন।”
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা ইউনুস-এর ৭২ নম্বর আয়াতে বর্ণিত, “আর যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন অবলম্বন করে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না।”
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল বাকারাহ-এর ১৩১, ১৩২ ও ১৩৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত, “যখন তার রব তাকে বললেন, মুসলিম (ফরমানের অনুগত) হয়ে যাও, সে বললো, আমি মুসলিম হয়ে গেলাম রব্বুল আলামীনের জন্য। আর এ জিনিসটিরই ওসিয়াত করে ইবরাহীম তার সন্তানদেরকে এবং ইয়া’কূবও ঃ হে আমার সন্তানরা! আল্লাহ্ তোমাদের জন্য এ দীনটিই পছন্দ করেছেন। কাজেই মুসলমি না হয়ে তোমরা কখনো মৃত্যুবরণ করো না। তোমরা কি তখন উপস্থিত ছিলে যখন ইয়া’কূবের মৃত্যুর সময় এসে গিয়েছিলো, যখন সে তার পুত্রদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলো, আমার মৃত্যুর পর তোমরা কার ইবাদত করবে? তারা জবাব দিয়েছিল, আমরা ইবাদত করবো আপনার ইলাহ-এর এবং আপনার বাপ-দাদা ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের ইলাহ-এর, তাঁকে একক ইলাহ হিসেবে মেনে নিয়ে। আর আমরা তাঁরই অনুগত-মুসলিম।” 
“ইবরাহীম ইহুদী ছিলো না, খৃষ্টানও ছিলো না, বরং ছিলো একনিষ্ট মুসলিম।”
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল বাকারাহ-এর ১২৮ নম্বর আয়াতে স্বয়ং হযরত ইবরাহীম আ. ও হযরত ইসমাঈল আ. দোয়া করেন এভাবে, “হে আমাদের রব! আমাদেরকে তোমার মুসলিম (অনুগত) করো এবং আমাদের বংশ থেকে একটি উম্মত সৃষ্টি করো যে হবে তোমার অনুগত (মুসলিম)।”
হযরত ইউসূফ আ. মহিমান্বিত রবের দরবারে নিবেদন করেন :
“আমাকে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু দান করো এবং সৎকর্মশীলদের সাথে মিলিয়ে দাও।”
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা ইউনুস এর ৮৪ নম্বর আয়াতে হযরত মূসা আ. তঁাঁর নিজের জাতিকে বলেন :
“হে আমার জাতি! যদি তোমরা আল্লাহ্র প্রতি ঈমান এনে থাকো, তাহলে তাঁর ওপরই ভরসা করো যদি তোমরা মুসলিম হয়ে থাকো।”
বনী ইসরাঈলের আসল ধর্ম ইহুদীবাদ নয়, বরং ইসলাম ছিলো। বন্ধু ও শত্রু সবাই একথা জানতো। কাজেই ফেরাঊন সাগরে ডুবে যেতে যেতে যে শেষ কথাটি বলে তা হচ্ছে ঃ পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা ইউনুস এর ৯০ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, “আমি মেনে নিলাম বনী ইসরাঈল যার প্রতি ঈমান এনেছে তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই এবং আমি মুসলিমদের অন্তরভুক্ত।”
বনী ইসরাঈলের সকল নবীর দীনও ছিলো এ ইসলাম। যা সূরা আল মায়েদাহ-এর ৪৪ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, “আমি তাওরাত নাযিল করেছি, যাতে ছিলো হেদায়াত ও আলো, সে অনুযায়ী সে নবীগণ যারা মুসলিম ছিল তাদের বিষয়াদির ফয়সালা করতো যারা ইহুদী হয়ে গিয়েছিলো।”
আর এটিই ছিল হযরত ঈসা আ. ও তাঁর হাওয়ারীদের (সহযোগী) দীন। যা পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল মায়েদাহ-এর ১১১ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “আর যখন আমি হাওয়ারীদের প্রতি (কাছে) ওহী পাঠালাম যে, ঈমান আনো আমার প্রতি এবং আমার রসূলের প্রতি, তখন তারা বললো, আমরা ঈমান এনেছি এবং সাক্ষী থাকো আমরা মুসলিম।”
আসলে এ আয়াতগুলোতে যে কথাটি বলা হয়েছে তা হচ্ছে, আল্লাহ্র পক্ষ থেকে যে প্রকৃত দীনটি এসেছে তা খৃষ্টবাদ, মূসাবাদ বা মুহাম্মদবাদ নয় বরং তা হচ্ছে নবীগণ ও আসমানী কিতাবসমূহের মাধ্যমে আগত আল্লাহ্র ফরমানের সামনে আনুগত্যের শির নত করে দেয়া এবং এ নীতি আল্লাহর যে বান্দা যেখানেই যে যুগেই অবলম্বন করেছে সে-ই হয়েছে একই বিশ্বজনীন, আদি ও  চিরন্তন সত্যদীনের অনুসারী। সে সত্যদীন হলো ইসলাম। যারা এ দীনকে যথার্থ সচেতনতা ও আন্তরিকতা সহকারে গ্রহণ করেছে তাদের জন্য মূসার পরে ঈসাকে এবং ঈসার পরে মুহাম্মদ সা.-কে মেনে নেয়া ধর্ম পরিবর্তন করা হবে না, বরং হবে প্রকৃত ও আসল ধর্মের অনুসরণ করার স্বাভাবিক ও ন্যাগসংগত কাজ। পক্ষান্তরে যারা আম্বিয়া আ.-এর উম্মতের মধ্যে না জেনে-বুঝে ঢুকে পড়েছে অথবা তাঁদের দলে জন্ম নিয়েছে এবং জাতীয় ও বংশীয় স্বার্থপ্রীতি যাদের জন্য আসল ধর্মে পরিণত হয়ে গেছে তারা ইহুদী ও খৃস্টান হয়ে রয়ে গেছে এবং শেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ সা.-এর আগমনে তাদের মূর্খতা ও অজ্ঞতার হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে গেছে। কারণ তারা আল্লাহ্র শেষ নবীকে অস্বীকার করেছে। আর এটা করে তারা শুধু যে নিজেদের ভবিষ্যতে মুসলিম হয়ে থাকাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তাই নয়, বরং নিজেদের এ কার্যকলাপের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করে দিযেছে যে, তারা আসলে ইতিপূর্বেও মুসলিম ছিলো না, নিছক একজন নবীর বা কয়েকজন নবীর ব্যক্তিত্বের ভক্ত ও অনুরক্ত ছিল। অথবা পিতা-প্রপিতার অন্ধ অনুকরণকে ধর্মীয় আচারে পরিণত করে রেখেছিলো।
এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে তারা মুসলিম ছিলেন এবং তাদের ধর্ম ইসলাম। কিন্তু পরবর্তীতে এই সব আহলে কিতাবীদের অনেকেই আল্লাহ্ তা’আলার একত্ববাধের উপর ঈমান আনলেও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স.-এর প্রতি ঈমান আনেনি, আল্লাহ্র নবী স.-এর প্রতি প্রেরিত পবিত্র কুরআন মজিদের প্রতি ঈমান আনেনি। তারা দোয়াল্লিন ও মগদুব পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্ত। তারা অমুসলিম, তারা ইসলামকে অস্বীকারকারী, তারা জালেম, তারা আল্লাহ্ তা’আলার অবাধ্য, তারা অবিশ্বাসী। আর সে কারণেই মুমিনদেরকে আহলে কিতাবীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না রাখার ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কুরআন মজিদে নিষেধ করেছেন। 
আহলে কিতাবীদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল-মায়েদাহ-এর ৫১ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “হে মুমিনগণ, তোমরা ইহুদী ও নাসারাকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।”
এই আয়াতে মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন ইহুদী ও নাসারাদের সাথে সামঞ্জস্য ও গভীর বন্ধুত্ব না করে। সাধারণ অমুসলিম এবং ইহুদী ও খ্রীস্টানদের রীতিও তাই। তারা গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে শুধু স্বীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে; মুসলমানদের সাথে এরূপ সম্পর্ক স্থাপন করে না।
এরপর যদি কোন মুসলমান এ নির্দেশ অমান্য করে কোন ইহুদী অথবা খ্রীস্টানের সাথে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে, তবে সে ইসলামের দৃষ্টিতে সে সম্প্রদায়ের লোক বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য।
তফসীরবিদ ইবনে জরীর ইকরামা রা.-এর বাচনিক বর্ণনা করেন ঃ এ আয়াতটি একটি বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছে। ঘটনাটি এই যে, রাসূলুল্লাহ্ সা. মদিনায় আগমনের পর পার্শ্ববর্তী ইহুদী ও নাসারাদের (খ্রীস্টানদের) সাথে এই মর্মে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন যে, তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিজেরা যুদ্ধ করবে না, বরং মুসলমানদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আক্রমণকারীকে প্রতিহত করবে। এমনিভাবে মুসলমানরাও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না এবং কোন বহিরাক্রমণকারীর সাহায্য করবে না, বরং আক্রমণকারীকে প্রতিহত করবে। কিছুদিন পর্যন্ত এ চুক্তি উভয় পক্ষেই বলবৎ থাকে, কিন্তু ইহুদীরা স্বভাবগত কুটিলতা ও ইসলাম বিদ্বেষের কারণে বেশিদিন এ চুক্তি মেনে চলতে পারল না এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে মক্কার মুশরিকদের সাথে ষড়যন্ত্র করে তাদেরকে স্বীয় দুর্গে আহবান জানিয়ে পত্র লিখল। রাসূলুল্লাহ্ সা. হযরত জিবরাঈল আ. কর্তৃক এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে তাদের বিরুদ্ধে একটি মুজাহিদ বাহিনী প্রেরণ করলেন। বনী-কুরায়যার এসব ইহুদী একদিকে মুশরিকদের সাথে হাত মিলিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এবং অপর দিকে মুসলমানদের দলে অনুপ্রবেশ করে অনেক মুসলমানের সাথে বন্ধুত্বের চুক্তি সম্পাদন করে রেখেছিল। এভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের জন্যে গুপ্তচর বৃত্তিতে লিপ্ত ছিল। এ কারণে আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং মুসলমানদেরকে ইহুদী ও নাসারাদের (খ্রীস্টানদের) সাথে গভীর বন্ধুত্ব স্থাপন করতে নিষেধ করে দেয়া হয়।
একই সাথে পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল মায়েদাহ-এর সূরা ৫৭ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের পূর্ববর্তী আহলে কিতাবের মধ্য থেকে যেসব লোক তোমাদের দীনকে বিদ্রুপ ও হাসি-তামাশার বিষয়ে পরিণত করেছে তাদেরকে এবং অন্যান্য কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। আল্লাহ্কে ভয় করো, যদি তোমরা  মুমিন হয়ে থাকো।”
সূরা আল-মায়েদাহ-এর ৫৯ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘তাদেরকে বলো, “হে আহলি কিতাব! আমাদের প্রতি তোমাদের ক্রোধের একমাত্র কারণ এই যে, আমরা আল্লাহ্র ওপর এবং দীনের সে শিক্ষার ওপর ঈমান এনেছি যা আমাদের প্রতি নাযিল হয়েছে এবং আমাদের আগেও নাযিল হয়েছিলো। আর তোমাদের বেশির ভাগ লোকই অবাধ্য।”
সূরা আল-মায়েদাহ্-এর ৬৫ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “যদি (বিদ্রোহের পরিবর্তে) এ আহলে কিতাব গোষ্ঠী ঈমান আনতো এবং আল্লাহভীতির পথ অবলম্বন করতো, তাহলে আমি তাদের থেকে তাদের দুষ্কৃতিগুলো মোচন করে দিতাম এবং তাদেরকে পৌঁছিয়ে দিতাম নিয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাতে।” সূরা আল-মায়েদাহ্-এর ৬৬ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “হায়, যদি তারা তাওরাত, ইনজীল ও অন্যান্য কিতাবগুলো প্রতিষ্ঠিত করতো, যা তাদের রবের পক্ষ থেকে তাদের কাছে পাঠানো হয়েছিলো! তাহলে তাদের জন্য রিযিক ওপর থেকে বর্ষিত হতো এবং নিচে থেকেও উত্থিত হতো। তাদের মধ্যে কিছু লোক সত্যপন্থী হলেও অধিকাংশই অত্যন্ত খারাপ কাজে লিপ্ত।”
কাজেই ইহুদী ও নাসারারা (খ্রীস্টানরা) যদি ধর্মগ্রন্থে আল্লাহ ও নবীদের পক্ষ থেকে উদ্বৃত প্রকৃত শিক্ষার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতো তাহলে নিঃসন্দেহে নবী সা.-এর আবির্ভাবকালে তাদেরকে একটি ন্যায়বাদী ও সত্যপন্থী দল হিসেবে পাওয়া যেতো। এক্ষেত্রে তারা পবিত্র কুরআন মজিদের মধ্যে সেই একই আলো দেখতে পেতো, যা পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর মধ্যে পাওযা যেতো। এ অবস্থায় নবী সা.-এর আনুগত্য করার জন্য তাদের ধর্ম পরিবর্তন করার আদতে কোনো প্রশ্নই দেখা দিতো না, বরং যে পথে তারা চলে আসছিল সে পথের ধারাবাহিক পরিণতি হিসেবেই তারা মুহাম্মদ সা.-এর অনুসারী হয়ে সামনে অগ্রসর হতে পারতো। অথচ তারা করেনি। তারা না করে অবাধ্য হয়েছে।  
আহলি কিতাবী ও উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর বিয়ের ব্যাপারে কিছু কিছু আলেমেদীন ও মুফাস্সির মনে করেন এই বিয়ে বৈধ। পাশাপাশি অনেক আলেমেদীন মনে করেন যে, এই বিয়ে বৈধ নয়। আমি ব্যক্তিগত ভাবে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে, আল্লাহ্র পবিত্র কুরআন সম্পর্কে সম্পূর্ণ মুর্খ ও অজ্ঞ। আমিও মনে করি যে আহলি কিতাবী এবং উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর মধ্যকার বিয়ে বৈধ নয়। যারা বিয়ে বৈধ মনে করেন তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, যে সব আহলি কিতাবী আল্লাহ্ তা’আলার একত্ববাদের উপর অবিচল আস্থা আছে তাদের সাথে উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর বিয়ে বৈধ। এখানেই শেষ নয়। আছে আরো কিছু যুক্তি আর তা হচ্ছে, আহলি কিতাবরা আল্লাহ্র নাম নিয়ে যদি কোন হালাল প্রাণীকে সঠিক পদ্ধতিতে যবেহ করে তাহলে তা মুসলমানদের জন্য তা হালাল গণ্য করা হয়েছে। তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে করারও অনুমতি দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে মুশরিকদের যবেহ করা প্রাণীও হালাল নয় এবং তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে করারও অনুমতি দেয়া হয়নি। পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল-মায়েদার ৫ নম্বর আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী কোনো কোনো মুফাস্সির আহলি কিতাবীদের মেয়েদের সাথে উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর পুরুষের সাথে বিয়ে বৈধ মনে করেন। উক্ত সূরায় বর্ণিত হয়েছে যে, “আজ তোমাদের জন্য সমস্ত পাক-পবিত্র বস্তু হালাল করা হয়েছে। আহলে কিতাবের খাদ্য দ্রব্য তোমাদের জন্য হালাল এবং তোমাদের খাদ্য দ্রব্য তাদের জন্য হালাল। আর সংরক্ষিত মেয়েরা তোমাদের জন্য হালাল, তারা ঈমানদারদের দল থেকে হোক বা এমন জাতিদের মধ্য থেকে হোক, যাদেরকে তোমাদের আগে কিতাব দেয়া হয়েছে। তবে শর্ত এই যে, তোমরা তাদের মোহরানা পরিশোধ করে দিয়ে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে তাদের রক্ষক হবে।”  
এখানে ব্যাখ্যায় আহলি কিতাবী বলতে ইহুদী-খৃষ্টানদের (নাসারাদের) কথা বলা হয়েছে। কেবলমাত্র তাদের নারীদেরকেই বিবাহ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আর এর সংগে শর্তও আরোপিত হয়েছে যে, তাদের ‘মুহসানাত’ (সংরক্ষিত মহিলা) হতে হবে। এ নির্দেশটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিরূপণের ব্যাপারে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর মতে এখানে আহলে কিতাব বলতে সেসব আহলে কিতাবকে বুঝানো হয়েছে যারা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রজা। অন্যদিকে দারুল হারব ও দারুল কুফরের ইহুদী ও খৃস্টান (নাসারা) মেয়েদের বিয়ে করা জায়েয নয়। হানাফী ফকীহগণ এর থেকে সামান্য একটু ভিন্নমত পোষণ করেন। তাদের মতে বহির্দেশের আহলে কিতাবের মেয়েদেরকে বিয়ে করা হারাম না হলেও মাকরূহ, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তারপর ‘মুহসানাত’ শব্দের অর্থের ব্যাপারেও ফকীহগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রা.-এর মতে ‘মুহসানাত’ অর্থ পবিত্র ও নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী মেয়েরা। ‘মুহসানাত’ শব্দের এ অর্থ গ্রহণ করার কারণে তিনি আহলে কিতাবের স্বেচ্ছাচারী মেয়েদের বিয়ে করাকে এ অনুমতির আওতার বাইরে রেখেছেন।          
এপ্রসঙ্গে সূরা আল মায়েদাহ-এর ১৯ নম্বর আয়াতে কি বলা হয়েছে তা আমরা দেখে নিতে পারি। আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “হে আহলি কিতাব! রসূলদের সিলসিলা দীর্ঘকাল বন্ধ থাকার পর প্রকৃত সত্যকে সুস্পষ্ট করার জন্য তোমাদের কাছে আমার রসূল এসেছে। যাতে তোমরা বলতে না পারো আমাদের কাছে না কোন সুসংবাদদানকারী এসেছিল, না এসেছিল কোন সতর্ককারী। কাজেই নাও,এখন তোমাদের কাছে সুসংবাদদানকারী এসে গেছে এবং সতর্ককারীও।”
এখানে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ স.-কেই একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ বলা হয়েছে। কিন্তু এর পরেও ইহুদী ও নাসারারা শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স.-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেনি। পবিত্র কুরআন মজিদের প্রতি একীন রাখেনি। যা সূরা আল বাকারাহ-এ তাদেরকে আহবান জানানোর পরেও তারা অবাধ্য থেকে গেছে।              
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল বাকারাহ-এর ২-৪ নম্বর আয়াতে বর্ণিত আছে যে, “এটি আল্লাহ্র কিতাব, এর মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। এটি হেদায়াত সেই মুত্তাকীদের জন্যে, যারা অদৃশ্যে ঈমান রাখে নামায কায়েম করে এবং যে রিযিক আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে খরচ করে। আর যে কিতাব তোমার ওপর নাযিল করা হয়েছে (অর্থাৎ কুরআন) এবং তোমার আগে যেসব কিতাব নাযিল করা হয়েছিলো সেগুলোর ওপর ঈমান আনে এবং আখেরাতের ওপর একীন রাখে।”
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল বাইয়েনাহ নাযিল হয়েছে মূলত আহলি কিতাব ও মুশরিকদের চিহ্নিত করার জন্য, তাদের সম্পর্কে বর্ণনা করার জন্য। আহলি কিতাবদের গোমরাহী তুলে ধরার জন্য। সূরায় একথাটি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, যেসব আহলি কিতাব ও মুশরিক এই রসূলকে মেনে নিতে অস্বীকার করবে তারা নিকৃষ্টতম সৃষ্টি। তাদের শাস্তি চিরন্তন জাহান্নাম। আজকের আহলি কিতাবীরা আল্লাহ্র সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স.-কে অস্বীকার করেছে। (নাসারাদের) কেউ তিন আল্লাহ্র উপর বিশ্বাস করে। (ইহুদিদের) কেউবা শেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মদ স.-এর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। অথচ শেষ নবী মুহাম্মদ স.-এর প্রতি ভালবাসা ঈমানের অন্যতম শর্ত। ফলে তাদের সাথে যেমন বন্ধুত্ব করা অবৈধ, তেমনি ভাবে তাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কও অবৈধ। 
সূরা আল বাইয়েনাহ-এর ১-৩ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “আহলি কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কাফের তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ না আসা পর্যন্ত তারা (নিজেদের কুফরী থেকে) বিরত থাকতে প্রস্তুত ছিল না। অর্থাৎ আল্লাহ্র পক্ষ থেকে একজন রাসূল যিনি পবিত্র সহীফা পড়ে শুনাবেন, যাতে একেবারে সঠিক কথা লেখা আছে।” ২ নম্বর আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী ‘যারা কুফরী করে, যারা আহলে কিতাব ও মুশরিকদের দলের অন্তরভুক্ত। সূরা আল- বাইয়েনাহ-এর ৬ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে,“আহলি কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে তারা নিশ্চিতভাবে জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে।” এখানে কুফরী বলতে আল্লাহ্র নবী স.-কে মেতে নিতে অস্বীকার করা। অর্থাৎ মুশরিক ও আহলি কিতাবদের মধ্য থেকে যারা এই রাসূলের নবুওয়াত লাভের পর তাঁকে মানেনি।  
তাদের জন্য পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল বাকারাহ-এর ১৯-২০ নম্বর আয়াত প্রযোজ্য। সূরা আল বাকারাহ-এর ১৯-২০ নম্বর আয়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, “অথবা এদের দৃষ্টান্ত এই যে, আকাশ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। তার সাথে আছে অন্ধকার মেঘমালা, বজ্রের গর্জন ও বিদ্যুৎ চমক। বজ্রপাতের আওয়াজ শুনে নিজেদের মৃত্যুর ভয়ে এরা কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেয়। আল্লাহ্ এ সত্য অস্বীকারকারীদেরকে সবদিক থেকে ঘিরে রেখেছেন। বিদ্যুৎ চমকে তাদের অবস্থা এই হয়েছে যে, বিদ্যুৎ যেন অচিরেই তাদের দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নেবে। যখন সামান্য একটু আলো তারা অনুভব করে তখন তার মধ্যে তারা কিছুদূর চলে এবং যখন তাদের ওপর অন্ধকার ছেয়ে যায় তারা থমকে দাঁড়িয়ে যায়। আল্লাহ্ চাইলে তাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণরূপেই কেড়ে নিতে পারতেন। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছুর ওপর শক্তিশালী।” 
আহলি কিতাবীরা তাদের কিতাবের উপর ঈমান এনেছিল। কিন্তু আল্লাহ্র শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স.-এর উপর ঈমান আনেনি। পবিত্র কুরআনের উপর তাদের তাদের একীন নেই। সে কারণেই তারা জালিম, তারা আল্লাহ্র অবাধ্য। 
একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স.-এর উপর ওহী নাযিল হওয়ার পরে পূর্ববর্তী আমসানী কিতাবের কার্যকারীতা যে ভাবে স্থগিত হয়ে গেছে তেমনি ভাবে নতুন রাসূল আগমনের পরে পূর্ববর্তী নবীর কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে গেছে। যা মূলত স্থগিত হয়ে গেছে। উপরের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, যে সব আহলি কিতাবীরা পূর্ববর্তী নবীর উম্মত হিসেবে আল্লাহ্ তা’আলার একত্ববাদের উপর ঈমান এনেছিল তেমনি ভাবে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স.-এর প্রতি ঈমান আনলে, পবিত্র কুরআন মজিদের উপর একীন রাখলেই তাদের ইসলাম ধর্মের ধারা অব্যাহত থাকে। কিন্তু আল্লাহ্র রাসূল স.-কে এবং পবিত্র কুরআন মজিদকে অস্বীকার করে তাদের মুসলিম বলার বা তাদের ধর্ম ইসলাম বলার এখতিয়ার নেই। তেমনি এসব আহলি কিতাবীদের ধর্মগ্রন্থ মৌলিক অবস্থায় আছে কী না সেটাও ধর্তব্যের বিষয় নয়। তাদের ধর্মগ্রন্থ মৌলিক অবস্থায় থাকলেও পবিত্র কুরআন মজিদ নাযিল হওয়ার পরে পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থের কার্যকারীতা স্থগিত হয়ে গেছে। তবে আগের কিতাবের যেসব বিধান কোরআনের বিধানের সাথে মিল থাকবে ওগুলো কুরআনের বিধানের অন্তরভূক্ত বলেই গণ্য হবে। ফলে আহলি কিতাবী নারীদের সাথে উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর পুরুষের বিয়ে বৈধ হতে পারে কিনা ভেবে দেখা দরকার। (এবিষয়ে যুগের সম্মানিত ওলামায়ে কেরাম ও ফকিহগণের মতামত ব্যক্ত করে আমাদের সহযোগিতা করার জন্য সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি।)
আহলি কিতাবী ও উম্মতে মুহম্মদী স.-এর বিয়ের বিষয়টি মেনে নেয়া হলে ইসলাম যে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, এটি যে মানুষের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান এতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। কারণ ইসলাম শুধু আনন্দ উপভোগ করার জন্য বিয়ে শাদীর ব্যবস্থা করেনি। এর মাধ্যমে মানুষকে বেবিচার-অনাচার থেকে বাঁচিয়ে রাখা যেমন উদ্দেশ্য। তেমনি পরিশুদ্ধ সমাজ ব্যবস্থার জন্য খাঁটি অনুগত আল্লাহর (মুসলিম) বান্দা সৃষ্টি করাও উদ্দেশ্য। (পবিত্র কুরআন মজিদের ভাষায়) মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম আ. যেমনটি দোয়া করেছিলেন।  
আল্লাহ্ তা’আলা যেখানে ইহুদী ও নাসারাদের সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য নিষেধ করেছেন সেখানে আহলি কিতাবীদের সাথে উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর সাথে বিয়ের অনুমোদন বা বৈধতা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। বরঞ্চ তাদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করবে তারা তাদের দলে বলে স্বয়ং আল্লাহ ঘোষণা করেছেন পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল মায়েদাহ’এ। যাঁরা আহলি কিতাবী ও উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর মধ্যে বিয়ে বৈধ বলেন তাঁদের সূরা আল-মায়েদাহ-এর ৫১ নম্বর আয়াত এবং ৫ নম্বর আয়াত ও আয়াতের ব্যাখ্যা দৃষ্টির সামনে রাখার জন্য বিনীত অনুরোধ করব।  
এরপরেও কেউ আহলি কিতাবীদের সাথে উম্মতি মুহাম্মদী স.-এর বিয়ে বৈধ বলার অর্থ তা পবিত্র কুরআন মজিদের সাথে সাংঘর্ষিক ও আল্লাহ্র অবাধ্য আচরণ করা নয় কি? আল্লাহ্র অবাধ্যদের শাস্তি কী যাদের পবিত্র কুরআন মজিদ সম্পর্কে একটুও ধারণা রাখেন তারা ভাল ভাবেই জানেন।
বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য, পবিত্র কুরআন মজিদকে বুঝার জন্য আল্লাহ্ তা’আলা সবাইকে তওফীক দান করুন। আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে সাহায্য করুন। আল্লাহ্ আমাদের কবুল করুন। আমীন।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক।
islamcox56@gmail.com
           
