একাত্তর বলতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির স্বাধিকার। একখণ্ড স্বাধীন মাটি। একটি লাল সবুজ খচিত পতাকা। পৃথিবীর ইতিহাসে একটি পৃথক মানচিত্র। একাত্তর আমাদের অহংকার। বাঙালি জাতি হিসেবে পৃথিবীতে অহংকার করার মত আমাদের যেসব উপলক্ষ আছে, তৎমধ্যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ অন্যতম। পৃথিবীতে খুব কম দেশই আছে স্বাধীকার আদায়ের জন্য, দেশের বিজয়ের জন্য এত রক্ত ঝরিয়েছে।
বাংলাদেশের এই অর্জনের জন্য পাক-হায়েনাদের বুলেটের আঘাতে এদেশের পিচঢালা নিকষকালো রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। বাংলাদেশের নদীর পানি হয়েছে লালে লাল। বাংলাদেশের শ্রেষ্ট সন্তান স্বাধীনতার শহীদদের রক্ত নদী-উপনদী হয়ে ছড়িয়ে গেছে সমগ্র দেশে, মিশে গেছে বঙ্গোপসাগরে, ভারত মহাসাগরে, সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন মহাসাগরে। বলা যেতে পারে পৃথিবীর প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরেই সেই রক্তের প্রবাহ মিশে রয়েছে। বাংলাদেশের এই লাল সবুজ খচিত পতাকার জন্য ৩০ লাখ শহীদ তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে। পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের লালসার শিকার হয়ে দুই লাখ মা-বোন তাদের ইজ্জত হারিয়েছে।
দুই.
‘ম’তে মমতাময়ী। মমতাময়ী বল্তেই বোঝায় ‘মা’। ‘ম’ আর ‘আ’তে ‘মা’ হয়। মা’তে মা, মাটি, মাতৃভূমি। তিনটি শব্দই একই সূত্রে গাঁথা। ‘মা’ গর্ভধারীণী, মমতাময়ী। ‘মাটি’ থেকেই আমাদের জন্ম এবং আবার মাটিতেই ফিরে যেতে হবে। মাটির দেহ মাটিতেই মিশে যাবে। আর ‘মাতৃভূমি’ বা দেশ সেতো সবার উপরে, সবার ভালবাসার একমাত্র সম্পদ। দেশকে ভালবাসতে পারার মধ্যে যে অনাবিল আনন্দ, তৃপ্তি তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। তার উল্টো পিঠে রয়েছে মাতৃভূমিকে ভালবাসতে না পারার দুঃখবোধ-বেদনা, তা বুঝানো যাবে? যারা মাতৃভূমিকে ভালবাসতে পারেনি তারা তৃপ্তি বা সুখ কি জিনিস বুঝতে পারেনি এবং বুঝতে পারবেও না। আমার খুব সৌভাগ্য মাতৃভূমিকে শত্রু মুক্ত করতে স্বাধীনতার যে যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, গেরিলা যুদ্ধ হয়েছে তা প্রত্যক্ষ করতে পেরেছি। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও এতে নিজেও অংশ নিতে পেরেছি। আমাদের এই যুদ্ধ ছিল দেশের জন্য গভীর আত্মত্যাগের। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ গভীর আত্মত্যাগের ইতিহাস, অবিশ্বাস্য সাহস ও বীরত্বের ইতিহাস এবং বিশাল এক অর্জনের ইতিহাস। যখন কেউ এই আত্মত্যাগ, বীরত্ব আর অর্জনের ইতিহাস জানবে, তখন সে যে শুধুমাত্র দেশের জন্যে গভীর ভালোবাসা আর মমতা অনুভব করবে তা নয়, এই দেশ, এই মানুষের কথা ভেবে গর্বে তার বুক ফুলে উঠবে। এখনই সময় আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে জানান দেবার, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার।
তিন.