  

রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৩

সমকামিতার শাস্তির দৃষ্টান্ত জর্ডানের মৃত সাগর

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে সমকামি বিয়ের অনুমোদন দিয়েছে ফেডারেল কোর্ট। এ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ১৩টি অঙ্গরাজ্যেও সমকামি বিয়ের অনুমোদন দিয়েছে। এই অঙ্গরাজ্যগুলো হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়া, কানেকটিকাট, দেলাওরি, লওয়া, মাইনী, মেরিল্যান্ড, ম্যাসাচুয়েট্স, মাইনিসুটি, নিউ হ্যামসায়ার, নিউ ইয়র্ক, রডি আইল্যান্ড, ভারমন্ট, ওয়াশিংটন ডিসি ও কলম্বিয়া। বলা যেতে পারে সমকামিদের অযৌক্তিক ও অসমর্থিত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এদিকে বিশ্বের যে ক’টি দেশের মধ্যে সমকামিতা আইন স্বীকৃতি পেয়েছে সেই সব দেশগুলো হচ্ছে যথাক্রমে- আর্জেটিনা, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, পর্তুগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেইন, সুইডেন ও উরুগুয়ে।
এদিকে ইসরাইলসহ আরো কয়েকটি দেশে সমকামিতা বৈধতা পেলেও তা কার্যকর করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি বাংলাদেশেও দুই নারী সমকামিতার খবর সংবাদপত্রে এসেছে।
সমকামি বল্লেই ব্যাপারটি অনুমান করতে কষ্ট হয় না। স্পষ্ট করে বলা যেতে পারে যে, পুরুষের সাথে পুরুষের বিয়ে, নারীর সাথে নারীর বিয়ে। যা সরাসরি আল্লাহ্র আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া। বলা যেতে পারে আল্লাহ্র সাথে যুদ্ধ করা। আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগ বলতে যাকে বুঝায় সেসময়ও সমকামিতা ছিল না। আইয়ামে জাহেলিয়া বলতে বুঝি আরবরা কন্যা শিশুকে জীবন্ত কবর দিত। আরবের কুরাইশরা, মুশরিকরা সরাসরি আল্লাহ্র নির্দেশ অমান্যকারী, তারা ছিল জালেম, তারা আল্লাহ্র তা’আলার একত্ববাদ ছেড়ে ৩৬০টি মূর্তির পূজা নিয়ে সদা ব্যস্ত থাকত। হালাল কি তারা চিনতো না। হারামের সাথে ছিল তাদের বসবাস। আল্লাহ্র আইন, আল্লাহ্র নির্দেশ অমান্যকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়কে আল্লাহ্ তা’আলা শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও কোন সম্প্রদায় তার থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করেনি। বরঞ্চ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ অমান্য করার জন্য প্রতিযোগিতা করেছে। আল্লাহ্র প্রেরিত নবী, রাসূল, ওহী, কিতাবকে তারা করেছে উপেক্ষা। এমনকি কোনো কোনো সম্প্রদায়ের লোকজন আল্লাহ্র প্রেরিত নবী, রাসূলকে হত্যা পর্যন্ত করেছে।
আদি মানব হযরত আদম আ.-কে সৃষ্টি করার পরেই আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর বাম পাশের পাজর থেকে একটি হাড় নিয়ে মা হাওয়াকে সৃষ্টি করেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’আলা নারীকে পুরুষের জন্য, আর পুরুষকে নারীর জন্য জীবন সঙ্গি হিসেবে নির্ধারিত করে দিয়েছেন। তাঁদের প্রজনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁদের সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধি অব্যাহত রাখেন। অথচ হযরত আদম আ. ও মা হাওয়ার পরবর্তীতে লাখ লাখ বছর পরে আল্লাহ্ তা’আলার এক নেক্কার বান্দা, আল্লাহ্র প্রেরিত রাসূল হযরত লূত আ.-এর কওমেরা আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ ও হযরত লূ আ.-এর উপদেশ উপেক্ষা করে নারীকে বাদ দিয়ে পুরুষের কাছ থেকে যৌন ক্ষুধা মেটাবার ঘৃণ্য মাধ্যমকে বেছে নেয়। যে পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ হারাম, অবৈধ, জাহেলিয়াত, আল্লাহ্র দ্রোহিতা।
এব্যাপারে পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আশ শু’আরার ১৬৫ নম্বর আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘তোমরা কি গোটা দুনিয়ার মধ্যে পুরুষদের কাছে যাও’। এই আয়াতের মাধ্যমে একথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, সমগ্র সৃষ্টিকুলের মধ্য থেকে তোমরা শুধুমাত্র পুরুষদেরকে বাছাই করে নিয়েছো নিজেদের যৌনক্ষুধা চরিতার্থ করার জন্য, অথচ দুনিয়ায় বিপুল সংখ্যক নারী রয়েছে। সূরা আশ শু’আরার ১৬৬ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘এবং তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে তোমাদের রব তোমাদের জন্য যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা পরিহার করে থাকো? বরং তোমরা তো সীমা-ই অতিক্রম করে গেছো।’ এই আয়াতের মাধ্যমে বলা হয়েছে, আল্লাহ্ তা’আলা এ নারীদের মধ্যে এ ক্ষুধা পরিতৃপ্তির যে স্বাভাবিক পথ রেখেছেন তা বাদ দিয়ে তোমরা অস্বাভাবিক পথ অবলম্বন করছো। এই জালেমরা নিজেদের স্ত্রীদেরকেও প্রকৃতি বিরোধী পথে ব্যবহার করতো। তোমাদের কেবলমাত্র এ একটি অপরাধ নয়। তোমাদের জীবনের সমস্ত রীতিই সীমাতিরিক্ত ভাবে বিগড়ে গেছে। কুরআন মজিদের অন্যান্য স্থানে তাদের এ সাধারণ অবস্থা এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ঃ সূরা আনকাবূতের ২৯ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, ‘তোমরা কি এমনই বিকৃত হয়ে গেছো যে, পুরুষদের সাথে সংগম করছো, রাজপথে দস্যুতা করছো এবং নিজেদের মজলিসে প্রকাশ্যে খারাপ কাজ করছো?’
হযরত লূত আ. যখন তাঁর সম্প্রদায়ের লোকজনকে এই অপকর্ম থেকে সরে এসে স্বাভাবিক অবস্থা গ্রহণের আহবান জানালে সম্প্রদায়ের অবাধ্য লোকেরা তাঁকে প্রকাশ্যে হুমকি দিল। সূরা আশ শু’আরার ১৬৭ নম্বর আয়াতে এই হুমকির কথা বর্ণিত হয়েছে এভাবে, ‘তারা বললো, “হে লূত! যদি তুমি এসব কথা থেকে বিরত না হও, তাহলে আমাদের জনপদসমূহ থেকে যেসব লোককে উচ্ছেদ করা হয়েছে তুমিও নির্ঘাত তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।”
সূরা আশ শু’আরার ১৭২ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘তারপর অবশিষ্ট লোকদের আমি ধ্বংস করে দিলাম।’ তার ধারাবাহিকতায় সূরা আশ শু’আরার ১৭৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘এবং তাদের ওপর বর্ষণ করলাম একটি বৃষ্টিধারা, যাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল তাদের ওপর বর্ষিত এ বৃষ্টি ছিলো অত্যন্ত নিকৃষ্ট।’ এই আয়াতের মাধ্যমে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে- এটা স্বাভাবিক পানির বৃষ্টি ছিল না, ছিল পাথরের বৃষ্টি। কুরআন মজিদের অন্যান্য স্থানে এ আযাবের যে বর্ণনা রয়েছে তাতে বলা হয়েছে, হযরত লূত আ. যখন আল্লাহ্র নির্দেশে রাতের শেষ প্রহরে ওই জনপদ ছেড়ে নিজের সন্তান-পরিজনদের নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেছেন তখন ভোরের আলো ফুটতেই সহসা একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটলো। একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প তাদের জনপদকে লণ্ডভণ্ড করে দিলো। একটি ভয়ংকর আগ্নেগিরির অগ্নুৎপাতের মাধ্যমে তাদের ওপর পোড়ামাটির পাথর বর্ষণ করা হলো। এবং একটি ঝড়ো হাওয়ার মাধ্যমেও তাদের ওপর পাথর বর্ষণ করা হয়েছে।
বাইবেলের বর্ণনাসমূহ, প্রাচীন গ্রীক ও ল্যাটিন রচনাবলী, আধুনিক ভূমিস্তর গবেষণা এবং প্রতœতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ থেকে আযাবের যে বর্ণনা জানা যায় তা হচ্ছে, মরু সাগরের দক্ষিণ ও পশ্চিমে যে এলাকাটি বর্তমানে একেবারেই বিরাণ ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে সেখানে বিপুল সংখ্যক পুরাতন জনপদের ঘর-বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। এগুলো প্রমাণ করে যে, এটি এক সময় ছিলো অত্যন্ত জনবহুল এলাকা। আজ সেখানে হাজার হাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত পল্লীর চিহ্ন পাওয়া যায়। অথচ বর্তমানে এ এলাকাটি আর তেমন শস্য-শ্যামল নয়। ফলে এ পরিমাণ জনবসতি লালন করার ক্ষমতা আর এর নেই। প্রতœতত্ত্ব বিশেষজ্ঞগণের ধারণা, খৃস্টপূর্ব ২৩০০ থেকে খৃস্টপূর্ব ১৯০০ সাল পর্যন্ত এটি ছিলো বিপুল জনবসতি ও প্রাচুর্যপূর্ণ এলাকা। আর হযরত ইবরাহীম আ.-এর আমল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের অনুমান, সেটি ছিলো খৃস্টপূর্ব দু’হাজার সালের কাছাকাছি সময়। এদিক দিয়ে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের সাক্ষ্য একথা সমর্থন করে যে, এ এলাকাটি হযরত ইবরাহীম আ. ও তাঁর ভাতিজা হযরত লূত আ.-এর সময় ধ্বংস হয়েছিল।
বাইবেল, পুরাতন গ্রীক ও ল্যাটিন রচনাবলী থেকে আরো জানা যায়, এ এলাকার বিভিন্ন স্থানে নাফাত (পেট্রোল) ও স্পল্টের কুয়া ছিলো। অনেক জায়গায় ভূগর্ভ থেকে অগ্নিউদ্দীপক গ্যাসও বের হতো। এখানে সেখানে ভূগর্ভে পেট্রোল ও গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়। ভূস্তর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অনুমান করা হয়েছে, ভূমিকম্পের প্রচণ্ড ঝাকুনীর সাথে পেট্রোল, গ্যাস ও স্পল্ট ভূ-গর্ভ থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে জ্বলে ওঠে এবং সমগ্র এলাকা ভস্মীভূত হয়ে যায়। বাইবেলের বর্ণনামতে, এ ধ্বংসের খবর পেয়ে হযরত ইবরাহীম আ. হিব্রোন থেকে এ উপত্যকার অবস্থা দেখতে আসেন। তখন মাটির মধ্য থেকে কামারের ভাটির ধোঁয়ার মতো ধোঁয়া উঠছিল। (আদিপুস্তক ১৯ঃ ২৮)।
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আন নামল এর ৫৪ ও ৫৫ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘আর লূতকে আমি পাঠালাম। স্মরণ করো তখনকার কথা যখন সে তার জাতিকে বললো, “তোমরা জেনে বুঝে এ কি অশ্লিল কাজ করছো? ৫৫. তোমাদের কি এটাই রীতি যে, কাম-তৃপ্তির জন্য তোমরা নারীদেরকে বাদ দিয়ে পুরুষদের কাছে যাও? আসলে তোমরা ভয়ানক মূর্খতায় লিপ্ত হয়েছো।”
লূত জাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল আ’রাফ ৮০-৮৪ নম্বর আয়াত, সূরা হূদ ৭৪-৮৩ নম্বর আয়াত, সূরা আল হিজর ৫৭-৭৭ নম্বর আয়াত, সূরা আল আম্বিয়া ৭১-৭৫ নম্বর আয়াত, সূরা আল আনকাবূত ২৮-৩৫ নম্বর আয়াত, সূরা আস সাফ্ফাত ১৩৩-১৩৮ নম্বর আয়াত, সূরা আল কামার ৩৩-৩৯ নম্বর আয়াতসমূহ নাযিল হয়েছে।
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা হূদ-এ হযরত লূত আ.-এর উম্মতগণের কাহিনী ও নবীদের বিরুদ্ধাচরণ করার কারণে তাদের উপর বিভিন্ন প্রকার আসমানী আযাব অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। আলোচ্য আয়াতসমূহে হযরত লূত আ. ও তাঁর দেশবাসীর অবস্থা ও দেশবাসীর উপর কঠিন আযাবের বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
হযরত লূত আ.-এর কওম একে তো কাফের ছিল, অধিকন্তু তারা এমন এক জঘন্য অপকর্ম ও লজ্জাকর অনাচারে লিপ্ত ছিল, যা পূর্ববর্তী কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে পাওয়া যায় নাই, বন্য পশুরাও যা ঘৃণা করে থাকে। অর্থাৎ, পুরুষ কর্তৃক অন্য পুরুষের সাথে যৌন সংগম বা মৈথুন করা। ব্যভিচারের চেয়েও ইহা জঘন্য অপরাধ। এ জন্যই তাদের উপর কঠিন আযাব অবতীর্ণ হয়েছে, যা অন্য কোন অপকর্মকারীদের উপর কখনো অবতীর্ণ হয় না।
হযরত লূত আ.-এর ঘটনা পবিত্র কুরআন মজিদের বিভিন্ন সূরার আয়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে, তা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা হযরত জিবরাঈল আ. সহ কতিপয় ফেরেশতাকে কওমে লূতের উপর আযাব নাযিল করার জন্য প্রেরণ করেন। যাত্রাপথে তাঁরা ফিলিস্তিনে প্রথমে হযরত ইবরাহীম আ.-এর সমীপে উপস্থিত হন।
আল্লাহ্ তা’আলার যখন কোন জাতিকে আযাব দ্বারা ধ্বংস করেন, তখন তাদের কার্যকলাপের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আযাবই নাযিল করে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও ফেরেশতাগণকে সুশ্রী নওজোয়ান রূপে প্রেরণ করেন। হযরত লূত আ. ও তাঁদেরকে মানুষ মনে করে তাদের নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন হলেন। কারণ মেহমানের আতিথেয়তা করা ইসলামেতো বটেই নবীর নৈতিক দায়িত্ব। পক্ষান্তরে দেশবাসীর কু-স্বভাব বা চরিত্র তাঁর অজানা ছিল না। উভয় সংকটে পড়ে তিনি স্বগতোক্তি করলেন, “আজকের দিনটি বড় সংকটময় দিন।”
আল্লাহ্ তা’আলা এ দুনিয়াকে আজব শিক্ষাক্ষেত্র বানিয়েছেন। যার মধ্যে তাঁর অসীম কুদরত ও অফুরন্ত হেকমতের ভুরি ভুরি নির্দশন রয়েছে। মূর্তিপূজারী আযরের গৃহে আপন অন্তরঙ্গ বন্ধু ইবরাহীম খলিলুল্লাহ্ আ.কে পয়দা তিনি করেছেন। হযরত লূত আ.-এর মত একজন বিশিষ্ট পয়গম্বরের স্ত্রী নবীর বিরুদ্ধাচরণ করে কাফেরদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করত। সম্মানিত ফেরেশতাগণ সুদর্শন নওজোয়ান আকৃতিতে যখন হযরত লূত আ.-এর গৃহে উপস্থিত হলেন, তখন তাঁর স্ত্রী সমাজের দুষ্ট লোকদেরকে খবর দিল যে, আজ আমাদের গৃহে এরূপ মেহমান এসেছেন।
হযরত লূত আ.-এর আশঙ্কা যথার্থ প্রমাণিত হল। যার বর্ণনা পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা হূদ-এর ৭৮ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “আর তাঁর কওমের লোকেরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে তাঁর (গৃহ) পানে ছুটে আসতে লাগল। পূর্ব থেকেই তারা কু-কর্মে তৎপর ছিল। লূত আ. বললেন, ‘হে আমার কওম, এ আমার কন্যারা রয়েছে, এরা তোমাদের জন্য অধিক পবিত্রতমা। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, এবং অতিথিদের ব্যাপারে আমাকে লজ্জিত করো না, তোমাদের মধ্যে কি কোন ভাল-মানুষ নেই’।”
এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, জঘন্য কু-কর্মের প্রভাবে তারা এতদূর চরম নির্লজ্জ হয়েছিল যে, হযরত লূত আ.-এর মত একজন সম্মানিত পয়গম্বরের বাড়িতে প্রকাশ্য ভাবে অবরোধ করেছিল।
হযরত লূত আ. যখন দেখলেন যে, তাদেরকে প্রতিরোধ করা দুষ্কর, তখন তাদেরকে দুষ্কৃতি হতে বিরত রাখার জন্য তাদের সর্দারদের নিকট স্বীয় কন্যাদের বিবাহ দেয়ার প্রস্তাব দিলেন। তৎকালে কাফের পাত্রের সাথে মুসলিম পাত্রীর বিবাহ-বন্ধন বৈধ ছিল। হুযুরে আকরাম হযরত মুহাম্মদ সা.-এর প্রাথমিক যুগ পর্যন্ত এ হুকুম বহাল ছিল। এ জন্যই হযরত নবী করীম সা. স্বীয় দুই কন্যাকে প্রথমে উতবা ইবনে আবু লাহাব ও আবুল আস ইবনে রবী’র কাছে বিবাহ দিয়েছিলেন। অথচ তারা উভয়ে কুফরী হালতে ছিল। পরবর্তীকালে ওহীর মাধ্যমে কাফেরের সাথে মুসলমান মেয়েদের বিবাহ হারাম ঘোষণা হয়।
হযরত লূত আ.-এর কথার অর্থ হল, তোমরা নিজের কদাকার হতে বিরত হও এবং ভদ্রভাবে কওমের কন্যাদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে বৈধভাবে স্ত্রীরূপে ব্যবহার কর।
অতঃপর হযরত লূত আ. তাদেরকে আল্লাহ্র আযাবের ভীতি প্রদর্শন করে বললেন, “আল্লাহকে ভয় কর” এবং কাকুতি-মিনতি করে বললেন, “আমার মেহমানদের ব্যাপারে আমাকে অপমানিত করো না।” তিনি আরো বললেন, “তোমাদের মাঝে কি কোন ন্যায়নিষ্ঠ ভাল মানুষ নেই? আমার আকুল আবেদনে যার অন্তরে এতটুকু করুণার সৃষ্টি হবে।”
কিন্তু তাদের মধ্যে শালীনতা ও মনুষ্যত্বের লেশমাত্র ছিল না। তারা একযোগে বলে উঠল, “আপনি তো জানেনই যে, আপানর বধূ-কন্যাদের প্রতি আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। আর আমরা কি চাই, তাও আপনি অবশ্যই জানেন।”
হযরত লূত আ. এক সংকটজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন। তিনি স্বতঃস্ফুর্তভাবে বলে উঠলেন- হায়, আমি যদি তোমাদের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী হতাম, অথবা আমার আত্মীয়-স্বজন যদি এখানে থাকত, যারা এই জালেমদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করতো, তাহলে কত ভালো হতো।
ফেরেশতাগণ হযরত লূত আ.-এর অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করে প্রকৃত রহস্য ব্যক্ত করলেন এবং বললেনÑআপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনার দলই সুদৃঢ় ও শক্তিশালী। আমরা মানুষ নই, বরং আল্লাহ্র প্রেরিত ফেরেশতা। তারা আমাদেরকে কাবু করতে পারবে না বরং আযাব নাযিল করে দূরাত্মা-দূরাচারদের নিপাত সাধনের জন্যেই আমরা আগমন করেছি।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত আছে যে, দুর্বৃত্তরা যখন হযরত লূত আ.-এর গৃহদ্বারে সমবেত হল, তখন তিনি গৃহদ্বার রুদ্ধ করেছিলেন। ফেরেশতাগণ গৃহে অবস্থান করছিলেন। আড়াল হতে দুষ্টদের কথাবার্তা শুনা যাচ্ছিল। তারা দেয়াল টপকে ভিতরে প্রবেশ করে কপাট ভাঙ্গতে উদ্যোগী হল। এমন সংগীন মুহূর্তে হযরত লূত আ. পূর্বোক্ত বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন। ফেরেশতাগণ তাঁকে অভয় দান করলেন এবং গৃহদ্বার খুলে দিতে বললেন। তিনি গৃহদ্বার খুলে দিলেন। হযরত জিবরাঈল আ. ওদের প্রতি তাঁর পাখার ঝাপটা দিলেন। ফলে তারা অন্ধ হয়ে গেল এবং পালিয়ে যেতে লাগল।
তখন ফেরেশতাগণ আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশক্রমে হযরত লূত আ.-কে বললেন, আপনি কিছুটা রাত থাকতে আপনার লোকজনসহ এখান থেকে অন্যত্র সরে যান এবং সবাইকে সতর্ক করে দিন যে, তাদের কেউ যেন পেছনে ফিরে না তাকায়, তবে আপনার স্ত্রী ব্যতীত। কারণ, অন্যদের উপর যে আযাব আপতিত হবে, তাকেও সে আযাব ভোগ করতে হবে।
কোনো কোনো বর্ণনায় আছে যে, তাঁর স্ত্রীও সাথে যাচ্ছিল। কিন্তু পাপিষ্ঠদের উপর আযাব নাযিল হওয়ার ঘটনাটা শুনে পশ্চাতে ফিরে থাকাল এবং কওমের শোচনীয় পরিণতি দেখে দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল। তৎক্ষণাৎ একটি প্রস্তরের আঘাতে সেও মারা গেল। যা এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
অতঃপর উক্ত আযাবের ধরন সম্পর্কে পবিত্র কুরআন মজিদে বর্ণিত রয়েছে, যখন আযাবের হুকুম কার্যকরী করার সময় হল, তখন আমি তাদের বসতির উপরিভাগকে নীচে করে দিলাম এবং তাদের উপর অবিশ্রান্তভাবে এমন পাথর বর্ষণ করলাম, যার প্রত্যেকটি পাথর এক এক জনের নামে চিহ্নিত ছিল।
বর্ণিত আছে যে, চারটি বড় বড় শহরে তাদের বসতি ছিল। ঐসব জনপদকেই কুরআন পাকের আয়াতে ‘মুতাফেকাত’ নামে অবিহিত করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলাহার নির্দেশ পাওয়া মাত্র জিবরাঈল আ. তাঁর পাখা উক্ত শহর চতুষ্টয়ের যমীনের তলদেশে প্রবিষ্ট করতঃ এমনভাবে মাহশূন্যে উত্তোলন করলেন যে, সবকিছু নিজ নিজ স্থানে স্থির ছিল। এমনকি পানি ভর্তি পাত্র হতে এক বিন্দু পানিও পড়ল না বা নড়ল না। মহাশূন্য হতে কুকুর জানোয়ার ও মানুষের চিৎকার ভেসে আসছিল। ঐসব জনপদকে সোজাভাবে আকাশের দিকে তুলে উল্টিয়ে যথাস্থানে নিক্ষেপ করা হল। তারা আল্লাহ্র আইন ও প্রাকৃতিক বিধানকে উল্টিয়ে ছিল, তাই এটা ছিল তাদের উপযুক্ত শাস্তি।
পবিত্র কুরআন মজিদের বক্তব্য অনুযায়ী হযরত লূত আ.-এর ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদসমূহ আজও আরব থেকে সিরিয়াগামী রাস্তার পার্শ্বে জর্দানের এলাকায় সমুদ্রের উপরিভাগ থেকে যথেষ্ট নীচের দিকে একটি বিরাট মরুভূমির আকারে বিদ্যমান রয়েছে। এর একটি বিরাট পরিধিতে বিশেষ এক প্রকার পানি নদীর আকার ধারণ করে আছে। এ পানিতে কোন মাছ, ব্যাঙ, ইত্যাদি জন্তু জীবিত থাকতে পারে না। এ জন্যেই একে ‘মৃত সাগর’ ও ‘লূত সাগর’ নামে অভিহিত করা হয়। অনুসন্ধানের পর জানা গেছে যে, এতে পানির অংশ খুব কম এবং তেল জাতীয় উপাদান অধিক পরিমাণে বিদ্যমান। তাই এতে কোন সামুদ্রিক জন্তু জীবিত থাকতে পারে না।
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আস সাজদাহ-এর ২১ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, “সেই ভয়ানক শাস্তির পূর্বে আমি এ দুনিয়াতেই (কোনো না কোনো) হালকা শাস্তির স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করাতে থাকবো, হয়তো তারা (নিজেদের বিদ্রোহাত্মক আচরণ থেকে) বিরত হবে।”
এখানে ‘ভয়ানক শাস্তি’ বলতে আখেরাতের শাস্তিকে বুঝানো হয়েছে। কুফরী ও ফাসেকীর অপরাধে এ শাস্তি দেয়া হবে, এর বিপরীতে ‘হালকা শাস্তি’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ অর্থ হচ্ছে, এ দুনিয়ায় মানুষ যেসব কষ্ট পায় সেগুলো। যেমন ব্যক্তিগত জীবনে কঠিন রোগ, নিজের প্রিয়তম লোকদের মৃত্যু, ভয়াবহ দুর্ঘটনা, মারাত্মক ক্ষতি, ব্যর্থতা ইত্যাদি। সামাজিক জীবনে ঝড়-তুফান, ভূমিকম্প, বন্যা, খরা, অনাবৃষ্টি, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, দাংগা, যুদ্ধ এবং আরো বহু আপদ-বিপদ, যা লাখো লাখো কোটি কোটি মানুষকে প্রভাবিত করে।
মূলতঃ এসব বিপদ আখেরাতের বিচারের মুখোমুখি হয়ে জাহান্নামে যাওয়ার তুলনায় কোনো বিপদ নয়। বরং আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে তার বান্দার জন্য সতর্ক সংকেত। মানুষকে সত্য জানাবার এবং বিভ্রান্তি দূর করার জন্য তা পাঠানো হয়। তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে যদি মানুষ দুনিয়াতেই নিজের বিশ্বাস ও কর্ম শুধরে নেয় তাহলে আখেরাতে আল্লাহ্ গুরুত্বর শান্তির মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন দেখা দেবে না।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বিগত ২রা জুন ২০১৩ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্যে এক ভয়াবহ টর্নেডোর নামে আসমানী গজব আঘাত করেছে। এতে প্রাণহানি ছাড়াও কোটি কোটি টাকার সম্পদ হানি হয়েছে। শুধু কি তাই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোথাও না কোথাও আসমানী গজব লেগেই আছে। এদিকে চলতি সপ্তাহে যুক্তরাজ্যে ভয়াবহ তাপদাহে প্রায় সাতশত মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। গতকাল চীনের গুয়াংজু প্রদেশে ভূমিকম্পে প্রাণহানি ছাড়াও হয়েছে সম্পদ হানি। এসব আসমানী গজব ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা এসব কিছুকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে আখ্যায়িত করি। প্রশ্ন আসে প্রকৃতি কী? এই প্রকৃতিকে কে নিয়ন্ত্রণ করেন? এসব প্রশ্নের একটি মাত্র উত্তর তা হচ্ছে প্রকৃতির একমাত্র নিয়ন্ত্রক লা-শরিক আল্লাহ্। এই বিশ্বভ্রমান্ডের আলো, বাতাস, পানি, আগুন, মাটি থেকে শুরু করে যা কিছু আছে তার সবই আল্লাহ্র নির্দেশে নিয়ন্ত্রিত। আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ ছাড়া একটি বালুও নড়ে না। মানুষ যে ধর্মেরই হোক না কেনো এই সত্যকে মানতে হবে। আমরা এই সত্যকে মানছি না বলেই দুনিয়াব্যাপী নেমে আসছে আসমানী গজব, আসমানী বালা-মুছিবত। মূলত আল্লাহ্র তা’আলার নির্দেশ, আহকাম অমান্য করার শাস্তি নেমে আসছে আকাশ থেকে বা পাতাল থেকে উপরের দিকে উঠে আসছে। এসব হালকা শাস্তির মাধ্যমে মানুষ সচেতন হলে, আল্লাহ্ ভীতি জাগলে, আল্লাহ্র আ’আলার একত্ববাদের প্রতি আস্থাশীল হলেই মঙ্গল। অন্যতায় পরকালে ভয়ানক শাস্তি অবধারিত।
সমকামিতার মতো ঘৃণিত ও জঘন্য কাজের ফলে সমাজে নেমে আসছে অস্থিরতা, ভেঙ্গে পড়ছে সামাজিক শৃংঙ্খলা। এক শ্রেণীর মানুষ দিন দিন গুমরাহ্ হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে সমকামিতার ফলে এইডস ছড়ানোর বিষয়টি দ্রুততর হচ্ছে। একই সাথে সিফিলিস, গনোরিয়াসহ অন্যান্য যৌন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা শতভাগ। অপরদিকে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য বংশ বৃদ্ধি থেমে যাচ্ছে।
সমকামিতার মত ভয়াবহ অপরাধের জন্য লঘু শাস্তি ও ভয়াবহ শাস্তি অবধারিত। হযরত লূত আ.-এর কওমকে পৃথিবীর বুকে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে তা মূলত একটি লঘু শাস্তি। পরকালে তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি। পৃথিবীর অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজন যাতে হযরত লূত আ.-এর কওম ধ্বংসের ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে সে জন্য পৃথিবীর বুকে শাস্তি প্রদান করা হয়। আল্লাহ্র অবাধ্য হওয়ার শাস্তি হিসেবে পৃথিবী থেকে আদ জাতি, সামুদ জাতি, ফেরাউন, হযরত নূহ আ.-এর কওমকে ধ্বংস করেছেন। আল্লাহ্ তা’আলা অবাধ্য ও জালিম বনি-ইসরাঈলের অবাধ্য লোকজনকে শুকর ও বানর বানিয়ে দিয়েছিলেন।
সবশেষে বলতে চাই, কিয়ামত প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর রা.-এর বক্তব্য হচ্ছে, যখন দুনিয়ার বুকে সৎকাজের আদেশ দেয়া ও অসৎকাজ থেকে বিরত রাখার মতো কোনো লোক থাকবে না তখনই কিয়ামত হবে। আসুন আল্লাহ্কে ভয় করি, আল্লাহ্র ভয়াবহ শাস্তি সম্পর্কে আস্থাশীল হয়ে আল্লাহ্ তা’আলার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করি। হযরত লূত আ.-এর সম্প্রদায়ের ধ্বংস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে চেষ্টা করি। আল্লাহ্ সবাইকে হেদায়ত দান করুন।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক।
islamcox56@gmail.com

শনিবার, ৬ জুলাই, ২০১৩

জ্বীনের দেশে কিছুক্ষণ


: মুহম্মদ নূরুল ইসলাম :

২০১২ সালের ২৩ আগস্ট বৃহস্পতিবার। পূর্ব সিদ্ধান্ত মতে ফজরের নামাজ শেষে নাস্তা সেরে যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বের হব। একই সাথে অচেনা কথিত জ্বীনের দেশে যাব। জ্বীনের দেশে নাকি পানির স্রোত উল্টো দিকে যায়, স্টার্ট না দিলেও গাড়ি চলে। বিষয়টি কেমন গা ছম ছম করা, এক অদৃশ্য ও অজানা আতঙ্ক। মনের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। শরীরের মধ্যে এক অজানা শিহরণ। কম-বেশি জ্বীনের কথা শুনেছি, পবিত্র কুর’আন শরীফে জ্বীনের কথা আছে। পবিত্র কুর’আনে ‘সুরা আল জ্বীন’ নামের একটি সুরাও আছে। সুরা আল জ্বীন পড়লেও তার অর্থসহ অন্যান্য বিষয় আমার জানা নেই। এসব বুঝার চেষ্টাও করিনি। কিন্তু জ্বীনের দেশের কথা শুনিনি। জ্বীনের অবয়ব দেখিনি। ফলে যে কোন মানুষের পক্ষেই এই অজানা রহস্য ভেদ করার এক প্রবল আগ্রহ থাকে, থাকবেই। রহস্য ভেদ করতে পারুক বা না পারুক সবাই একবার চেষ্টা করে দেখে। আমার মনের মধ্যেও সেই আকুতি। আগ্রহ নিয়েই অপেক্ষায় আছি কখন সকাল হবে। কখন নাস্তা সেরে জ্বীনের দেশে যাব।
আমি আর লিলি, লিলি মানে আমার স্ত্রী কবি হাসিনা চৌধুরী লিলি ২১ আগস্ট মঙ্গলবার আসরের নামাজের পরে পবিত্র আল-মদিনা আল-মনোয়ারায় যেসব স্থানে যিয়ারতের বিধান আছে সেসব জায়গায় গেছি, নামাজ আদায় করেছি, ঘুরে এসেছি। মসজিদে কুবা, মসজিদে কিব্লাতাইন, মাসজিদে ফাতাহ্সহ পাঁচ মসজিদ-এ নামাজ আদায় করেছি। দেখে এসেছি জঙ্গে ‘ওহুদ’। ওহুদ ময়দানে গিয়ে মুসলমানদের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর যোদ্ধা হযরত আমির হামজা’র কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়েছি। সাথে ছিল ভাতিজা শাহ আলম। আমরা ২১ আগস্ট’২০১২ মঙ্গলবার ভোর ৪টায় আল-মদিনা আল-মনোয়ারায় পৌঁছি। মদিনা মনোয়ারায় পৌঁছে হোটেলে উঠার আগেই পবিত্র মসজিদ-এ নব্বীতে ফজরের নামাজ আদায় করি। পরে আমরা হোটেলে উঠি। 
আল-মদিনা আল-মনোয়ারা নগরীর ধারেপাশেই অজ্ঞাত জ্বীনের দেশে যাব নসরুল্লাহ’র গাড়িতে করে। নসরুল্লাহ কক্সবাজারের ছেলে। সে মক্কা নগরীতে হারাম শরীফের পাশে ব্যবসা করে। নসরুল্লাহ নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছে। সে ড্রাইভার রাখেনি। বিদেশ-বিভুইয়ে ড্রাইভার রাখা আরেক ঝামেলা। নসরুল্লাহ ২২ আগস্ট বুধবার তার স্ত্রী আয়েশা ও তাদের একমাত্র দুগ্ধপোষ্য কন্যা ফারিয়াকে নিয়ে নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে সুদূর মক্কা শরীফ থেকে আল-মদিনা আল-মনোয়ারা’র মসজিদে নব্বীতে এসেছে। নসরুল্লাহ’র সাথে আমার দেখা হয় কাকতালীয় ভাবে। তাও পবিত্র মসজিদে নব্বিতে। ২২ আগস্ট আসরের নামাজ পড়ার জন্য আমি আর লিলি মসজিদে নব্বীতে প্রবেশ করেছি। ইতোমধ্যে লিলি মেয়েদের নামাজের নির্দিষ্ট স্থানে ঢুকে পড়েছে। আমি মসজিদের কম্পাউন্ড থেকে ভেতরে যাচ্ছি। ঠিক এসময় পেছন থেকে শুনতে পেলাম ‘আঙ্কেল, আঙ্কেল’ শব্দ। মসজিদে নব্বীতে বাংলা উচ্চারণে ‘আঙ্কেল’ শব্দ শুনলে স্বাভাবিক ভাবেই ফিরে থাকার কথা। আমিও কৌতুহলবশত পেছনে ফিরে তাকালাম। পেছনে ফিরে দেখলাম এক সুশ্রী যুবক। গায়ে সৌদি আরবের লম্বা জোব্বা। আমাকে ‘আঙ্কেল’ সম্বোধন করা ব্যক্তি সে যুবক কিনা আমি সন্দেহ পোষণ করলাম। ফর্সা, দোহারা গঠনের যুবক। তার শরীরের অবয়বে মনে হচ্ছিলÑ সে সৌদি আরবের বা মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশের বাসিন্দা। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের কোন যুবকের মুখ থেকে বাংলা উচ্চারণে ‘আঙ্কেল’ শব্দ বের হওয়া স্বাভাবিক নয়। আমার অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে সে বলে উঠলোÑ ‘আমি নসরুল্লাহ’। নসরুল্লাহ’র সাথে পূর্বে আমার দেখা হয়নি। তার সাথে পূর্বে আমার দেখা না হলেও কক্সবাজারে আমাদের পরিবারে তার আসা-যাওয়া আছে। সে সম্পর্কে আমাদের আত্মীয় হয়। নসরুল্লাহ্’র সাথে আমার বয়সের ব্যবধানটা একটু বেশি কিনা সেজন্যই তার সাথে আমার দেখা হয়নি। তবে সৌভাগ্যবশত সে আমাকে চিনে। সাথে তার স্ত্রী-কন্যাও রয়েছে। আলাপ পরিচয়ের পরে নসরুল্লাহ’র স্ত্রী আয়েশা মহিলাদের নামাজের নির্দিষ্ট জায়গায় ঢুকে পড়লো নামাজ আদায় করতে। আমি নসরুল্লাহ ও তার কন্যা ফারিয়াকে নিয়ে বাদশা ফাহাদ গেইট দিয়ে মসজিদে নব্বীতে প্রবেশ করলাম।
২৩ আগস্ট বৃহস্পতিবার ফজরের নামাজ শেষে নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-র রওজা মোবারক যিয়ারত শেষে বের হয়ে আমি আর নসরুল্লাহ গেলাম জান্নাতুল বাকী’তে। লিলি, আয়েশা এবং নসরুল্লাহ’র মেয়ে নিচে মসজিদে নব্বীর প্রাঙ্গনে রয়েছে। জান্নাতুল বাকী’তে শুয়ে আছেন নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পরিবারের সদস্য, সাহাবাবৃন্দ থেকে শুরু করে অনেক নিকটজন। যাঁরা মূলত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে ইসলামের খেদমতে এবং মুসরিকদের সাথে যুদ্ধ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় নিজেদেরকে ইসলামের জন্য উৎসর্গ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন, হযরত বিবি ফাতেমা (রাঃ), হযরত ইমাম হাসান (রাঃ),  হযরত ইমাম জয়নাল আবেদীন (রাঃ), হযরত ইমাম বাকের (রাঃ), রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর চাচা হযরত আব্বাস (রাঃ), রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অপর তিন কন্যা, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নয় স্ত্রী, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর চাচী, হযরত ইমাম মালিক (রাঃ), রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর শিশু পুত্র ইব্রাহিম, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দুধ-মাতা বিবি হালিমা, ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রাঃ)-এর নাম উল্লেখযোগ্য। তবে রাসূলুল্লাহ তনয়া হযরত বিবি ফাতেমা (রাঃ)‘র কবর জান্নাতুল বাকী’তে কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেকের মতে হযরত বিবি ফাতেমা (রাঃ)’কে তাঁর নিজের ঘরেই দাফন করা হয় যা বর্তমানে মসজিদে নব্বী’র অন্তর্ভুক্ত। অপর দিকে প্রথমাবস্থায় খোলাফায়ে রাশেদিনের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রাঃ) কবর ছিল জান্নাতুল বাকী’র বাইরে। পরবর্তীতে জান্নাতুল বাকী’কে সম্প্রসারণ করা হলে হযরত ওসমানের (রাঃ) কবর বর্তমান সীমানা প্রাচীরের অভ্যন্তরে চলে আসে। 
হযরত ওসমান (রাঃ)-এর কবর এবং তাঁর দাফন নিয়েও রয়েছে এক লোমহর্ষক কাহিনী। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ওফাতের পরে মুসলমানদের গৃহযুদ্ধের শিকার হযরত ওসমান (রাঃ)। ইসলামের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, বিদ্র্রোহীরা হযরত ওসমান (রাঃ)-এর বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখে। বাড়ি অবরুদ্ধ করে রেখে বিদ্রোহীরা হযরত ওসমান (রাঃ)-এর খলিফার পদ থেকে সরে যেতে আহবান জানান। তিনি পদত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। তাঁকে গোপনে মক্কা কিম্বা সিরিয়ায় চলে যাবার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়, কিন্তু তিনি মদিনা ছাড়তে রাজি হননি। যার ফলশ্রুতিতে বিদ্রোহীরা বাড়িতে প্রবেশ করে হযরত ওসমান (রাঃ)’কে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এসময় তিনি পবিত্র কুর’আন অধ্যয়নে রত ছিলেন। পবিত্র কুর’আন হযরত ওসমান (রাঃ)-এর পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হয়ে পড়ে। হযরত ওসমান (রাঃ)-এর মরদেহ তিনদিন এভাবে পড়ে থাকে। পরে বিদ্রোহীরা রাতের অন্ধকারে জান্নাতুল বাকী’র বাইরে তাঁকে দাফন করে। সে সময় জান্নাতুল বাকী’র বিস্তৃতি ছিল অনেক ছোট। সে কারণেই ইসলামের তৃতীয় খলিফার কবর জান্নাতুল বাকী’র প্রবেশ মুখে না হয়ে অনেক ভেতরে হয়েছে। বিষয়টি হতবাক করার মত।    
জান্নাতুল বাকী’তেও প্রচন্ড ভীড়। ভীড় ঠেলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দেখি সশস্ত্র লোকজন। যাঁরা মূলত দর্শনার্থী এবং জিয়ারতে আগত লোকজনকে নিয়ন্ত্রণ করছে, আবার কেউ শিরক করতে চাইলে তাতে বাধা দিচ্ছেন। অনেক হাজ্বী জান্নাতুল বাকী’তে গিয়ে কান্না-কাটি করে বুক ফাঁটিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খায় একই সাথে কবরে সেজদা করার চেষ্টা করে।  
জান্নাতুল বাকীতে দোয়া পড়ে আমি আর নসরুল্লাহ নিচে নেমে লিলি, আয়েশা এবং নসরুল্লাহ’র মেয়েকে নিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। নসরুল্লাহ তার স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে উঠেছে ঢাকা হোটেলের পাশে একটি হোটেলে। আমাদের হোটেল ছেড়ে আরো একটু উত্তর-পশ্চিম দিকে গেলেই নসরুল্লাহ‘র হোটেল পড়বে। তার হোটেলের নাম ‘দারুল আনসার’। ‘দারুল আনসার’ হোটেল মসজিদে নব্বীর খুব কাছেই। সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিটের পায়ে হাঁটা পথ। হোটেলে বসেই সকালের নাস্তা সারতে সারতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আমরা অপরিচিত জায়গায় যাব তাই একজন স্থানীয় গাইড প্রয়োজন। নসরুল্লাহ বললো, ‘এই হোটেল পরিচালনা করে রুমেল নামের এক ভদ্রলোক। তার বাড়ি চট্টগ্রামে। তিনি হোটেলটি ভাড়া নিয়ে পরিচালনা করছেন। পবিত্র মক্কা এবং মদিনা মনোয়ারার হারাম শরীফের চারপাশে যেসব হোটেল আছে তার মালিক সৌদি নাগরিক। পরিচালনার জন্য মালিকেরা এসব হোটেল বাৎসরিক ভিত্তিক ভাড়া দিয়ে দেয়। ভাড়া গ্রহণকারীদের মধ্যে বাংলাদেশী, পাকিস্তানী এমন কি ভারতীয়রাও রয়েছে। বাংলাদেশীদের মধ্যে বৃহত্তর চট্টগ্রামের লোকজন বেশি। নসরুল্লাহ বললো রুমেলের সাথে আমার পরিচয় আছে। তাঁকে বলেছি আমাদের সাথে যাবার জন্য, তিনি রাজি হয়েছেন।’
নাস্তা খাওয়া শেষ। আমরা রুমেলের অপেক্ষায়। মোবাইলে রুমেলের সাথে যোগাযোগ করা হলো। তিনি তখনও ঘুম থেকে উঠেননি। ফলে আমাদেরকে বিকল্প চিন্তা করতে হলো। তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নিয়েই যেতে হবে। হোটেলের ম্যানেজার তাঁর পরিচিত এক গাইডকে খবর দিলেন। দশ মিনিটের মধ্যেই তিনি হোটেলে উপস্থিত। আমরা উপর থেকে নিচে নেমেই দেখতে পেলাম হোটেলের অভ্যর্থনা কক্ষে বসে আছেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। বয়স আনুমানিক ৫০ থেকে ৬০ এর মধ্যে, সুগঠিত শরীর। পেশীতে টান ধরেনি। তিনি জন্মগত ভাবে পাকিস্তানী। অনেক দিন ধরে আল-মদিনা আল-মনোয়ারায় তার বসবাস। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। ইতোমধ্যে ভোরের স্নিগ্ধতা কেটে সূর্যের আলো বিকিরণ ছড়াতে শুরু করেছে। 
নসরুল্লাহ্ গাড়ি ড্রাইভ করছে। গাইড মোজাফ্ফর আহমদ রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছেন। সকাল ৯টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম ওহুদ প্রান্তরে। ওহুদ প্রান্তর ছিল আমাদের পরিচিত। আমি, লিলি দু’দিন আগেই ওহুদ প্রান্তর থেকে ঘুরে গেছি। ওহুদ প্রান্তরে গিয়ে যিয়ারত শেষে আবার বাংলায় লিখা সাইন বোর্ডটি পড়লাম। ভাল লাগলো সুদূর আল-মদিনা আল-মনোয়ারার ওহুদ প্রান্তরে বাংলা বর্ণে লেখা সাইন বোর্ড দেখে। সাইন বোর্ডে বাংলায় যিয়ারতের দোয়া লেখা। পাশাপাশি দু’টি সাইন বোর্ড। একটি বাংলা অপরটি আরবিতে। ডান পার্শ্বে রয়েছে আরবিতে লেখা সাইন বোর্ডটি। পৃথিবীর এত ভাষাভাষি মানুষের যাতায়াত ওহুদ প্রান্তরে। অন্য কোন ভাষার সাইন বোর্ড চোখে পড়লো না। আরবির পাশাপাশি শুধু বাংলা সাইন বোর্ড। গর্বে বুক ফুলে উঠলো। কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরের একটি বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক প্রান্তরে মাতৃভাষায় লেখা সাইন বোর্ড দেখলে কার না ভাল লাগে। 
গরম তেতে উঠার আগেই আমরা জ্বীনের দেশে যেতে চাই। সেভাবেই বলা হলো গাইডকে।  গাইড আমাদেরকে ওদিকে নিয়ে যেতে লাগলেন। গাইডের দেখিয়ে দেয়া রাস্তা ধরে নসরুল্লাহ গাড়ি চালাচ্ছেন। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি খেজুর বাগান। গাছে গাছে কাঁচাপাকা খেজুর ঝুলছে। কোন কোন গাছে পাকা খেজুরে দেয়া হয়েছে জাল। জাল পেঁচিয়ে পাকা খেজুর আটকে রাখা হয়েছে। এতে খেজুর যেমন নিচে পড়ছে না তেমনি ভাবে কোন পাখিও খেতে পারছে না। পাকা খেজুর দেখে জিহ্বায় জল এসে যাচ্ছিল। গাছে পাকা খেজুর দেখে শৈশবের দুরন্ত সময়ের কথা মনে পড়ে গেল। বাল্যকালে আমি, জেঠাতো ভাই মোবারক, ইলিয়াছ, ভাতিজা বাবুল, আমিন সবাই মিলে গ্রামের বাড়ির, পরিবারের এবং পড়শীদের পাকা আম, জাম, কলা, পেপে কাঁচা শসা, ডাব, নারিকেল, আঁখ কতই না গাছ থেকে ছিঁড়ে খেয়েছি। এসব ছিলো নেহায়েতই শৈশব-কৈশোরের দুরন্তপনা। কোন কোন সময় জেঠি, বয়োঃজ্যেষ্ঠরা বা গৃহকর্ত্রীরা বকাঝকা করলেও শিশুসুলভ আচরণের কারণে তা সিরিয়াসলি নিতো না। বর্তমানে গ্রামের মানুষের কাছ থেকে সে আচরণ কল্পনাও করা যায় না। যেতে যেতে গ্রামের চির পরিচিত দৃশ্য দেখে নষ্টালজিয়ায় ভুগছিলাম। 
রাস্তার উপর থেকে দেখা যাচ্ছিল খেজুর বাগানের ফাঁকে ফাঁকে পাকা দালানও। খেজুর বাগানের বেশ পেছনে পাহাড়ের সারি। রুক্ষ পাহাড়। পাথরের পাহাড়। পাথর আর পাথর। যাতে মাটির লেশমাত্রও নেই। সে পাহাড়ে নেই সবুজের টিকিটিও। তবে পাহাড়ের নিচে উপত্যকায় ধুধু বালিতে আরবের  কাঁটাযুক্ত গাছ আছে। সে গাছেও পাতার পরিমাণ কম। প্রায় ১৫ কিলোমিটার যাওয়ার পরে রাস্তার দু’পাশেই বিশাল বিশাল সাইন বোর্ড। সাইন বোর্ড জুড়ে রয়েছে সাদা মাছের ছবি। সাইন বোর্ডের লিখা আরবিতে। রাস্তা যথারীতি চার লেইন বিশিষ্ট। গাইড মোজাফ্ফরের কাছ থেকে জানতে চাইলামÑ সাইন বোর্ডে কি লিখা আছে। উত্তরে মোজাফ্ফর জানালেন, এখানে মাছের খামার। তার উত্তর শুনে আমার চোখ ছানা-বড়া। 
বলে কি মোজাফ্ফর!
সুদূর আরব দেশে, তাও আবার পাথরের রুক্ষ পাহাড়ের ঢালুতে, ধুধু মরুর বালিতে মাছের চাষ! সাইন বোর্ডে মাছের ছবি দেখে বিষয়টি কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু তা বাস্তবিকই মাছের চাষ তা অবাক করার মতো। রাস্তার দু’ধারেই বেশ কয়েকটি মৎস্য প্রকল্পের সাইনবোর্ড। মনে মনে ঈর্ষা কাতর হলেও ভাল লাগলো অন্তত আরবের মানুষ আরাম-আয়েশের দিন পেছনে ফেলে রেখে বাস্তবতার দিকে ধাবিত হচ্ছে ভেবে। গভীর নলকূপ দিয়ে পানি তুলে মাছের চাষ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বা অন্যদেশে যেভাবে মাছের খাঁচা তৈরি করে মাছ চাষ করা হচ্ছে মদিনাতেও সে দৃশ্য। মাছের খামারের পাশে সবুজের সমারোহ। বিভিন্ন সব্জির ক্ষেত। পিকআপ ভর্তি করে তা বাজারজাত করা হচ্ছে। এসব মাছের খামারে এবং সব্জি ক্ষেতেও রয়েছে বাঙালিদের হাত। বাংলাদেশের অনেক শ্রমিক সে সব প্রকল্পে শ্রম দিয়ে মরুভূমিকে সবুজে ভরিয়ে দিচ্ছে। সরকারি নির্দিষ্ট পোষাকে রাস্তার পাশের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করছে। দেখা গেলো এসব লোকজনও বাংলাদেশের। যারা আবর্জনা পরিষ্কার করে এদেশে তাদেরকে ‘বলদিয়া’ বলা হয়। তবে পবিত্র মক্কার বাবে ক্বাবা ও মদিনা মনোয়ারার মসজিদে নব্বীতে যারা পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে আছে তাদেরকে ‘বলদিয়া’ বলা হলেও বাংলায় কিন্তু তাদেরকে ‘সেবক’ বলা হয়। এই পবিত্র মসজিদদ্বয়েও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েক হাজার সেবক রয়েছে। 
সড়ক ধরে এগুতেই ডান দিকে সাইন বোর্ড দেখা গেল মদিনা বিমান বন্দরের। ডান দিকে আরেকটি রাস্তা টার্ন নিয়ে চলে গেছে। আমরা সোজাই চলতে লাগলাম। আরো প্রায় ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার যাওয়ার পরে দেখা গেলো রাস্তার পাশে পার্কের মতো স্থাপনা রয়েছে। সেখানে রয়েছে ছোটখাট স্থাপনা ও অবকাঠামো। খেলার জন্য রাইডারসহ বিভিন্ন উপকরণ। মোটর সাইকেল করে মরুর তপ্ত বালি উড়িয়ে খেলা করছে। উক্ত পার্কের উল্টো দিকে আরবের কাঁটাযুক্ত গাছের ফাঁকে লোকজন দাঁড়িয়ে অবসর নেওয়ার চেষ্টা করছে যদিওবা কিছু উত্তপ্ত বাতাস ছাড়া আর কিছু নেই। গাড়ি থেকেই চোখে পড়লো একটি পিকআপ দাঁড়িয়ে আছে। চারজন মানুষ দাঁড়িয়ে পানির বোতল রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে। গাইড মোজাফ্ফর গাড়ি থামাবার জন্য বললেন। গাড়ি থামার সাথে সাথে আমরাও গাড়ি থেকে নামলাম। আমরাও দেখলাম পানির বোতল রাস্তার উপরের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। যতই নিচের দিকে ঠেলে দিক না কেন কিন্তু বোতল ঠিকই উপরের দিকে গড়িয়ে যেতে থাকলো। বিষয়টি অবাক করার মতো। এসময় হঠাৎ শরীরের বিদ্যুতের শিহরণ বয়ে গেল। গাইড মোজাফ্ফর বললেন, এখান থেকেই জ্বীনের রাজ্য শুরু। গাইড বললেন, এই রাস্তাটি সামনে আরো দুই কিলোমিটার গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। সৌদি আরব সরকার অনেক চেষ্টা করেও এখানে আর রাস্তা করতে পারেনি। সৌদি আরবের বিভিন্ন এলাকায় বিশাল বিশাল পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করা হলেও এই ক্ষুদ্র পাহাড় কাটা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। দেখলাম পাহাড়গুলোর উচ্চতাও খুব বেশি নয়। হয়তো বা শ’দুয়েক ফুট উঁচু হবে। জ্বীনের দেশের রোমাঞ্চকর আকর্ষণে আমরা আরো সামনে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে বসলাম। গাইড মোজাফ্ফর বললেন, এই এলাকার নাম ‘আল ওয়াদিয়া’। এখানকার ‘হাদা’ পাহাড়গুলো হাদা পর্বতমালার অংশ। হাদা পর্বতমালা এখান থেকে শুরু করে তায়েফসহ অন্যান্য স্থানেও বিস্তৃত। ফলে এখানকার পুরো এলাকাকে লোকজন ‘আল-হাদা আল-ওয়াদিয়া’ বলে থাকে।   
গাইড মোজাফ্ফর আবারো বললেন, রাস্তার দু’পাশের পাহাড়ের দিকে লক্ষ্য করে দেখেন পাহাড়ের রং।  
আমরাও লক্ষ্য করলাম। রাস্তার দু’পাশের পাহাড়ের বিচিত্র রং। কোন পাহাড়ের রং কালচে, কোনটি লালচে, কোনটি হলদে, কোনটির রং সবুজাভ, কোনটি রং ধুসর। পাহাড়ের বিচিত্র রং দেখে আমরাও হতবাক। পাহাড় দেখতে দেখতে আমাদের গাড়ি রাস্তার শেষ প্রান্তে এসে গেল। রাস্তাটি ‘ইউ’ টার্ন নিয়ে আবার একই সড়কে পড়েছে। সামনে রাস্তা নেই। সামনে, ডানে ও বামে সেই বিচিত্র রং-এর উঁচু পাহাড়ের প্রাচীর। গাইড মোজাফ্ফর জানালেন এখানেÑ রাস্তা শেষ। আর সামনে যাওয়া যাবে না। এমনকি পায়ে হেঁটেও যাওয়া যাবেনা। সরকার রাস্তা তৈরি করতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু জ্বিন জাতি পাহাড় কেটে রাস্তা করতে দেয়নি বলে কথিত আছে। তাঁর কথা শুনে গাড়ি থেকে নামার জন্য ভরসা পেলাম না। এমনিতেই ভয়ে আমাদের অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেছে। দুরু দুরু বক্ষে আমরা সবাই দোয়া ইউনুস পাঠ করছিলাম। আবার যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে যায় এই আশংকা আমাদেরকে তাড়া করছিল। গাইড মোজাফ্ফর বলেই চলেছে, সরকার এই রাস্তাটি বন্ধ করে দিয়েছিল। বিগত দু’বছর আগে জ্বীন রাজ্যের রাস্তাটি সর্বসাধারণের জন্য খুলে দিয়েছে। এতে করে জ্বিনের রাজ্যের বিষয়টি সৌদি আরবের অনেক এলাকার লোকজনও জানে না। এমনকি খোদ মক্কা শরীফের লোকজনও। 
‘ইউ’ টার্ন নিয়ে নসরুল্লাহ গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিল। গাড়ির মাইল মিটারে দেখলাম আমরা ইতোমধ্যে ৪৫ কিলোমিটার সড়ক অতিক্রম করে এসেছি। গাড়ির স্টার্টের চাবি খুলে হাতে নিল। চাবি খুলে আমাদের সবাইকে দেখাল। গাড়ি নিউট্রাল করার সাথে সাথে গাড়ি চলতে লাগলো। নসরুল্লাহ্কে আমি বললাম গাড়ির ব্রেকে পা রাখার জন্য।
নসরুল্লাহ বললো, আঙ্কেল গাড়ি ব্রেক নিচ্ছে না।
আমি আবার নসরুল্লাহ্কে গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত রাখার জন্য বললাম।
নসরুল্লাহ আমাদেরকে অভয় দিয়ে বললো, গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত আছে। 
গাড়ির ব্রেকে পা রাখার পরে গাড়ি চলতে শুরু করল। গাড়ির গতি ক্রমে বাড়তে লাগলো। এক পর্যায়ে দেখলাম মাইল মিটারে গাড়ির গতি ১২০ কিলোমিটারের ঘরে। গাড়ির গতি যতই বাড়তে লাগলো ততই হৃদকম্পন বৃদ্ধি পেতে লাগলো। এ পর্যায়ে প্রচন্ড ভাবে ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল ভয়ের ঠেলায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। বিশেষ করে যখন দেখলাম যে, রাস্তার পাশে কয়েকটি গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে উল্টে পড়ে আছে। শুধু উল্টে পড়ে আছে বললে তো আর শেষ হয় না, বলা যায় দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। ফলে গাড়ির ভেতর যেসব যাত্রী ছিল তাদের কী অবস্থা ভাবতেই বুক শুকিয়ে গেল। 
মনে মনে ভয় পেলেও তা চেপে নসরুল্লাহকে আবার বললাম গাড়ির ব্রেকে পা রাখার জন্য এবং স্টিয়ারিং-এ হাত রাখতে। 
প্রতি উত্তরে নসরুল্লাহ একই কথা বললো। 
এসময় আমি নসরুল্লাহকে গাড়ির স্টিয়ারিং শক্ত হাতে ধরে রেখে রাস্তার উপরে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা করতে বললাম।
সে সম্মতি সূচক উত্তর দিল।
এক পর্যায়ে তিন কিলোমিটার সড়ক অতিক্রম করে (যেখানে পানির বোতল গড়িয়ে রাস্তার উজানে যাচ্ছিল সেখানে) গাড়ি ব্রেক নিল। 
আল্লাহ্ তা’আলাকে লাখো শুকরিয়া। গাড়ির ভেতরে আমি যেখানে ভয় পেয়েছি সেখানে অন্যরা ভয় পাবেনা তা ভাবাই যায় না। দেখা গেল মেয়েরা আরো বেশি ভয় পেয়েছে। তার নজির দেখা গেল। একটু এগুতেই নসরুল্লাহ্’র স্ত্রী আয়েশা‘র বমি ধরেছে। আয়েশা বয়সে এখনো ছোট। বয়স আনুমানিক ২০ বা ২২ হতে পারে। রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে আয়েশাকে বমি করার ব্যবস্থা করা হল। লিলি’ও যে ভয় পায়নি এমন নয়। ওখান থেকে হোটেলে পৌঁছে লিলি বললো তার খারাপ লাগছে। বুঝতে পারলাম ভয়ের কারণেই তার এ অবস্থা।                      
সকালে আমরা যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বের হবার সময় মসজিদে কুবা হয়ে এসেছি। মসজিদে কুবাতে আমরা নামাজ পড়েছি। এরপরেই ওহুদ ময়দান এবং পরে জ্বীনের দেশে। 
জ্বীনের দেশে যাওয়ার সময় প্রচন্ড মানসিক চাপের মধ্যে ছিলাম। ছিলাম প্রচন্ড উত্তেজিত। আলহামদুলিল্লাহ, সবার মধ্যে একটি ভয় কাজ করলেও মোটামুটি ভাবে ভালয় ভালয় ফিরে আসতে পেরেছি।
ইতোমধ্যে গরমও তেতে উঠেছে। এদিকে আয়েশা বমি করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, লিলিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এতে করে আর কোথাও যাবার চিন্তা বাদ দিলাম। গাইড মোজাফ্ফরকে ৫০ রিয়াল দিয়ে বিদায় করা হল।
গাড়িতে ফিরতে ফিরতে গাইড মোজাফ্ফর বলেছিলেন, কথিত আছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবদ্দশায় জিনের দেশে গিয়ে জিনদের ইসলামের প্রতি দীক্ষা দিতেন। কোন কোন জিন এসময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে পবিত্র ইসলাম ধর্মও গ্রহণ করেছেন। তিনি তার স্বপক্ষে কোন অকাট্য দলিল দেখাতে বা রেফারেন্স দিতে পারলেন না। তবে তিনি বললেন, মহাগ্রন্থ পবিত্র কুর’আনে ‘সুরা আল-জ্বিন’ নামের একটি সুরা আছে। ‘সুরা আল-জ্বিন’-এ আল্লাহ্তাআলা জ্বিনদের ব্যাপারে অনেক কিছু বলেছেন। 
‘সুরা আল-জ্বিন’ বেশ আগেই আমি পড়েছি। তবে পড়া থাকলেও তার অনুবাদ বা তার উপর কোন রকমের দখল বা গভীরতা না থাকার কারণে গাইড মোজাফ্ফরকে কিছু বললাম না। তিনি যা বলে গেলেন তার কোন প্রতি উত্তর করলাম না। তবে এটা ঠিক যে, পবিত্র কুর’আনের প্রায় শুরু থেকেই জ্বিন ও মানুষের কথা উল্লেখ রয়েছে। পবিত্র কুর’আনের সুরা আল ফাতিহা, সুরা আল বাক্বারাহ, সুরা হিজর, সুরা রহমান, সূরা ফালাক, সূরা নাসসহ বিভিন্ন সুরাতেই জ্বিনদের ব্যাপারে বর্ণনা আছে। মহাগ্রন্থ পবিত্র কুর’আনের সুরা আল ফাতিহা’র ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘বুদ্ধি ও অনুভূতির ক্ষেত্রে এ তারতম্যের জন্যই সমগ্র সৃষ্টিজগতের মধ্যে একমাত্র মানুষ ও জ্বিন জাতিকেই শরীয়তের হুকুম-আহকামের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। কারণ, সৃষ্টির এ দু’টি স্তরের মধ্যেই বুদ্ধি ও অনুভূতি পূর্ণ মাত্রায় দেয়া হয়েছে। কিন্তু, তাই বলে একথা বলা যাবে না যে, একমাত্র মানুষ ও জ্বিন জাতি ছাড়া সৃষ্টির অন্য কোন কিছুর মধ্যে বুদ্ধি ও অনুভূতির অস্থিত্ব নেই।’ 
পবিত্র কুর’আনের বিভিন্ন জায়গায় ‘মানুষ এবং জ্বিন জাতিকে বিবেকবান ও বুদ্ধিসম্পন্ন বলা হয়েছে’। সুরা আল বাক্বারাহ্ জ্বিন জাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে এভাবে, ‘শয়তান জান্নাত থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরে আদম (আঃ)-কে প্রতারিত করার জন্য কিভাবে আবার সেখানে প্রবেশ করল? কারণ, শয়তানের প্রবঞ্চনার জন্যে জান্নাতে প্রবেশের কোন প্রয়োজন নেই। কেননা, আল্লাহ্ পাক শয়তান ও জ্বিন জাতিকে দূর থেকে প্রবঞ্চনা ও প্রতারণা করার ক্ষমতা দিয়েছেন। একই সুরায় পরে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ্ পাক জ্বিন ও শয়তানকে বিভিন্ন আকার অবয়বে আত্মপ্রকাশের শক্তি দিয়েছেন। হতে পারে, সে এমন রূপ ধারণ করে সামনে এসেছিল যে, হযরত আদম (আঃ) বুঝতেই পারেননি যে, সে’ই শয়তান।’ একইভাবে সুরা আল বাক্বারাহ্ বলা হয়েছে, ‘কিন্তু যেহেতু পৃথিবীতে আগমনের মধ্যে আরও অনেক তাৎপর্য ও কল্যাণ নিহিত ছিল যেমন, তাঁদের বংশধরদের মধ্য থেকে ফেরেশতা ও জ্বিন জাতির মাঝে এক নতুন জাতি ‘মানব’ জাতির আবির্ভাব ঘটা, তাদের এক ধরনের কর্ম-স্বাধীনতা দিয়ে তাদের প্রতি শরীয়তী বিধান প্রয়োগের যোগ্য করে গড়ে তোলা, বিশ্বে খোদায়ী খেলাফত প্রতিষ্ঠা এবং অপরাধীর শাস্তি বিধান, শরীয়তী আইন ও নির্দেশনা প্রবর্তন।’ 
জ্বিন জাতি সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা সুরা আল-হিজর-এর ২৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন এভাবে, 
‘ওয়ালাক্বাদ খালাক্বনাল্ ইন্সা-না মিন্ ছ¦ালছ¦া-লিম্ মিন্ হামাইম্ মাসনূন।’
যার বাংলা অর্থ
‘আর অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুকনো ঠনঠনে কাল্চে কাদামাটি থেকে।’ 
সুরা আল-হিজর-এর ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে এভাবে, 
‘ওয়াল্জ্বান্না খালাক্বনা-হু মিন্ ক্বাবলু মিন্ না-রিস্ সামূম্।’ 
যার বাংলা অর্থ
‘আর ইতপূর্বে জিনকে সৃষ্টি করেছি উত্তপ্ত অগ্নিশিখা থেকে।’ 
পরবর্তীতে পবিত্র কুর’আনের সুরা আর-রাহমান-এ একই কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। সুরা আর-রাহমান-এর ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে এভাবে, 
‘খালাক্বাল্ ইন্সা-না মিন্ স্বাল্স্বা-লিন্ কাল্ ফাখ্খা-র।’ 
যার বাংলা অর্থÑ 
‘যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন শুষ্ক ঠনঠনে মাটি থেকে যা পোড়া মাটির ন্যায়।’ 
সুরা আর-রাহমান-এর ১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে এভাবে, 
‘ওয়া খালাক্বাল্ জ্বান্না মিম্ মা-রিজ্বিম্ মিন্ নার্-।’ 
যার বাংলা অর্থ
‘আর তিনি জিনকে সৃষ্টি করেছেন ধোঁয়াবিহীন অগ্নিশিখা থেকে।’ 
শুধু কি তাই, আল্লাহ তাআলা মহাগ্রন্থ পবিত্র কুর’আনের সুরা আয-যারিয়াত-এর ৫৬ নম্বর আয়াতে বর্ণনা করেছেন এভাবে,
‘ওয়ামা-খালাক্বতুল্ জিন্না ওয়াল্ ইন্সা ইল্লা-লিইয়া‘বুদূন।’ 
যার বাংলা অর্থ
‘আমার এবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জ্বীন জাতি সৃষ্টি করেছি।‘ 
তবে হ্যাঁ, পবিত্র কুর’আনের বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি, মানুষের আকৃতি আছে, মানুষকে দেখা যায়। জ্বীনদের আকৃতি নেই, জ্বীনদেরকে দেখা যায় না। তবে জ্বীন জাতি মানুষকে দেখতে পায়। মানুষের মধ্যে যেমন ভাল-খারাপ প্রকৃতির মানুষ রয়েছে ঠিক তেমনি ভাবে জ্বীনদের মধ্যেও ভাল-খারাপ আছে। মানুষের মধ্যে যেমন রয়েছে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী, তেমনি ভাবে জ্বিনদের মধ্যেও রয়েছে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী। পৃথিবীতে ভুরি ভুরি নজির আছে জ্বীনের সন্তানেরা মানুষের আকৃতি ধরে শিক্ষা গ্রহণ করতে। এ ঘটনা কক্সবাজারের বিভিন্ন মাদ্রাসাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ঘটেছে বলে রটনা রয়েছে। কিন্তু বিষয়টি কখনো স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। 
‘জ্বীন জাতি সম্পর্কে’ মহাগ্রন্থ পবিত্র কুর’আনে ‘সূরা আল-জ্বীন’-এর এক নম্বর ও দুই নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে এভাবে, 
‘কূল্ ঊহিয়া ইলাইয়্যা আন্নাহুস্ তামা’আ নাফারুম্ মিনাল্ জ্বিন্নি ফাক্বা-লূ-ইন্না-সামি’না-কুরআ-নান্ ‘আজ্বাবা। ইয়াহ্দী-ইলার রুশ্দি ফাআ-মান্না-বিহী; ওয়া লান্ নুশরিকা বিরাব্বিনা-আহাদা-।’ 
যার বাংলা অর্থ-
‘বলুনঃ আমার প্রতি ওহী নাযিল হয়েছে যে, জ্বীনদের একটি দল কুর’আন শ্রবণ করেছে, অতঃপর তারা বলেছে ঃ আমরা বিস্ময়কর কুর’আন শ্রবণ করেছি; যা সৎপথ প্রদর্শন করে। ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনও আমাদের পালনকর্তার সাথে কাউকে শরীক করব না।’ 
শুধু তাই নয়, জ্বীন জাতি সম্পর্কে পবিত্র কুর’আন মজিদের সূরা আহকাফ-এর ২৯, ৩০ ও ৩১ নম্বর আয়াতে বর্নিত রয়েছে এভাবে-
সূরা আহকাফ-এর ২৯-৩১ আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন,
‘ওয়া ইয্ স্বারাফ্না-ইলাইকা নাফারাম্ মিনাল জ্বিন্নি ইয়াস্তামি’ঊনাল্ কুর’আ-না, ফালাম্মা-হাদ্বারূহু ক্বা-লূ-আন্ছিতূ, ফালাম্মা-কুদ্বিয়া ওয়াল্লাও ইলা-ক্বাওমিহিম্ মুন্যিরীন। ক্বা-লূ ইয়া-ক্বাওমানা-ইন্না-সামি’না-কিতা-বান্ উন্যিলা মিম্ বা’দি মূসা-মুস্বাদ্দিক্বাল্ লিমা-বাইনা ইয়াদাইহি ইয়াহ্দী-ইলাল্ হাক্বক্বি ওয়া ইলা-ত্বারীক্বিম্ মুস্তাক্বীম। ইয়া-ক্বাওমানা-আজ্বীবূ দা-‘ইয়াল্লা-হি ওয়া আ-মিনূ বিহী ইয়ার্গ্ফিলাকুম্ মিন্ যুনূবিকুম্ ওয়া ইউর্জ্বিকুম মিন্ ‘আযা-বিন আলীম।’ 
যার বাংলা অর্থ 
‘স্মরণ কর, আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জিনকে, যারা কুর’আন তেলাওয়াত শ্রবণ করেছিল। যখন ওরা তার নিকট হাজির হল, ওরা পরস্পর বলতে লাগল, চুপ করে শোন। যখন পবিত্র কুর’আন তেলাওয়াত শেষ হল তখন ওরা তাদের সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে গেল এক একজন সাবধানকারীরূপে। এমন এক গ্রন্থের পড়া শুনেছি, যা নাযিল হয়েছে মূসা (আঃ) এর ওপর। এটি পূর্ববর্তী কিতাবকে সমর্থন করে এবং সত্য ও সরল পথের দিকে পরিচালিত করে। হে আমাদের জাতি! আমাদের দিকে আহ্বানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তার প্রতি ঈমান আন। আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন এবং মর্মন্তুদ শাস্তি থেকে তোমাদের বাঁচাবেন।’

জ্বীনদের স্বরূপঃ জ্বীন আল্লাহ তাআলার এক প্রকার শরীরী, আত্মাধারী ও মানুষের ন্যায় জ্ঞান ও চেতনাশীল সৃষ্টজীব। তারা মানুষের দৃষ্টিগোচর নয়। এ কারণেই তাদেরকে জ্বীন বলা হয়। জ্বীন-এর শাব্দিক অর্থ গুপ্ত। মানব সৃষ্টির প্রধান উপকরণ যেমন মৃত্তিকা, তেমনি জ্বীন সৃষ্টির প্রধান উপকরণ অগ্নি। এই জাতির মধ্যেও মানুষের ন্যায় নর ও নারী আছে এবং সন্তান প্রজননের ধারা বিদ্যমান আছে। কুর’আন পাকে যাদেরকে শয়তান বলা হয়েছে, বাহ্যতঃ তারাও জ্বীনদের দুষ্ট শ্রেণীর নাম। জ্বীন ও ফেরেশতাদের অস্তিত্ব কুর’আন ও সুন্নাহর অকাট্য বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। এটা অস্বীকার করা কুফর।-(মাযহারী)
সুরা জ্বীন অবতীর্ণের ঘটনা ঃ সহীহ্ বোখারী, তিরমিযী ইত্যাদি কিতাবে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, এই ঘটনায় রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জ্বীনদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে কুর’আন শোনাননি এবং তিনি তাদেরকে দর্শনও করেননি। এই ঘটনা তখনকার, যখন শয়তানদেরকে আকাশের খবর শোনা থেকে উল্কাপিণ্ডের মাধ্যমে প্রতিহত করা হয়েছিল। এ সময়ে জ্বীনরা পরস্পরে পরামর্শ করল যে, আকাশের খবরাদি শোনার ব্যাপারে বাধাদানের এই ব্যাপারটি কোন আকস্মিক ঘটনা মনে হয় না। পৃথিবীতে অবশ্যই কোন নতুন ব্যাপার সংঘটিত হয়েছে। অতঃপর তারা স্থির করল যে, পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম ও আনাচে-কানাচে জ্বিনদের প্রতিনিধিদল প্রেরণ করতে হবে। প্রতিনিধিদল যথাযথ খোঁজাখুঁজি করে এই নতুন ব্যাপারটি কী, তা জেনে আসবে। হেজাযে প্রেরিত তাদের প্রতিনিধিদল যখন মক্কা শরীফের অদূরে ‘নাখলা’ নামক স্থানে উপস্থিত হল, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবীগণকে সাথে নিয়ে ভোরে নামায পড়ছিলেন।
জ্বীনদের এই প্রতিনিধিদল নামাযে কুর’আন পাঠ শুনে পরস্পরে শপথ করে বলতে লাগলঃ এই কালামই আমাদের ও আকাশের খবরাদির মধ্যে অন্তরায় হয়েছে। তারা সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে স্বজাতির কাছে ঘটনা বিবৃত করল এবং বললঃ ‘ইন্না-সামি’না-র্কুআ-নান্ ‘আজ্বাবা-’ (অর্থÑঅতঃপর তারা বলেছেঃ আমরা বিস্ময়কর কুর’আন শ্রবণ করেছি) আল্লাহ্ তাআলা এসব আয়াতে সমস্ত ঘটনা সম্পর্কে তাঁর রাসূলকে অবহিত করেছেন। 
মক্কা বিজয়ের পরে তায়েফ জয় এবং ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সাহাবীদের নিয়ে হযরত রাসূলে করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অভিযান পরিচালনা করেন। তায়েফ বিজয়ের পরে মক্কা নগরীতে ফেরার পথে তিনি ‘নাখলা’ নামক স্থানে অবস্থান করে সাহাবীদের নিয়ে শেষরাত্রে তাহাজ্জুদের নামায শুরু করেন। সে সময় ইয়ামনের নছীবাইন শহরের জ্বীনদের একটি প্রতিনিধিদলও তখন সেখানে অবস্থানরত ছিলেন। তারা কুর’আন পাঠ শুনল এবং শুনে বিশ্বাস স্থাপন করল। অতঃপর তারা স্বজাতির কাছে ফিরে গিয়ে ঘটনা বর্ণনা করল। আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহ্ তাআলা তারই আলোচনা করেছেন।
জনৈক সাহাবী ও জ্বীনের ঘটনাঃ ইবনে জওযী (রহঃ) ‘আছ-ছফওয়া’ গ্রন্থে হযরত সহল ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি এক জায়গায় জনৈক বৃদ্ধ জ্বীনকে বায়তুল্লাহ্র দিকে মুখ করে নামাজ পড়তে দেখেন। সে পশমের জোব্বা পরিহিত ছিল। হযরত সহল (রাঃ) বলেনঃ নামায সমাপনান্তে আমি তাকে সালাম করলে তিনি জওয়াব দিলেন ও বললেন ঃ তুমি এই জোব্বার চাকচিক্য দেখে বিস্মিত হচ্ছ? জোব্বাটি সাতশ’ বছর ধরে আমার গায়ে আছে। এই জোব্বা পরিধান করেই আমি ঈসা (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাত করেছি। অতঃপর এই জোব্বা গায়েই আমি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দর্শন লাভ করেছি। যেসব জ্বীন সম্পর্কে ‘সুরা আল-জ্বীন’ অবতীর্ণ হয়েছে, আমি তাদেরই একজন। Ñ(মাযহারী)
হাদীসে বর্ণিত লায়লাতুল-জিনের ঘটনায় আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ইচ্ছাকৃতভাবে জ্বিনদের কাছে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে মক্কার অদূরে জঙ্গলে যাওয়া এবং কুর’আন শোনানো উল্লেখিত আছে। এটা বাহ্যতঃ সুরায় বর্ণিত কাহিনীর পরবর্তী ঘটনা। আল্লামা খাফফাযী বর্ণনা করেন, নির্ভরযোগ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আছে যে, জ্বিনদের প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে একবার দু’বার নয়- ছয় বার আগমন করেছিল। অতএব, সুরার বর্ণনা ও হাদীসের বর্ণনার মধ্যে কোন বৈপরিত্য নেই। 
জ্বিন জাতি যে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে এসে ইসলামের প্রতি দীক্ষা নিয়েছিলেন তার বর্ণনা রয়েছে সুরা আর-রাহমানে। সূরা আর-রাহমান কোথায় নাজেল (অবতীর্ণ) হয়েছে মর্মে এক ব্যাখ্যায় তিরমিযীতে হযরত জাবের (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কয়েকজন লোকের সামনে সমগ্র সুরা আর-রাহমান তেলাওয়াত করেন। তাঁরা শুনে নিশ্চুপ থাকলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ আমি ‘লায়লাতুল জ্বিনে’ (জ্বিন-রজনীতে) জ্বিনদের সামনে এই সুরা তেলাওয়াত করেছিলাম। প্রভাবান্বিত হওয়ার দিক দিয়ে তারা তোমাদের চেয়ে উত্তম ছিল। কারণ, আমি যখনই সুরার 
‘ফবে আইয়ে আলাহে রব্বাকাকুমা তোকাজ্জিবান’ 
যার বাংলা অর্থ- 
‘অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন্ কোন্ অনুগ্রহকে (কোন্ কোন্ অনুবাদক ‘অবদান’ শব্দ ব্যবহার করেছেন) অস্বীকার করবে? 
আয়াতটি তেলাওয়াত করতাম তখনই তারা সমস্বরে বলে উঠতঃ 
‘রব্বানা লা নুক্কাজ্জিবু বিশাইয়িন মন নেয়ামকা ফলাকাল হামদু‘ 
যার বাংলা অর্থ 
‘হে আমাদের পালনকর্তা। আমরা আপনার কোন অবদানই অস্বীকার করব না। আপনার জন্যেই সমস্ত প্রশংসা।’ 
এই হাদীস থেকে জানা যায় যে, সুরাটি মক্কায় অবতীর্ণ। কেননা, ‘জ্বিন-রজনী‘র ঘটনা মক্কায় সংঘটিত হয়েছিল। এই রজনীতে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জ্বিনদের কাছে ইসলাম প্রচার করেছিলেন এবং তাদেরকে ইসলামী শিক্ষা দান করেছিলেন। 
উপরে আলোচিত সুরা আল ফাতেহা, সুরা আল বাক্বরাহ্, সুরা হিজর, সুরা আল-জ্বিন ও সুরা আর-রাহমানের উদ্বৃতি এবং বর্ণনা থেকে আমাদের কাছে জ্বিন জাতি সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হয়। 
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক।
islamcox56@gmail.com

তথ্যসূত্র : 
১. পবিত্র কোরআনুল করীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), মূলঃ তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ ও সম্পাদনা : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, সউদী আরবের মহামান্য শাসকÑহারামাইনিশ্ শরীফাইন বাদশাহ ফাহ্দ ইবনে আবদুল আজিজের নির্দ্দেশে ও পৃষ্ঠপোষকতায় পবিত্র কোরআনের এ তরজমা ও সংক্ষিপ্ত তফসীর মুদ্রিত হলো। মুদ্রণ স্বত্ব : খাদেমুল হারামাইন শরীফাইন বাদশাহ ফাহদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প, কর্তৃক সংরক্ষিত। পো: বক্স নং-৩৫৬১ মদীনা মোনাওয়ারা।
২. আর রাহীকুল মাখতুম (রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) এর অনন্য সীরাত গ্রন্থ)-আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী, অনুবাদ-মাওলানা ওবায়েদুর রহমান ইবনে আবদুল্লাহ এম এম হাদীস ও ফিকাহ্ , ফাযেলে দারুল উলুম মইনুল ইসলাম, চট্টগ্রাম। প্রকাশক-মীনা বুক হাউস, ৪৫,বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০. তৃতীয় মুদ্রণ-মার্চ ২০১০। 
৩. আসাহ্হুস সিয়ার [রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর বিশুদ্ধ ও প্রামাণ্য জীবন চরিত]- আবুল বারাকাত আবদুর রউফ দানাপুরী (র.), অনুবাদ- মাওলানা আ. ছ. ম. মাহমুদুল হাছান খান ও মালানা আবদুল্লাহ বন সাঈদ জালালাবাদী, প্রকাশক ইসলামিক ফাউন্ডেশন। দ্বিতীয় সংস্করণ-সেপ্টেম্বর ২০১০, ঢাকা।
৪. বিশ্বনবী- গোলাম মোস্তফা, প্রকাশক-আহমদ পাবলিশিং হাউস, ৬৬ প্যারীদাস রোড়, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০, ছিচল্লিশতম মুদ্রণ-এপ্রিল ২০১০, ঢাকা।
৫. পবিত্র কোরআনে বর্ণিত পঁচিশ জন নবী ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)- মাওলানা মোঃ নজরুল ইসরাম এম এম,প্রকাশক-সাগর বুক ডিপো, ১৩, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।তৃতীয় প্রকাশ-এপ্রিল ২০০৭। 
1. History of Madina Munawwarah, by Shaikh Saifur Rahman Mubarakpuri, Translated by : Nasiruddin al-Khattab, Darussalam, Riyadh, Jeddah, Al-Khobar, Sharjah, Lahore, Londan, Houston, New York.  Second Edition : April 2004.




একাত্তরের স্মৃতি



একাত্তর বলতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির স্বাধিকার। একখণ্ড স্বাধীন মাটি। একটি লাল সবুজ খচিত পতাকা। পৃথিবীর ইতিহাসে একটি পৃথক মানচিত্র। একাত্তর আমাদের অহংকার। বাঙালি জাতি হিসেবে পৃথিবীতে অহংকার করার মত আমাদের যেসব উপলক্ষ আছে, তৎমধ্যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ অন্যতম। পৃথিবীতে খুব কম দেশই আছে স্বাধীকার আদায়ের জন্য, দেশের বিজয়ের জন্য এত রক্ত ঝরিয়েছে।    
বাংলাদেশের এই অর্জনের জন্য পাক-হায়েনাদের বুলেটের আঘাতে এদেশের পিচঢালা নিকষকালো রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। বাংলাদেশের নদীর পানি হয়েছে লালে লাল। বাংলাদেশের শ্রেষ্ট সন্তান স্বাধীনতার শহীদদের রক্ত নদী-উপনদী হয়ে ছড়িয়ে গেছে সমগ্র দেশে, মিশে গেছে বঙ্গোপসাগরে, ভারত মহাসাগরে, সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন মহাসাগরে। বলা যেতে পারে পৃথিবীর প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরেই সেই রক্তের প্রবাহ মিশে রয়েছে। বাংলাদেশের এই লাল সবুজ খচিত পতাকার জন্য ৩০ লাখ শহীদ তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে। পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের লালসার শিকার হয়ে দুই লাখ মা-বোন তাদের ইজ্জত হারিয়েছে।  

দুই.
‘ম’তে মমতাময়ী। মমতাময়ী বল্তেই বোঝায় ‘মা’। ‘ম’ আর ‘আ’তে ‘মা’ হয়। মা’তে মা, মাটি, মাতৃভূমি। তিনটি শব্দই একই সূত্রে গাঁথা। ‘মা’ গর্ভধারীণী, মমতাময়ী। ‘মাটি’ থেকেই আমাদের জন্ম এবং আবার মাটিতেই ফিরে যেতে হবে। মাটির দেহ মাটিতেই মিশে যাবে। আর ‘মাতৃভূমি’ বা দেশ সেতো সবার উপরে, সবার ভালবাসার একমাত্র সম্পদ। দেশকে ভালবাসতে পারার মধ্যে যে অনাবিল আনন্দ, তৃপ্তি তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। তার উল্টো পিঠে রয়েছে মাতৃভূমিকে ভালবাসতে না পারার দুঃখবোধ-বেদনা, তা বুঝানো যাবে? যারা মাতৃভূমিকে ভালবাসতে পারেনি তারা তৃপ্তি বা সুখ কি জিনিস বুঝতে পারেনি এবং বুঝতে পারবেও না। আমার খুব সৌভাগ্য মাতৃভূমিকে শত্রু মুক্ত করতে স্বাধীনতার যে যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, গেরিলা যুদ্ধ হয়েছে তা প্রত্যক্ষ করতে পেরেছি। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও এতে নিজেও অংশ নিতে পেরেছি। আমাদের এই যুদ্ধ ছিল দেশের জন্য গভীর আত্মত্যাগের। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ গভীর আত্মত্যাগের ইতিহাস, অবিশ্বাস্য সাহস ও বীরত্বের ইতিহাস এবং বিশাল এক অর্জনের ইতিহাস। যখন কেউ এই আত্মত্যাগ, বীরত্ব আর অর্জনের ইতিহাস জানবে, তখন সে যে শুধুমাত্র দেশের জন্যে গভীর ভালোবাসা আর মমতা অনুভব করবে তা নয়, এই দেশ, এই মানুষের কথা ভেবে গর্বে তার বুক ফুলে উঠবে। এখনই সময় আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে জানান দেবার, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার।

তিন.
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা বিজয়ের কথা বলার পূর্বে পূর্ববর্তী কিছু ইতিহাস বলা দরকার। দরকার চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত আন্দোলন, সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের ধারা বর্ণনা। 
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ শত্রু মুক্ত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এদেশ শাসন করেছে পাকিস্তান, তারও আগে ব্রিটিশ তথা ইংরেজরা। তার আগে ব্রিটিশ বেনিয়াদের মুখোশে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী। ১৭৫৭ সালে এদেশ ব্রিটিশ বেনিয়ার দখলে চলে যায়। তারা শাসন-শোষণ করেছে প্রায় দুইশ’ বছর। বেনিয়া ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠে আন্দোলন-সংগ্রাম, বিদ্রোহ। স্বাধীনতাকামী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রাম বন্ধ করতে, মানুষকে দাবিয়ে রাখতে হাজার হাজার মানুষকে করা হয় অন্তরীণ, দেয়া হয় দীপান্তরের নামে কালাপাইন্যা। কালাপাইন্যা মূলতঃ নির্জন স্থানে স্থানান্তরের নাম। সেসময় স্বাধীকার আন্দোলনকারীদের বর্তমান ভারতের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে পাঠিয়েও তাদের তখ্ত-তাউস নিরাপদ রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর, লক্ষ তাজা প্রাণের বিনিময়ে ব্রিটিশ বেনিয়ারা এদেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশ বেনিয়ারা এদেশ থেকে চলে গেলেও তাদের ষড়যন্ত্রের চিহ্ন রেখে যায়। ১৯৪০ সালে ‘লাহোর প্রস্তাব’-এ ঠিক করা হয়েছিল ভারতবর্ষের যে অঞ্চলগুলোতে মুসলমান বেশি, সেরকম দুটি অঞ্চলকে নিয়ে দুটি দেশ এবং বাকি অঞ্চলটিকে নিয়ে আর একটি দেশ তৈরি করা হবে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যে এলাকা দুটিতে মুসলমান ধর্মাবলম্বী বেশি সেই এলাকা দুটি নিয়ে ভিন্ন দেশ না হয়ে পাকিস্তান নামে একটি দেশ এবং ১৫ আগস্ট বাকি অঞ্চলটিকে ভারত নামে অন্য একটি দেশে ভাগ করে দেয়া হল। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও অবশেষে পশ্চিম পাকিস্তান নামের অংশের শাসকেরা আমাদের পূর্ব পাকিস্তান নামের অধিবাসী বাঙালিদের উপর জুলুম, নির্যাতন, নির্বতন, শোষন শুরু করে। ছিল বঞ্চনার ইতিহাস। এমনকি আমাদের মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে উদ্যোগী হয়। পাকিস্তান নামে পৃথিবীতে অত্যন্ত বিচিত্র একটি দেশের জন্ম হয়, যে দেশের দুটি অংশ দুই জায়গায়। যে দেশের মানুষ একটি ভাষায় কথা বলেনা। পাকিস্তানের অধিবাসীদের নিজেদের রয়েছে পৃথক পৃথক ভাষা, পৃথক সংস্কৃতি, পৃথক কৃষ্টি, পৃথক ঐতিহ্য। দেশের দুটি অংশের মধ্যখানে একটি ভিন্ন স্বাধীন দেশ। বেনিয়া ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে ভাগ করার সময় বাংলা ভাষাভাষি কলকাতার বাঙালি, আসামের বাঙালি ও বার্মার আরাকান রাজ্যের মুসলমানদেরকে ভিন্ন একটি দেশে অন্তর্ভূক্ত করে দেয়। এটাই ছিল বেনিয়া ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।
পাকিস্তান নাম দিয়ে যে দেশটি সৃষ্টি করা হয় তা পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান নাম দেওয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তান বলতে আমাদের প্রাণ প্রিয় বাংলাদেশকে বুঝানো হয়।
পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্ব ছিল, ছিল একটি বিশাল রাজ্য-ভারত। দুটি পৃথক অংশ নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি করা হলেও দুটি অংশের মানুষের ভেতরেও ছিল বিশাল দূরত্ব। তাদের চেহারা, ভাষা, খাবার, পোষাক-পরিচ্ছদ সবকিছু ছিল ভিন্ন, শুধু মাত্র একটি বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ট মানুষগুলোর মাঝে মিল ছিলÑ তা হলো ধর্ম। পূর্ব পাকিস্তানের সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুদের সংখ্যাও কম ছিল না। তবে তাদের ভাষা ছিল বাংলা। এরকম একটি বিচিত্র দেশ কিভাবে টিকে থাকে। দেশভাগের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল দুই কোটি আর পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল চার কোটি। কাজেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ বাঙালি হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বিশ্বাস ছিল শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, পুলিশ-মিলিটারি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সবকিছুতেই বাঙালিরা অগ্রাধিকার পাবে। সরকারি চাকুরিতে যদি একজন পশ্চিম পাকিস্তানের লোক থাকে, তাহলে সেখানে দুইজন পূর্ব পাকিস্তানের লোক থাকবে। কিন্তু বাস্তবে হলো ঠিক তার উল্টো। সবকিছুতেই পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগ ছিল অত্যধিক বেশি। পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভাগ ছিল ৮০ থেকে ৯০ ভাগ। বাজেটের ৭৫ ভাগ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে, আর মাত্র ২৫ ভাগ ব্যয় হতো পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু রাজস্ব আয় বেশি ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে, যার পরিমাণ ৬২ ভাগ। সবেচেয়ে ভয়ংকর ও ভয়াবহ তথ্য ছিল সেনাবাহিনী নিয়োগের ক্ষেত্রে। সেনাবাহিনী নিয়োগের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানি বা বাঙালি নিয়োগের সংখ্যার তুলনায় উর্দু ভাষাভাষি পাকিস্তানী নিয়োগের পরিমাণ ছিল ২৫ গুণ বেশি। সেনাবাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানি ছিল পাঁচ লাখ, আর পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালি ছিল মাত্র ২০ হাজার।
চার.
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দেশ ভাগ হওয়ার পর থেকেই ঊর্দু ভাষাভাষি পশ্চিম পাকিস্তানিরা দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে বসবাসকারি বাঙালিদের উপর বিভিন্ন ভাবে নিপীড়ন করতে থাকে। সর্বশেষ ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা এসে ঘোষণা করলেন একমাত্র ঊর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ভারতীয় বংশো™ভুত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দেশের সংখ্যা গরিষ্ট মানুষের মুখের ভাষার কোন তোয়াক্কাই করলেন না। ফলে তার ঘোষণার সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা তীব্র প্রতিবাদ করে বিক্ষোভ শুরু করে। মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দেশে। আন্দোলন থামাতে ঢাকার রাজপথে পুলিশ নামানো হয়। এক পর্যায়ে পুলিশ ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি বর্ষণ করে। এতে রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরো অনেকে তাজা প্রাণ রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। ভাষার জন্য ঢাকার রাজপথে রক্ত ঝরার পরেই ছাত্র-জনতার আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়। এসব আন্দোলনে কলকারখানা থেকে শ্রমিকেরাও এসে যোগদান করে। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন, রক্ত ঝরার নজির পৃথিবীতে তার আগে ছিল না। বাঙালি তরুণ ছাত্র-জনতা পৃথিবীর বুকে সেই নজির স্থাপন করলেন। তাজা প্রাণ কেড়ে নেওয়ার পরেও সেই আন্দোলনকে থামানো যায়নি। ঊর্দূ ভাষাভাষি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যেখানে আমাদের ভাষার দাবীতে শহীদদের রক্ত ঝরেছিল সেখানে রাতারাতি নির্মিত হলো আমাদের প্রিয় শহীদ মিনার। তার আদলেই সারা দেশেই গড়ে উঠেছে শহীদ মিনার। সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রাণপ্রিয় শহর কক্সবাজার এবং আমাদের নাড়িকাটা গ্রাম ঈদগাঁতেও নির্মাণ করা হয় শহীদদের স্মৃতিবহনকারী মিনার। শুরু হলো ভাষা শহীদদেরকে শ্রদ্ধা নিবেদন করার সংস্কৃতি। আজ ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব। এটি এখন আমাদের ঐতিহ্য। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের এখন ভাষা দিবস। দিবসটি এখন শুধু বাংলাদেশের জন্যে নয়, এখন সারা পৃথিবীর মানুষের জন্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাই দিনটি এখন বিশ্বব্যাপী ভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। ১৯৯৯সালেই কয়েকজন বাঙালি যুবকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জাতিসংঘ দিবসটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

পাঁচ.
পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রনের একমাত্র কর্ণধার হলো সেনাবাহিনী। পাকিস্তানের ঊর্দূ ভাষাভাষি সেনাবাহিনী গোড়া থেকেই পাকিস্তানে শাসনের নামে এক ধরনের ষড়যন্ত্র শুরু করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাষ্ট্রক্ষমতাকে বরাবরই তাদের নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্যে সচেষ্ট ছিল। দেশের বাজেটের ৬০ ভাগ ব্যয় করা হতো সেনাবাহিনীর পেছনে, তাই তারা তাদের অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধার লোভনীয় জীবন বেসামরিক মানুষের হাতে ছেড়ে দিতে কোন অবস্থাতেই প্রস্তুত ছিল না। ফলে তারা রাজনীতিকে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করতো। নানারকম তালবাহানা করে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে ১৯৫৮ সালে নির্বাচিত সরকারকে উৎখ্যাত করে পাকিস্তানের সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। ক্ষমতার মোহে তিনি সবকিছু ভুলে গিয়েছিলেন। ক্ষমতাকে তিনি পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিলেন। দীর্ঘ এগার বছর তিনি ক্ষমতার মসনদে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকেও রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছিল। তবে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা কোন বেসামরিক ব্যক্তির হাতে অর্পণ করেননি। ক্ষমতা অর্পণ করেছিলেন তার দোসর আরেক ঊর্দিপরা পাকিস্তানের সেনা প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে। 
ছয়.
দেশে সামরিক শাসন, বাঙালিদের উপর বিভিন্ন রকমের বঞ্চনা, নির্যাতন, কাজেই পূর্ব পাকিস্তানী বাঙালিরা সেটি খুব সহজেই মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড়ো রাজনৈতিক দল ছিল আওয়ামী লীগ। বাঙালির বঞ্চনার ইতিহাস, নির্যাতনের ইতিহাস, বৈষম্যের ইতিহাস তুলে ধরে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণা করেন। ছয় দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সব রকমের অর্থনৈতিক শোষণ, বঞ্চনা আর নিপীড়ন থেকে মুক্তির একমাত্র দলিল। এই ছয় দফা ছিল এক রকমের পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ব শাসনের দলিল। পূর্ব পকিস্তানের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ছয় দফা দাবি ঘোষণার সাথে সাথেই পাকিস্তানি স্বৈরাচারি সরকার বাঙালিদের উপর নির্যাতনের স্টীম রুলার চালাতে শুরু করে। শুরু করে ব্যাপক ধর-পাকড়। আওয়ামী লীগের ছোট বড় নেতাসহ দেশ প্রেমিক লোকজনকে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে দেশদ্রোহিতার একটি মিথ্যা মামলায় প্রধান আসামি করা হয় এবং তাঁকে জেলে পুরে দেয়া হয়। পাকিস্তানী স্বৈরশাসকেরা বলতে লাগলো ছয় দফা মানে পাকিস্তানকে ভাগ করার পায়তারা। অখণ্ড পাকিস্তানের নামে স্বৈরশাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দিল, তেড়ে নিল জনজীবনের শান্তি।
পাকিস্তানীদের ধর-পাকড়ের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা আবার শুরু করল আন্দোলন। সারাদেশ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় জ্বলে উঠলো। জেল-জুলুম, পুলিশ, ইপিআর-(পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস্)-এর গুলি, কিছুই বাকি থাকল না। কিন্তু সেই আন্দোলনকে দমানো গেল না, থামানো গেল না। বাঙালিদের উপর যতই নির্যাতন, নিবর্তন, জেল-জুলুম বাড়তে লাগল আন্দোলন ততই বেগবান হতে লাগল। আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে গেল ছাত্রদের নিয়ন্ত্রনে। ছাত্ররা এর আগেই এগার দফা দাবি ঘোষণা করেছে। বাঙালিদের বৈষম্যের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হল পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনার কাগজমিলে উৎপন্ন হয় কাগজ। সে কাগজ পশ্চিম পাকিস্তানে বিক্রি হচ্ছিল প্রতি দিস্তা (২৫ পিচ কাগজে এক দিস্তা) ছয় আনা আর পূর্ব পাকিস্তানে এক দিস্তা কাগজ বিক্রি হয় বার আনা। এতে ছাত্র-জনতা ক্ষোভে ফুঁসে উঠলো। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন জেলের বাইরে, তিনিও এগিয়ে এলেন। দেখতে দেখতে সেই আন্দোলন একটি গণবিস্ফোরণে রূপ নিলÑ কার সাধ্যি একে থামায়? ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে প্রাণ দিয়েছিল ফুটফুটে কিশোর মতিউর রহমান, প্রাণ দিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদ। যার নামে রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরের প্রবেশ পথের আইয়ুব গেটের নাম পরিবর্তন করে ‘আসাদ গেট’ করা হয়। পাকিস্তান সরকার শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব নেতাকর্মীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হল। শুধু তাই নয়, প্রবল পরাক্রমশালী প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতা দিয়ে দীর্ঘ এগার বছর পরে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ বিদায় নিল।   
সাত.
জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করেই পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন দেবার ঘোষণা করে। সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর। এতে করে পূর্ব পাকিস্তানের লোকজন আশান্বিত হয়ে উঠে। সাধারণ নির্বাচন যতই এগিয়ে আসতে লাগলো পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যকার চাপা আনন্দ উচ্ছ্বাস আকারে দেখা দেল। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানীদেরকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার কিছু দিন পর অর্থাৎ ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসে। এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়েই দশ লক্ষ মানুষ আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যায়। সে রকম দুর্যোগ পৃথিবীতে খুব কমই হয়েছিল। ঘুর্ণিঝড়ের আঘাতে একসাথে এত বনি আদমের প্রাণহানি এর আগে কোথাও হয়নি। পুরো উপকূল ঘুর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। দশ লক্ষ মানুষ মারা গেল, পুরো উপকূল কবরস্থানে পরিণত হলো, পুরো উপকূল বিধ্বস্থ হলো কিন্ত পাকিস্তানের স্বৈর শাসকেরা সাহায্যের হাত নিয়ে বাঙালিদের কাছে এগিয়ে আসল না। ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকার মানুষ যারা বেঁচে ছিল তারাও ধুকে ধুকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। অনেকেই মারা গেল খাদ্যের অভাবে, পান করার জন্য বিশুদ্ধ পানি না পেয়ে। ঘূর্ণিঝড় কবলিত অসহায় মানুষের প্রতি পাকিস্তানী শাসকদের অনিহা ও অবহেলা দেখে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ক্ষোভে-দুঃখে ফুঁঁসে উঠলো। সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালিরা পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া এবং উর্দু ভাষাভাষি পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটালো। প্রচণ্ড ক্ষোভে, দুঃখে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এসময় ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত উপকূলের মানুষের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে সাধারণ নির্বাচন বন্ধ রাখার দাবি জানান। কিন্তু স্বৈরশাসকেরা মনে করেছিল নির্বাচন হলে তাদের তল্পিবাহক এবং পাকিস্তানপন্থি মুসলিমলীগ, নেজামে ইসলাম পার্টি, পাকিস্তান পিপলস পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়ী হবে। ক্ষুব্ধ হয়ে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক জনসভায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবার ঘোষণা দেন এবং একই সাথে পাকিস্তানীদেরকে ‘আস্সালাসু আলাইকুম’ জানিয়ে দেন। এই ‘আসসালামু আলাইকুম’ই শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানীদের জন্য বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে দেয় এবং পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক করে বাঙালিদের আবাসভূমি ‘বাংলাদেশ’ সৃষ্টির মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। 
বাঙালির প্রচণ্ড অনাগ্রহ ও অনিহার মধ্যেও ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হলো পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। অত্যন্ত সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল দেখে পাকিস্তানী স্বৈরাশাসক ও পাকিস্তানের ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। নির্বাচনের ফলাফলে পাকিস্তানী স্বৈরশাসকের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। পাকিস্তানী সেনা শাসকসহ পশ্চিম পাকিস্তানীদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। সাধারণ নির্বাচনের ভোট গণনার পরে দেখা গেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়ে বিজয়ী হয়েছে। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে জয়ী হয়। যখন সকল আসনে নির্বাচন শেষ হলো তখন দেখা গেল, মনোনীত মহিলা আসনসহ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন, পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি-পিপিপি ৮৮টি আসনে বিজয়ী হয়েছে। অন্যান্য সব দল মিলে পেয়েছে অবশিষ্ট ৫৮টি আসন। পাকিস্তান পিপলস্ পার্টিসহ অন্যান্য আসনে বিজয়ী দলগুলো এলাইয়েন্স করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো ছাড়া পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের হাতে আর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের হাতে তো ক্ষমতা দেওয়া যায় না। এসময় পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বলাবলি করতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের ‘জলদাসেরা কী প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসনে বসবে’? উর্দু ভাষাভাষি পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তথা বাঙালিদেরকে জলদাসই মনে করতো। তাই বাঙালিদেরকে সিংহাসনে বসতে দেয়া যায় না। 
কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী সেনাশাসকদের পরিষ্কার করে বলে দিলেন যে, ‘আমি ছয় দফার কথা বলে জনগণের কাছ থেকে ভোট নিয়েছি। শাসনতন্ত্র রচনা করতে হবে ছয় দফার ভিত্তিতে, দেশ শাসিত হবে ছয় দফার ভিত্তিতে।’ পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া এবং পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকেরা শুরু করলো ষড়যন্ত্র। তাদের ষড়যন্ত্রের একমাত্র বিষয়, কিভাবে বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দেয়া না যায়। তাদের এই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পাকিস্তান নামের অখণ্ড রাষ্ট্রের কবর রচিত হলো।
আট.
পাকিস্তানি সেনাশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান সিদ্ধান্তই নিয়ে নিলেন বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে না। কিন্তু কিভাবে তা বাস্তবায়ন করবে তার জন্য কলাকৌশল অবলম্বন করতে হবে। তার এসব কলাকৌশল বাস্তবায়নের একমাত্র নির্ভরযোগ্য সহযোগি হিসেবে পাওয়া গেল সেনাশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের একসময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান পিপিপি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে সাথে নিয়ে কলকব্জা নাড়তে লাগলো। 
ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র চলতে থাকলেও জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাইরে তা বাঙালিদের বুঝতে দিল না। ১৯৭১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করলো ৩ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। সমগ্র বাঙালি জাতি সেই দিনটির অপেক্ষায় থাকলো। বাঙালি জাতির সাথে বিশ্ববাসীও গভীর আগ্রহে সেই দিনের প্রতিক্ষায় থাকল।
দেখতে দেখতে মার্চ এসেই গেল। এর মধ্যেই বাঙালির অন্যতম অহংকারের দিন একুশে ফেব্রুয়ারি। বাঙালির ভালোবাসা এবং মমতার শহীদ দিবস উদযাপিত হলো অন্য বারের তুলনায় ভিন্ন আমেজ এবং ভিন্ন উন্মাদনা নিয়ে। সমগ্র দেশের শহীদ মিনারে মানুষের ঢল নামে। সকল বাঙালির হৃদয়ের অভ্যন্তরে প্রোতিত স্বপ্ন একটি, আর সেটি হচ্ছে এবার পাকিস্তান শাসন করবে বাঙালিরাই। কিন্তু স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া তা আর হতে দিল না। জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের ঘোষিত তারিখের ঠিক দুই দিন আগে ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিল। এতে করে বাঙালিরা নিরাশ হয়ে পড়ল। দগ্ধ হতে লাগলো ক্ষোভের আগুনে। সেই ক্ষোভ হচ্ছে পেয়ে হারানোর ক্ষোভ। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের বুকের ভেতর ক্ষোভের যে বারুদ জমা হয়ে ঘনিভুত হয়েছিল, সেখানে যেন অগ্নিস্ফূলিঙ্গ স্পর্শ করল। সারাদেশে বিক্ষোভের যে বিস্ফোরণ ঘটল তার কোনো তুলনা নেই। সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পাকিস্তান নামের দেশকে ছারখার করে দিল, পাকিস্তানী ক্ষমতালিপ্সু স্বৈরশাসকদের সিংহাসন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভষ্মিভূত করে দিল। 
নয়.
পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ার ঘোষণাটি যখন রেডিওতে প্রচার করা হয়, তখন ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের সাথে কমনওয়েলথ একাদশের সাথে খেলা চলছে। রেডিও’র ঘোষণা শোনার পরে মুহূর্তের মধ্যে জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, ঢাকা স্টেডিয়াম হয়ে ওঠে একটি রণক্ষেত্র। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, দোকান-পাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ রাজপথে নেমে আসে, পুরো রাজধানী ঢাকা শহর দেখতে দেখতে একটি মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়ে যায়। মানুষের মুখে তখন উচ্চারিত হতে থাকে স্বাধীনতার স্লোগান : ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে পাঁচ দিনের জন্যে হরতাল ও অনির্দিষ্টকালের জন্যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। সেই অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে পাকিস্তান সরকারকে কোনো ভাবেই সাহায্য না করার জন্য বাঙালিদের প্রতি আহবান জানালেন। তাঁর সেই ঘোষণায় সারা পূর্ব পাকিস্তান অচল হয়ে গেল। অবস্থা বেগতিক দেখে বাঙালিকে নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে কারফিউ জারি করল। কিন্তু ছাত্র-জনতার সেই বাঁধ ভাঙ্গা আন্দোলন, স্বাধীনতার মন্ত্রে উচ্ছ্বসিত বাঙালিকে থামাতে কারফিউ যথেষ্ট ছিল না। তাই ছাত্র-জনতা কারফিউ ভেঙে রাজপথে নেমে আসল। চারিদিকে বাঁধভাঙ্গা মানুষের মিছিল, গগণবিদারী স্লোগান আর বিক্ষোভ। পাকিস্তানী সেনারা মিছিল থামাতে গুলি ছুড়ল, মানুষ মারা যাচ্ছে কিন্তু রাস্তা ছেড়ে জনতা ঘরে ফিরল না। বরঞ্চ পাকিস্তানিদের বর্বরতা দেখে শিশু-কিশোরসহ সর্বস্তরের মানুষ ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসল।
২ মার্চ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে ছাত্র সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু’র ভিপি আ স ম আবদুর রব বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করলেন। এসময় ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নূরে আলম ছিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন ও শাহজাহান সিরাজ। যাঁরা পরবর্তীকালে চার খলিফা নামে খ্যাত হন।  
৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় জাতীয় সংগীত হিসেবে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি নির্বাচন করা হল।
পাঁচদিন টানা হরতালের পর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভা। ছাত্র, জনতা, শ্রমিক, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ সর্বস্তরের মানুষ রেসকোর্স ময়দানে ছুটে আসল। জনতার উপস্থিতি পুরো ময়দান ছাড়িয়ে হোটেল শেরাটন পর্যন্ত পৌঁছে গেল, অপর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড় ছাড়িয়ে তিন নেতার মাজার পর্যন্ত পৌঁছে গেল। জনসভা নয়, যেন জনসমুদ্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই জনসভায় ভাষণ দিতে এলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। যাঁর যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করুন।’ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি দেশের মানুষকে (মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক মানুষ ছাড়া) ঐক্যবদ্ধ করে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অকাতরে প্রাণ দিয়ে দেশকে স্বাধীন করার শক্তি জোগায়।

দশ.
একাত্তরে পাক বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরেরা অনেক কিছু করেছে। যা আমরা এখনো ভুলতে পারিনি। পাকি বাহিনীর ক্ষতের চিহ্ন এখনো রয়েছে দেশের সর্বত্র। সেসব ক্ষত এখনো শুকায়নি। পাক বাহিনীর সেই সব ক্ষতস্থানে গড়ে ওঠেছে বধ্যভূমি, স্মৃতিসৌধ। আমাদের কক্সবাজার শহরের প্রধান বধ্যভূমি সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন প্রাক্তন রেস্ট হাউসের সামনে। যেখানে বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৭ ইঞ্জিনিয়ানস্ ব্যাটালিয়ন-ইসিবি-এর ছাউনি স্থাপন করা হয়েছে। সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা মনে হলে গা শিউরে উঠে। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের নির্মমতা হিটলার-মুসলিনির অত্যাচারকেও হার মানায়। বিশেষ করে দেশের তৃণমূলীয় জনপদে তাদের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন এখনো মানুষের মুখে মুখে ফিরে। আমার নাড়িকাটা গ্রাম ঈদগাঁতে মুক্তিকামী সর্বস্তরের মানুষসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর পুঁড়িয়ে দিয়েছে মুহুর্তের মধ্যে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর পুঁড়িয়ে তাঁদেরকে উচ্ছেদ করা হয়। বসতবাড়ি গুড়িয়ে দিয়ে তাঁদের আটক করে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়। 

এগার.
১৯৭১ সাল থেকে ২০১৩ সাল। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে। 
১৯৭১ সালে আমি এস এস সি পরীক্ষার্থী। কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। সত্তর-এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্টতা অর্জন করে। সঙ্গত কারণেই বাঙালিরা খুশিতে আত্মহারা। বিশেষ করে যারা বঙ্গবন্ধুর অনুসারি, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতা, কর্মী, সমর্থক সবাই। এছাড়াও খুশিতে আত্মহারা হয়েছিলো আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী, সমর্থক এর বাইরে একটি বিশাল সমর্থক (ঝরষবহঃ াড়ঃবৎং) গোষ্ঠী। আমাদের কক্সবাজার নির্বাচনী এলাকার জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এডভোকেট নূর আহমদ। তিনি প্রাক্তন নেজামে ইসলামী পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা, পিডিপি’র অন্যতম কর্ণধার, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক কক্সবাজারের গৌরব মৌলভী ফরিদ আহমদকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। নির্বাচনের এই ধরনের ফলাফলে দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যারা দেশের জোতদার, জমিদারদের নিত্য নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হতো তারাও খুশি হয়েছিলো। ছাত্রলীগের একজন সক্রিয়কর্মী হিসেবে আমাদের দল আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ায় আমরাও ছিলাম আন্দদিত ও উত্তেজিত। তারও কারণ ছিলো।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির-পিডিপি প্রধান জনাব ফরিদ আহমদ (মাদ্রাসা শিক্ষা গ্রহণ না করেও যিনি মৌলভী ফরিদ আহমদ নামেই সমধিক পরিচিত)-এর পৈত্রিক নিবাস ছিলো রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের (বর্তমান রশিদ নগর ইউনিয়ন) মাছুয়াখালী গ্রামে। মাছুয়াখালী গ্রামটি ছিলো মগ তথা রাখাইন সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত। মাছুয়াখালী গ্রামের কিছু অংশ ঈদগাঁও ইউনিয়নভুক্ত। আমার পৈত্রিক নিবাস ঈদগাঁও ইউনিয়নের (বর্তমান জালালাবাদ ইউনিয়ন) দক্ষিণ লরাবাক গ্রাম। দক্ষিণ লরাবাক গ্রামসহ বৃহত্তর ঈদগাঁও ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামেই ছিলো মৌলভী ফরিদ আহমদের আত্মীয় স্বজন। ঈদগাঁও ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন পোকখালী। পোকখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব মোহাম্মদ আমিন প্রকাশ আমিন মিয়া (বর্তমানে প্রয়াত) ছিলেন মৌলভী ফরিদ আহমদের ভগ্নিপতি। সম্পর্কে আমার দাদা, ঈদগাঁও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের দীর্ঘ দিনের শিক্ষক জনাব আবদুর রহমান (বর্তমানে প্রয়াত) ছিলেন মৌলভী ফরিদ আহমদের নিকট আত্মীয়। আমার জেঠাতো ভাই সবার মেঝদা জনাব মাস্টার মমতাজ উদ্দিন আহমদ বিএবিটি (বর্তমানে প্রয়াত) ছিলেন মৌলভী ফরিদ আহমদের ছাত্র। ফলে পুরো এলাকায় এবং আমাদের পরিবারেও মৌলভী ফরিদ আহমদের প্রভাব ছিলো অত্যন্ত বেশি। এলাকার মানুষ হিসেবে মৌলভী ফরিদ আহমদের প্রতি ছিলো সাধারণ মানুষেরও সহানুভূতি। বিশেষ করে জোতদার, জমিদার এবং তাদের অধীনস্থ বর্গাচাষী এবং সুবিধাভোগী মহল। এছাড়াও এলাকার বয়স্ক শ্রেণীর লোকজন মৌলভী ফরিদ আহমদের সমর্থক ছিলেন। এলাকার সর্বস্তরের মানুষ মৌলভী ফরিদ আহমদকে সমর্থন করলেন একমাত্র কারণে, তিনি এলাকার লোকজনকে বুঝাতে সক্ষম হলেন যে, নৌকা প্রতীকে ভোট দিলে পাকিস্তান ভেঙে যাবে। ‘আপনারা যদি অভিন্ন পাকিস্তান চান তা হলে নৌকা প্রতীকে ভোট দেবেন না। শেখ মুজিব পাকিস্তান চায় না। নৌকা প্রতীকে ভোট দিলে পাকিস্তান থাকবে না।’ এলাকার লোকজন পাকিস্তান ভাঙতে চায় না। তারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে নিপীড়িত, নিগৃহীত ও বঞ্চিত হলেও পাকিস্তান ভাঙতে চায়না। এর একমাত্র কারণ ছিল এলাকার লোকজন অল্প শিক্ষিত ও অশিক্ষিত। অশিক্ষিত মানুষ তো আর বুঝতে পারছে না কিভাবে তারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে লাঞ্চিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত হচ্ছে। মোদ্দা কথা, এসব কারণে পুরো এলাকার সর্বাধিক মানুষ ছিলো মৌলভী ফরিদ আহমদের কর্মী, নয়তো সমর্থক। এটা ছিলো বাইরের দৃশ্য। কিন্তু ভেতরের দৃশ্য ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। জোতদার, জমিদার, গুটি কয়েক সুবিধাভোগী চেয়ারম্যান-মেম্বার ছাড়া সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন ছিলো বঙ্গবন্ধুর প্রতি, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার প্রতি। আমার দাদার বিশাল পরিবারে আমি আর বাবুল (নাসির উদ্দিন বাবুল। বাবুল আমার বড় জেঠা জনাব আবদুল শুকুরের মেঝ ছেলে জনাব মাস্টার মমতাজ উদ্দিন আহমদ, বিএবিটি’র বড় ছেলে। আমাদের ভাতিজা। তবে আমরা সম বয়সী ছিলাম বলেই আমাদের বিভিন্ন কাজকর্ম ছিল একসাথে।) ছিলাম ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। এছাড়া আমাদের বাড়ীসহ পুরো গ্রাম ছিলো মৌলভী ফরিদ আহমদের সমর্থক। খরস্রোতা নদীর স্রোতের উল্টো দিকে নৌকা চালানোর মতো ছিলো আমাদের অবস্থান। ফলে আমাদের দুইজনের অবস্থা ছিল ‘হারগিলা খাইয়ার’ মতো। নির্বাচনের পরে ভোটের ফলাফলে আমাদের ‘নৌকা’ প্রতীক যখন বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হলো তখনই আমাদের আনন্দ, উচ্ছ্বাস দেখে কে? আমাদের নৌকা প্রতীক বললাম এ কারনেই স্কুল ছাত্র হলেও আমরাও ভোটার হয়েছিলাম। ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে নৌকা প্রতীকের জন্য এলাকার পরিচিত জনসহ সর্বস্তরের ভোটারের কাছে ভোট ভিক্ষা করেছিলাম। মিটিং, মিছিল করে গলা ফাটিয়েছি। 
পূর্বেই বলেছি নির্বাচনের পরে পাক স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহবান নিয়ে তালবাহানা শুরু করে। তখন আমাদের নির্বাচনী পরীক্ষা শেষ। আমরা এস এস সি পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এসময় দেশের অবস্থা ক্রমে অস্থির থেকে অস্থির হয়ে উত্তাল হতে থাকে। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি পরোক্ষ ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান এবং দেশবাসীকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হতে আহবান জানান। (বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার চুড়ান্ত ঘোষণা প্রদান করেন ২৫ মার্চ মধ্যরাতে, যা ভোর হতে হতে ২৬ মার্চ হয়। ২৬ মার্চ ভোর রাতে পাক বহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার আগেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সে কারনেই ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস)। সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের পরে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠা দেশের অবস্থা দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে। দেশের সর্বত্র সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক, কখন কি হয় এই ভেবে।    
এদিকে মোটামুটি ভাবে নির্ধারিত আগামী আগস্ট মাসে আমাদের এস এস সি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পরে আমাদের পড়ালেখা তথা পরীক্ষার প্রস্তুতি বলতে গেলে অনেকটা শিখেয় ওঠে। তখন আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকে সতর্ক করে রাখা হয়। ঈদগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের অফিসে দলের নেতাকর্মীদের শল্লা-পরামর্শ হতে থাকে। সকাল থেকে রাত ১১টা ১২টা পর্যন্ত চলে। কেন্দ্রের নির্দেশে ঈদগাঁওতেও গঠন করা হয় ‘সংগ্রাম কমিটি’। কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের পৃথক সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়।                 
এলাকার সবার পরিচিত এবং আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মাহফুজুল করিম চৌধুরীকে (যিনি এলাকায় মজু মউ (মজু মামা) নামে সমধিক পরিচিত) সভাপতি এবং ঈদগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জাবের আহমদ চৌধুরীকে সেক্রেটারী করে গঠন করা হয় ‘ঈদগাঁও সংগ্রাম কমিটি’। ‘ঈদগাঁও সংগ্রাম কমিটি’র কোষাধ্যক্ষ ছিলেন জনাব ছৈয়দুল হক (বর্তমান আয়কর উপদেষ্টা)। সংগ্রাম কমিটিতে অন্যদের মধ্যে ছিলেন বাবু মথুরা বিকাশ পাল (পরে কক্সবাজার সরকারি কলেজের অধ্যাপক), জনাব ছৈয়দুল আলম চৌধুরী প্রকাশ আলম মাস্টার (যিনি ঈদগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন), জনাব মোহাম্মদ আবদুর রশিদ এম এ (মাইজপাড়া), জনাব মীর আহমদ প্রকাশ মীরু (মাইজপাড়া), জনাব আনোয়ারুল আজিম চৌধুরী (মাইজপাড়া। যিনি পরবর্তীতে ঈদগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন), জনাব আহমদ হোসেন প্রকাশ আহমদ হোসেন খলিফা (দীর্ঘ দিন ঈদগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ছিলেন), জনাব মোহাম্মদ আলম প্রকাশ জুমের আলম (মুক্তিযোদ্ধা ছুরত আলম), জনাব আব্বাস আহমদ প্রকাশ আব্বাস ড্রাইভার (খোদাইবারী), জনাব এজাহার মিয়া প্রকাশ এজাহার ড্রাইভার (খোদাইবারী), ছাত্রপ্রতিনিধি হিসেবে জনাব এটিএম রাজা মিয়া (পাহাশিয়াখালী)। পরবর্তীতে সংগ্রাম কমিটি সম্প্রসারণ করা হয়। সম্প্রসারিত কমিটিতে জনাব মোজাম্মেল হক ফরাজী (ঈদগাঁও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক), জনাব হেফাজতুর রহমান চৌধুরী (কালিরছরা), জনাব কামাল উদ্দিন (কালিরছরা), বাবু গোপাল কৃষ্ণ শর্মা (করণিক-কাম-সহকারী শিক্ষক, ঈদগাঁও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়), জনাব মোহাম্মদ সেকান্দর প্রকাশ সেকান্দর সওদাগর (পোকখালী), জনাব নূরুল হক বি কম (পোকখালী) ও জনাব উজির আলী সওদাগর (নাপিতখালী, ইসলামপুর)-কে সদস্য হিসেবে রাখা হয়।
আর ছাত্রলীগ নেতা জনাব এস টি এস রাজা মিয়ার নেতৃত্বে গঠন করা হয় ‘বৃহত্তর ঈদগাঁও ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’। এস টি এম রাজা মিয়া পরবর্তীতে কক্সবাজার কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন এবং বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কক্সবাজার সদর উপজেলা শাখা’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ‘বৃহত্তর ঈদগাঁও ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’ হলেও উক্ত কমিটিতে পোকখালী, চৌফলদণ্ডী (ভারুয়াখালী ইউনিয়ন এসময় চৌফলদণ্ডী ইউনিয়নের অধীন ছিল)ও ইদগড় ইউনিয়নের প্রতিনিধিও রাখা হয়। বর্তমানের তুলনায় তখন ইদগড়, চৌফলদণ্ডী ও পোকখালী ইউনিয়নের জনগণ ঈদগাঁও বাজারের উপর বেশি নির্ভরশীল ছিল। এখন ইদগড়, পোকখালী, চৌফলদণ্ডী, ভারুয়াখালী ইউনিয়নে একাধিক বাজার গড়ে উঠলেও তখন ইউনিয়নসমূহে বলতে গেলে তেমন কোন বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিলনা। এসব ইউনিয়নে ছোট পরিসরে বাজার প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও ঈদগাঁও বাজার ছিল সমগ্র জনপদের মূল কেন্দ্রবিন্দু। ঈদগাঁও বাজারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত সমগ্র বৃহত্তর ঈদগাঁও ইউনিয়নের রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতি। সে সময় জনাব এসটিএম রাজা মিয়া ছিলেন কক্সবাজার কলেজের ছাত্র। ১৯৬৮ সালে রাজা মিয়া ঈদগাঁও উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস এস সি পাশ করেন।
‘বৃহত্তর ঈদগাঁও ছাত্র সংগ্রাম কমিটিতে’ সদস্য হিসেবে অন্যদের মধ্যে ছিলেন জনাব আবু তাহের চৌধুরী (কালিরছরা), জনাব নূরুল ইসলাম বাঙ্গালী (ইদগড়, পরবর্তীতে ইদগড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান), জনাব সিরাজুল হক রেজা (ইদগড়, পরবর্তীতে কক্সবাজার কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন), জনাব কবির আহমদ কোম্পানী (খোদাইবাড়ী। পরবর্তীতে খোদাইবাড়ী এজি লুৎফুল কবির মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা), জনাব আবদুল হালিম (মাছুয়াখালী), জনাব আমিনুর রশিদ (পাহাশিয়াখালী), জনাব জানে আলম (পাহাশিয়াখালী), জনাব এনামুল হক (মাছুয়াখালী), জনাব আক্তার কামাল (পালাকাটা, পরবর্তীতে স্কুল শিক্ষক), জনাব আমান উল্লাহ (ইউছুপেরখিল, পরবর্তীতে খুটাখালী তমিজিয়িা মাদ্রাসার শিক্ষক), জনাব মোহাম্মদ সিরাজুল হক (দক্ষিণ লরাবাক, বর্তমানে দক্ষিণ লরাবাক জমিরিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত), মুহম্মদ নূরুল ইসলাম (গ্রন্থকার), জনাব এচারুল হক (সিকদারপাড়া, পাহাশিয়াখালী), জনাব সাইফুদ্দিন ফরাজী (বর্তমানে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন-বিএমএ, কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক), জনাব আবদুস ছালাম (মোহাজের পাড়া, গোমাতলী, পোকখালী), জনাব জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (মাইজপাড়া), জনাব আবদু শুকুর (মোহাজের পাড়া, গোমাতলী, পোকখালী)। আমার গ্রাম দক্ষিণ লরাবাক থেকে ছাত্র সংগ্রাম কমিটিতে ছিলাম আমি ও জনাব মোহাম্মদ সিরাজুল হক।  
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পরে দেশের অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। দেশের সর্বত্র আতঙ্ক, মানুষের মধ্যে চাপা ভীতি। ক্রমে এগিয়ে আসতে থাকে সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি। দেশের পরিবর্তনশীল অবস্থার মধ্যে পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার ভান করতে থাকে এবং এর মধ্যে প্রতিদিন বিমানে করে পাকিস্তান থেকে ঢাকায় সৈন্য আনতে থাকে। বন্দর নগরী চট্টগ্রাম, খুলনাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সৈন্য সমাবেশসহ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুত করতে থাকে। যুদ্ধজাহাজে করে অস্ত্র এনে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে কিন্তু জনগণের বাধার কারণে সেই অস্ত্র তারা নামাতে পারছিল না। ২১ মার্চ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোও ঢাকা আসে। সদলবলে ঢাকা পৌঁছে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনার ভান করতে থাকে। পাকিস্তান থেকে যখন সেনাবাহিনীর সদস্য ঢাকা আসতে থাকে তখন জেনারেল ইয়হিয়া এবং পাকিস্তান প্রেমিকরা (?) পাকিস্তান জিন্দাবাদ দিয়ে মুখের ফেনা তুলতে ব্যস্ত। 
এরমধ্যে ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে বাঙালি সেনাসদস্যরা বিদ্রোহ করে বসে। তাদের থামানোর জন্যে ঢাকা থেকে যে সেনাবাহিনী পাঠানো হয় তাদের সাথে সাধারণ জনগণের সংঘর্ষে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়। 
২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস কিন্তু সেনানিবাস আর গভর্নমেন্ট হাউজ ছাড়া সারা দেশে কোথাও পাকিস্তানের পতাকা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনেও সেদিন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সাথে সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। 
পরদিন ২৪ মার্চ, সারাদেশে একটি থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল। গণহত্যার জন্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চকে বেছে নিয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যার আদেশ দিয়ে সে সন্ধ্যাবেলা দলবল নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান যাত্রা করে। বাঙালি গণহত্যার নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট।’ এতে করে অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে, বাঙালি নিধনে গণহত্যার নিখুঁত পরিকল্পনা অনেক আগে থেকে করা হয়। অপারেশন সার্চলাইটের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল রক্ত বন্যা বইয়ে দিয়ে হলেও বাঙালিকে স্তব্ধ করা। সোজা কথা কীভাবে একটি জাতিকে ধ্বংস করা। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনার জন্য আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করা হয়। 
ঠিক এমনি অবস্থায় ২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনী নিরীহ বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়েনার মতো। রাজধানী ঢাকার রাজপথ বাঙালির বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হলো। হাজার হাজার নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশুর নিথর দেহ রাজপথে পড়ো থাকলো। পাক বাহিনীর লক্ষ্য ছিলো বাঙালিকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা এবং বাঙালির প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করা। বন্দি করার পরে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত করে ফাঁসিতে ঝুলানো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পরে দেশে পাকিস্তানী প্রশাসন বলতে কিছু ছিলো না। তখন স্থানীয় ভাবে প্রশাসন নিয়ন্ত্রন করতো ‘সংগ্রাম কমিটি’। 
এরপরে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিকামী মানুষ আত্মগোপন করেন যে যেভাবে পারে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে গঠিত ‘সংগ্রাম কমিটি’র উপর নির্দেশ আসে। যেই নির্দেশ সেই কাজ। ‘সংগ্রাম কমিটি’ ও ‘ছাত্রসংগ্রাম কমিটি’র সদস্যরা যৌথ ভাবে কেন্দ্রীয় নির্দেশ পালনে সচেষ্ট। আমরাও সংগ্রাম কমিটির নির্দেশে ‘বৃহত্তর ঈদগাঁও ছাত্র সংগ্রাম কমিটির’ উদ্দ্যোগে মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ সরবরাহ করার জন্য ঈদগাঁও বাজারে, গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল-ডাল, তরকারি সংগ্রহ করতে থাকি। সংগৃহিত পণ্য সংগ্রাম কমিটির অফিসে জমা করতে থাকি। ঈদগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে সংগ্রাম কমিটির কর্মকাণ্ড চলতে থাকে। পরে এসব পণ্য ট্রাক যোগে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। আমি, এচারু, সাইফুদ্দিন, জাহাঙ্গীর, আবদুস সলাম, আবদু শুকুর ছিলাম সংগ্রাম কমিটির সর্ব কণিষ্ঠ সদস্য। ফলে সিনিয়রদের ফরমায়েস অনুযায়ী আমাদেরকে কাজ করতে হতো। আমি আর এচারু ছিলাম এস এস সি পরীক্ষার্থী। সাইফুদ্দিন, জাহাঙ্গীর, সালাম ও শুক্কুর ১৯৭২ সালের পরীক্ষার্থী।
এরমধ্যে খবর আসল মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন অলি আহমদসহ কিছু সংখ্যক সৈনিক চট্টগ্রাম শহর থেকে কক্সবাজার আসবেন। সে দিন ২৮ মার্চ। তাঁরা চট্টগ্রাম থেকে চকরিয়া, ডুলহাজারা হয়ে ঈদগাঁও বাস স্টেশন হয়ে কক্সবাজার যাবে। ঈদগাঁও সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত হল আমরা ঈদগাঁ বাসস্টেশনে মেজর জিয়া, মেজর মীর শওকত, ক্যাপ্টন অলি আহমদ-কে সম্বর্ধনা জানাবো। মাগরিবের নামাজের পরে আমরা ঈদগাঁও সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে ঈদগাঁও বাসস্টেশনে গিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। সবার হাতেই বাঁশের ও কাঠের লাঠি। আমরা যে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত তা দেখাবার জন্যই বাঁশ-কাঠের লাঠি নিয়ে দাঁড়ানো। এর আগে বঙ্গবন্ধু  ঘোষণা করেছেন, যার যা আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকার জন্য। বঙ্গবন্ধুর আহবানে আমরা উদ্বুদ্ধ হয়ে লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছি। মাতৃভূমি বাংলাকে শত্রুমুক্ত করতে তিতুমীর, ফকির সন্যাসী বাঁশের লাঠি নিয়ে, তীরধনুক নিয়ে, বাঁশের কেল্লা তৈরি করে ব্রিটিশ বেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ সাহেব একটি খোলা জীপে করে আসলেন। তখন দিনের আলো প্রায় নিভে গেছে। অন্ধকারে ভাল দেখা যাচ্ছে না। আমরা তাঁদেরকে অভ্যর্থনা জানালাম। মাগরিবের নামাজের পরে হাজারো জনতার গগণ বিদারী ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে ঈদগাঁও বাস স্টেশন প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। তারা নেতৃবৃন্দের সাথে খোলা জীপের উপর থেকেই কুশল বিনিময় করে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ঈদগাঁও বাসস্টেশন ত্যাগ করলেন।  
দিন গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকে। আমরা তখন সময় পেলেই বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, আকাশবাণী এবং জার্মান রেডিও ডয়েস-এ ভেলি শুনে দেশের অভ্যন্তরীন খবর জানার চেষ্টা করতাম। কারণ পাকিস্তান রেডিও প্রকৃত খবর দিতো না। পাকিস্তান রেডিওতে মূলত কতজন ‘মুক্তি’কে হত্যা করলো, কোথায় কোথায় পাকিস্তানের সেনারা অভিযান চালিয়ে অবস্থা স্থিতিশীল করছে তাই প্রচার করতো। এতে করে দেশে কোথায় কি ঘটছে তার সঠিক তথ্য জানা যেতো না। একারণেই দেশের সিংহভাগ মুক্তিকামী মানুষ বিদেশি রেডিরও’র উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। আগেই বলেছি মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কারণে পরীক্ষার প্রস্তুতি বন্ধ ছিলো। ক্রমেই যখন যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকে তখন আমরা বাড়ি থেকে সরে থাকতাম। সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত মতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রসদ সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। 
এভাবে মার্চ মাসের বাকি দিনগুলো কেটে গেল। এপ্রিল আসলো। এপ্রিল মানেই বাঙলার ক্যালেণ্ডারে বোশেখ মাস। বোশেখ তীব্র তাপদাহ এবং ঝড়ঝঞ্ঝার মাস। বোশেখের তীব্র তাপদাহ এবং ঝড়ঝঞ্ঝার সাথে মুক্তিকামী মানুষের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে লাগলো। এদিকে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহেই নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হঠিয়ে পাক বাহিনী চট্টগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করল। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান পথ হলো আরাকান সড়ক। পাকিস্তানীরা চট্টগ্রাম শহর দখল করার পরে দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা কক্সবাজার পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা শুরু করল। তারই ধারবাহিকতায় তারা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আরাকান সড়কের কালুরঘাট সেতু দখলের প্রচেষ্টা শুরু করল। তবে কালুরঘাট সেতু কেন্দ্রিক প্রতিরক্ষাব্যূহ ছিল মুক্তিবাহিনীর অন্যতম প্রধান প্রতিরোধ কেন্দ্র। ১১ এপ্রিল পাক বাহিনীর কাছে কালুরঘাটের পতন হলে মুক্তিবাহিনীর সদস্য পেছন দিকে সরে যায়। ঈদগাঁও ছাত্র সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক এস টি এম রাজা মিয়া কালুরঘাট যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পেছনে সরে গিয়ে বোয়ালখালী হয়ে উত্তর চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের দিকে পশ্চাদপসরণ করেন এবং বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। পাক বাহিনী কালুরঘাট জয় করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা কক্সবাজারের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করার মতো সামরিক শক্তি মুক্তিবাহিনীর ছিল না। পাক বাহিনী চট্টগ্রাম শহর থেকে কক্সবাজার অগ্রসর হতে হতে বিভিন্ন এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে জনপদে আগুন দিয়ে পুঁড়িয়ে ছারখার করে পুরো এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে থাকে। এই অবস্থায় আরো অনেকেই পালিয়ে প্রতিবেশি রাষ্ট্র বার্মা ও ভারতে আশ্রয় নিতে থাকে।         
পাক বাহিনী ১১ এপ্রিল কালুরঘাট সেতু দখল করে বিভিন্ন জনপদে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ২৭ এপ্রিল চকরিয়া আগমন কর। তবে তারা কক্সবাজার পৌঁছতে সময় নেয় ৫ মে পর্যন্ত। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পৌঁছতে দীর্ঘ সময় নেওয়ার কারণ হচ্ছে তারা এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে জ্বালায়-পোড়াও এবং ধর-পকড়াও নীতি অবলম্বন করে। এতে অনেকেই গৃহহীন হয়ে পড়ে, অনেকেই পাকিস্তানীদের গুলির নিশানা হয়ে শহীদ হন। পাক বাহিনী অবশেষে ৬ মে থেকে কক্সবাজারে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে। কক্সবাজারের সী-বীচ রেস্ট হাউস তাদের আস্তানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পাক-বাহিনী কক্সবাজারে আগমন করার দিন তাদের এদেশীয় তাবেদারেরা ‘নারেয়ে তকবির, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, শ্লোগান দিয়ে পাকি’দের অভ্যর্থনা জানালো। কক্সবাজারে পাক বাহিনীর অবস্থান নিশ্চিত করার সাথে সাথে তাদের এদেশীয় দোসরেরা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী এবং সমর্থকদের তালিকা করা শুরু করল। তালিকা করার সুবাধে কোন কোন স্থানে তালিকা প্রস্তুতকারীরা টাকা পয়সা হাতিয়ে নিতে শুরু করে। একই সাথে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক ‘নৌকা’ মার্কায় ভোট দেয়ার ‘অপরাধে’ সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসাবাড়িতে হামলা এবং আগুন দেয়া শুরু করলো। পাকি এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের আক্রোস এবং হামলা থেকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মী, সমর্থকেরাও বাদ যায়নি। 
পূর্বেই বলেছি এস টি এম রাজা মিয়া, মোহাম্মদ আলম প্রকাশ জুমের আলমসহ বেশ কয়েকজন বাড়ি থেকে চলে গেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। আমি বয়সে ছোট ছিলাম বলে মুক্তিযেুদ্ধে অংশ নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করায় বাবুল ও আমাকে বাড়িতে চোখে চোখে রাখা হচ্ছিলো। ফলে আমাদের বিচরণ ছিলো সীমাবদ্ধ। ঈদগাঁও বাজারে যাওয়ার সুযোগ ছিলো আমাদের। ঈদগাঁও বাজারে গেলে মোটামুটি যাবতীয় খবরাখবর পাওয়া যেতো। আমরা ঈদগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাদের উপরে বসে যাবতীয় কিছুর উপর নজর রাখতাম। স্কুলের মাঠ থেকে বিল্ডিং-এর ছাদের উপর দেখা যায় না বলেই আমাদের অবস্থান ছিলো নিরাপদ। 
এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ। সেই দিন শনিবার। সাপ্তাহিক হাটের দিন। সংগত কারণেই সাপ্তাহিক হাটের দিন বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার ভীড় থাকে বেশি। এসময় আমি, বাবুল, মোহাম্মদ উল্লাহ (আমার ঘনিষ্ট বন্ধুদের অন্যতম, জালালাবাদ ইউনয়নের খামারপাড়ার মিয়াজিপাড়ার বাসিন্দা) স্কুলের ছাদের উপরে বসা ছিলাম। আছরের নামাজের পরে এটি জীপ গাড়ি নিয়ে কক্সবাজার থেকে ঈদগাঁও আসলেন পিডিপি প্রধান মৌলভী ফরিদ আহমদ। সাথে ছিলেন তার নিকট আত্মীয় এবং ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ছওয়ার কামাল। ছরওয়ার কামালের কোমরের দু’পার্শ্বে নিয়মিত ভাবে ঝুলানো থাকতো দু’টি গুলি ভর্তি রিভলবার। ছরওয়ার কামাল কক্সবাজার মহকুমা শান্তি কমিটির সাথে যুক্ত। ছরওয়ার কামালের অংগুলি হেলনে তখন অনেক কিছু হয়েছে। মাছুয়াখালীতে অনেক রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়ি উচ্ছেদ হয়েছে, অনেকের বসতবাড়ি হয়েছে দখল। তাদের অত্যাচারে অনেক রাখাইন পরিবার এসময় নাড়িকাটা ভিটাবাড়ির মায়া ত্যাগ করে হিজরত করে বার্মা চলে গেছে। তারা আর কোন দিন বাংলাদেশে ফিরে আসেনি। শুধু কি তাই? খোদ কক্সবাজার শহরে অনেক মুক্তিকামী বাঙালির বাড়ি উচ্ছেদ করেছে। অনেকের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে এই ছরওয়ার কামালের নির্দেশে। একাত্তর-এ তার প্রচণ্ড প্রতাপে বলা হয় বাঘে-মহিষে একঘাটে পানি খেয়েছে। 
মৌলভী ফরিদ আহমদ ঈদগাঁও হাইস্কুলের মাঠে পৌঁছে স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্যদের নির্দেশ দিলেন ‘মালাউনদের’ বাড়িঘর পুঁড়িয়ে দিতে। যেই নির্দেশ সেই কাজ। শান্তি কমিটির স্থানীয় নেতৃবৃন্দ পিডিপি প্রধান মৌলভী ফরিদ আহমদের আগমনে ঈদগাঁও উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সমবেত হলেন। নেতার নির্দেশে ‘নারায়ে তকবির, পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ দিয়ে পালপাড়ার দিকে রওয়ানা দিলেন ‘পাকিস্তান রক্ষাকারী’ জনতা। একটু পরেই দেখলাম পালপাড়া থেকে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ছে। এসময় আমরা স্কুলের ছাদের উপর ভয়ে কুকড়ে যাচ্ছিলাম। আমরা স্কুলের সিঁড়ি ঘরের পশ্চিম পার্শ্বে লুকিয়ে থাকলাম। ওদিকে আগুনের লেলিহান শিখায় বঙ্গবন্ধুর ‘নৌকা প্রতীকে ভোট প্রদানকারী সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের’ বাড়িঘর পুঁড়ে ছাই হতে বেশি সময় লাগেনি। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে নিজেদের ‘জান’ বাঁচাতে পালিয়ে গেলেও মান বাঁচাতে পারেনি, পারেনি তাদর সম্ভ্রম, তাদের মাল বাঁচাতে। জান বাঁচাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় অনেক হিন্দু তরুণি, যুবতিসহ মা-বোন লাঞ্চিত হয়েছে। অস্থাবর সম্পত্তিসহ বাড়িঘর হারিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পূর্ব দিকের ভোমরিয়াঘোনার জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিলো। হিন্দু মুসলমানের শত শত বছরের অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সহাবস্থান মুহূর্তের মধ্যে ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন শত বছরের ভ্রাতৃপ্রতীম মুসলমানদের ঠুনকো ভালবাসার মোজেজা বুঝতে পারল। তাঁদের মধ্য মুসলমান সম্পর্কে অবিশ্বাস বাসা বেঁধে তা শাখা প্রশাখায় বিস্তৃতি লাভ করল। জঙ্গলের বন্য জীবজন্তুর সাথে রাত অতিবাহিত করে পরদিন যে যেভাবে পারে পরিবার পরিজন নিয়ে ভারতে, বার্মায় পালিয়ে গেল। পাকিস্তানী বাহিনীর দোসরদের বর্বরতা এখানেই শেষ নয়। তারা পর্যায়ক্রমে মাস্টার ছৈয়দুল আলম চৌধুরী, রাজা মিয়া, ভোমরিয়াঘোনার আবদুল জলিলসহ মুক্তিকামী লোকজনের বাড়ি ঘরে আগুন দিয়ে এক বিভিষিকাময় অবস্থার সৃষ্টি করল। এতে করে মানুষের মধ্যে ভয় ভীতি এবং আতঙ্ক বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমাকেও বাড়ি থেকে চাপাচাপি করতে থাকে কখন আমাদের বাড়িও পুঁড়িয়ে দেয় এই ভয়ে। ফলে ভয় সবার মনে বাসা বাঁধতে থাকে।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি আমাদের এস এস সি পরীক্ষার সময় ধার্য রয়েছে আগস্ট মাসে। যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে আমার পড়ালেখাও চাঙ্গে উঠে। তবে বাড়ির চাপে পড়ালেখার অভিনয় করতে থাকি। দেখতে দেখতে আগস্ট মাস এসে গেলো। এস এস সি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য কক্সবাজারে যাই। পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য কক্সবাজারের বইল্লা পাড়ায় আমাদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায় উঠি। পরীক্ষা দেয়ার জন্য আমার সাথে ছিল আমাদের আর এক আত্মীয় বদরুল ইসলাম। পরীক্ষা শুরু হল। কয়েকটি পরীক্ষা দিয়ে ফেল্লাম। কক্সবাজার গিয়ে আমরা জানতে পারলাম অনেক ছাত্রলীগ নেতাকে পাকিস্তানী বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন সরকারি রেস্ট হাউসে পাকিস্তানী বাহিনী অবস্থান নিয়েছে। সেই রেস্ট হাউসের পূর্ব দিকের পাতকুয়াকে পাকি বাহিনী করেছে মৃত্যুকূপ। মুক্তিকামী বাঙালিকে মৃত্যুকূপে হত্যার পরে রেস্ট হাউসের পশ্চিম পার্শ্বের বালিয়াড়ির খোলা আকাশে তাদের লাশ ফেলে দেয়া হতো। অথবা বালু চাপা দেওয়া হতো। এসব লাশ হতো শেয়াল কুকুরের খাবার। এসব জানার পরে অজান্তেই মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেল। একই সাথে জানতে পারলাম আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও ঈদগাঁও সংগ্রাম কমিটির সদস্য মাস্টার ছৈয়দুল আলম চৌধুরীকে পাকিস্তানী বাহিনী ধরে কক্সবাজারে নিয়ে এসেছে। এদিকে যুদ্ধের তীব্রতা দিন দিন বাড়ার প্রেক্ষিতে পরীক্ষা শেষ না করে আমি বাড়িতে পালিয়ে আসলাম। মনের মধ্যে ভয় ছিলো কখন আবার ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে আমাদেরকে পাক হানাদারদের হাতে তুলে দেয়া হয়। কক্সবাজারের সাম্প্রতিক সময়ের অবস্থা বাড়িতে বর্ণনা করাতে তারাও পরীক্ষার জন্য আর জোড়াজুড়ি করলো না। বাড়ি ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী রাজা মিয়া, ছুরত আলমসহ অন্যদের সাথে যোগাযোগ করলাম। 
আগস্টের শেষ সপ্তাহে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম। আগেই খবর নিয়েছিলাম ঈদগড়ের পাহাড়ী এলাকায় আমার পরিচিত, ঈদগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের অনেক বন্ধু-বান্ধব রয়েছে। তার মধ্যে রাজা মিয়া, এচারুল হক, নূরুল ইসলাম বাঙ্গালী, সিরাজুল হক রেজা। তারা সবাই দেশকে স্বাধীন করার জন্য, দেশ থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের তাড়াবার জন্য বাড়িঘর ছেড়ে, নিজের পিতা-মাতা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, আরাম-আয়েশ ছেড়ে জঙ্গলে বন্যপ্রাণীর সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছে। জঙ্গলের বন্যপ্রাণীর সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। 

ঈদগড় আগে থেকেই আমার পরিচিত এলাকায়। প্রায় পাঁচ বছর আগে আমি ঈদগড়ে ছিলাম। ছিলাম বেশ কিছু দিন। ঈদগড় পৌঁছে কুদালিয়াকাটায় আমার পূর্ব পরিচিত বন্ধু মোহাম্মদ হোসেনের বাড়িতে উঠলাম। ফলে ঈদগড়ের রাস্তাঘাট চিনতে আমার অসুবিধা হয়নি। ঈদগড়ে আমার স্কুলের সহপাঠিদের মধ্যে ছিল সোলাইমান, ওসমান, জামাল। স্কুলের জুনিয়রদের মধ্যে ইসহাক, মনিরুজ্জামানসহ অনেকেই। মোহাম্মদ হোসেনের বাড়িতে থেকেই গভীর জঙ্গলে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করলাম। মোহাম্মদ হোসেনের হোসেনের দেখানো পাহাড়ি পথ বেয়ে অনেক গভীরে মুরুং পাড়ায় চলে গেলাম এবং আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধব ও অপরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগদান করলাম। তাঁদের সাথে থেকে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিতে থাকি। এরপরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর। 
৬ ডিসেম্বর কক্সবাজারে মিত্রবাহিনী বোমা হামলা বর্ষণ করে। একই সাথে বঙ্গোপসাগরে অবস্থানকারী যুদ্ধ জাহাজ থেকে গোলা নিক্ষেপ করে। ৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী কক্সবাজার বিমান বন্দরে প্রথম বোমা হামলা করে। বোমার আঘাতে বিমান বন্দর, রানওয়ে, টার্মিনাল মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মিত্রবাহিনীর বোমার আঘাতে কক্সবাজার মহকুমা শান্তি কমিটির সভাপতি এডভোকেট মাঈদুর রহমান মারা যান। পাকিস্তান রক্ষার অগ্রসৈনিক মাঈদুর রহমান চকরিয়া থানার (বর্তমানে পেকুয়া থানা) বারবাকিয়া ইউনিয়নের জমিদার পরিবারের সদস্য। সেই বোমার আঘাতে আরো অনেকেই আহত হয়েছিল। বোমা বষর্ণকালের অনেক সাক্ষী এখনো জীবিত আছেন।  
৬ ডিসেম্বর যখন মিত্রবাহিনীর বোমাবর্ষণ হয় তখন আমরা ছিলাম ঈদগড়ের জঙ্গলে। বোমার আঘাতে তখন ঈদগড়ও  প্রকম্পিত হয়ে উঠে। কক্সবাজার বিমান বন্দরে মিত্রবাহিনীর বোমা বর্ষণে পাওয়ার হাউসও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আমরা জঙ্গলে অবস্থান করে ভাবতেও পারিনি এত তাড়াতাড়ি দেশ শত্রুমুক্ত হবে। মিত্রবাহিনীর বোমা বর্ষণের ঐদিনই পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের সহযোগিরা কক্সবাজার ত্যাগ করে। কক্সবাজার বিমান বন্দরে মিত্রবাহিনীর নিক্ষিপ্ত অবিস্ফোরিত বোমা ১৯৭২ সালে দীর্ঘদিন ধরে বিমান বন্দরের রানওয়েতে পড়ে ছিল। মিত্রবাহিনী কর্তৃক কক্সবাজারে বোমা বর্ষণের পরে প্রতিবেশি বার্মায় আশ্রয় নেয়া লোকজন দেশে ফিরতে শুরু করে। মিত্রবাহিনী কর্তৃক বোমা বর্ষণের পরেই পাকিস্তানী বাহিনী কক্সবাজার ছেড়ে চলে যেতে থাকে। মাত্র ছয়দিন পরে কক্সবাজার মুক্ত হয়। ১২ ডিসেম্বর কক্সবাজারে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। 
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয়। পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পনের মাধ্যমে দেশ শত্রুমুক্ত হয়। কিন্তু বিজয়ের পরে কি দেখলাম? গঠিত হলো ইউনিয়ন ও গ্রাম পঞ্চায়েত, রিলিফ কমিটি। যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশ গঠনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার মনোনিবেশ করলেন। ক্ষতিগ্রস্থ লোকজনকে পুনর্বাসনে সরকার এগিয়ে আসলেন। ইউনিয়ন ও গ্রাম পঞ্চায়েত কমিটি ও রিলিফ কমিটিতে স্থান করে নেয় স্বাধীনতা বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের শত্র“রা, পাকিস্তান রক্ষাকারী রাজনৈতিকদলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। শুধু তাই নয়, পুসর্বাসনের তালিকায় পিডিপি’র নেতা-কর্মীদের নাম দেখা গেল শীর্ষে। সংগত কারণেই মানুষ আশাহত হলো। ধাঁক্কা খেলো প্রচণ্ড ভাবে। শুধু এখানে শেষ নয় যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি এমন অনেকেই সনদ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধারা গোপনে স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে গিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের ব্যবস্থা করেন। শুধু তাই নয় ঈদগাঁও বাজারের বিভিন্ন দোকান-পাঠ এবং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান লুটপাঠ করেছিল, লুটপাঠে অংশ নিয়েছিল তারা এবং তাদের সহযোগিরাও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট জোগাড় করে মুক্তিযোদ্ধা বনে গেল। এতে করে প্রচলিত প্রবাদ অনুযায়ী এটাই প্রমাণিত হল, ‘যারা গাছের টা খেতে পারে তারা গোড়ারটাও কুড়িয়ে খেতে পারে।’     
(বিদ্র ঃ সংগ্রাম কমিটির তালিকা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে আয়কর উপদেষ্টা জনাব ছৈয়দুল হক, সংগ্রাম কমিটির সেক্রেটারী জনাব জাবের আহমদ চৌধুরী, ঈদগাঁও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের দীর্ঘ দিনের শিক্ষক গোপাল কৃষ্ণ শর্মা, এস টি এম রাজা’র কাছ থেকে। এই তালিকা যে পূর্ণাঙ্গ তা জোর করে কেউ বলতে পারছেন না। স্মৃতি থেকে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত ভাবে কারো নাম বাদ গেলে তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। সংগ্রাম কমিটিতে ছিলেন এবং তালিকা সম্পর্কে ধারণা পোষন করেন এরকম কেউ থাকলে তালিকাটি সরবরাহ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। ভবিষ্যতে তালিকাটি পূর্ণাঙ্গ করার চেষ্টা করবো। ২০১০ সালে এই লিখাটি স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করে। তবে এযাবৎ কেউ এই তালিকা সম্পর্কে কোন অভিযোগ করেননি।-লেখক।)
islamcox56@gmail.com
তথ্যসূত্রঃ
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, প্রতীতি প্রকাশনা, ডিসেম্বর ২০০