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা বিজয়ের কথা বলার পূর্বে পূর্ববর্তী কিছু ইতিহাস বলা দরকার। দরকার চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত আন্দোলন, সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের ধারা বর্ণনা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ শত্রু মুক্ত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এদেশ শাসন করেছে পাকিস্তান, তারও আগে ব্রিটিশ তথা ইংরেজরা। তার আগে ব্রিটিশ বেনিয়াদের মুখোশে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী। ১৭৫৭ সালে এদেশ ব্রিটিশ বেনিয়ার দখলে চলে যায়। তারা শাসন-শোষণ করেছে প্রায় দুইশ’ বছর। বেনিয়া ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠে আন্দোলন-সংগ্রাম, বিদ্রোহ। স্বাধীনতাকামী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রাম বন্ধ করতে, মানুষকে দাবিয়ে রাখতে হাজার হাজার মানুষকে করা হয় অন্তরীণ, দেয়া হয় দীপান্তরের নামে কালাপাইন্যা। কালাপাইন্যা মূলতঃ নির্জন স্থানে স্থানান্তরের নাম। সেসময় স্বাধীকার আন্দোলনকারীদের বর্তমান ভারতের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে পাঠিয়েও তাদের তখ্ত-তাউস নিরাপদ রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর, লক্ষ তাজা প্রাণের বিনিময়ে ব্রিটিশ বেনিয়ারা এদেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশ বেনিয়ারা এদেশ থেকে চলে গেলেও তাদের ষড়যন্ত্রের চিহ্ন রেখে যায়। ১৯৪০ সালে ‘লাহোর প্রস্তাব’-এ ঠিক করা হয়েছিল ভারতবর্ষের যে অঞ্চলগুলোতে মুসলমান বেশি, সেরকম দুটি অঞ্চলকে নিয়ে দুটি দেশ এবং বাকি অঞ্চলটিকে নিয়ে আর একটি দেশ তৈরি করা হবে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যে এলাকা দুটিতে মুসলমান ধর্মাবলম্বী বেশি সেই এলাকা দুটি নিয়ে ভিন্ন দেশ না হয়ে পাকিস্তান নামে একটি দেশ এবং ১৫ আগস্ট বাকি অঞ্চলটিকে ভারত নামে অন্য একটি দেশে ভাগ করে দেয়া হল। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও অবশেষে পশ্চিম পাকিস্তান নামের অংশের শাসকেরা আমাদের পূর্ব পাকিস্তান নামের অধিবাসী বাঙালিদের উপর জুলুম, নির্যাতন, নির্বতন, শোষন শুরু করে। ছিল বঞ্চনার ইতিহাস। এমনকি আমাদের মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে উদ্যোগী হয়। পাকিস্তান নামে পৃথিবীতে অত্যন্ত বিচিত্র একটি দেশের জন্ম হয়, যে দেশের দুটি অংশ দুই জায়গায়। যে দেশের মানুষ একটি ভাষায় কথা বলেনা। পাকিস্তানের অধিবাসীদের নিজেদের রয়েছে পৃথক পৃথক ভাষা, পৃথক সংস্কৃতি, পৃথক কৃষ্টি, পৃথক ঐতিহ্য। দেশের দুটি অংশের মধ্যখানে একটি ভিন্ন স্বাধীন দেশ। বেনিয়া ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে ভাগ করার সময় বাংলা ভাষাভাষি কলকাতার বাঙালি, আসামের বাঙালি ও বার্মার আরাকান রাজ্যের মুসলমানদেরকে ভিন্ন একটি দেশে অন্তর্ভূক্ত করে দেয়। এটাই ছিল বেনিয়া ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।
পাকিস্তান নাম দিয়ে যে দেশটি সৃষ্টি করা হয় তা পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান নাম দেওয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তান বলতে আমাদের প্রাণ প্রিয় বাংলাদেশকে বুঝানো হয়।
পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্ব ছিল, ছিল একটি বিশাল রাজ্য-ভারত। দুটি পৃথক অংশ নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি করা হলেও দুটি অংশের মানুষের ভেতরেও ছিল বিশাল দূরত্ব। তাদের চেহারা, ভাষা, খাবার, পোষাক-পরিচ্ছদ সবকিছু ছিল ভিন্ন, শুধু মাত্র একটি বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ট মানুষগুলোর মাঝে মিল ছিলÑ তা হলো ধর্ম। পূর্ব পাকিস্তানের সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুদের সংখ্যাও কম ছিল না। তবে তাদের ভাষা ছিল বাংলা। এরকম একটি বিচিত্র দেশ কিভাবে টিকে থাকে। দেশভাগের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল দুই কোটি আর পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল চার কোটি। কাজেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ বাঙালি হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বিশ্বাস ছিল শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, পুলিশ-মিলিটারি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সবকিছুতেই বাঙালিরা অগ্রাধিকার পাবে। সরকারি চাকুরিতে যদি একজন পশ্চিম পাকিস্তানের লোক থাকে, তাহলে সেখানে দুইজন পূর্ব পাকিস্তানের লোক থাকবে। কিন্তু বাস্তবে হলো ঠিক তার উল্টো। সবকিছুতেই পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগ ছিল অত্যধিক বেশি। পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভাগ ছিল ৮০ থেকে ৯০ ভাগ। বাজেটের ৭৫ ভাগ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে, আর মাত্র ২৫ ভাগ ব্যয় হতো পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু রাজস্ব আয় বেশি ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে, যার পরিমাণ ৬২ ভাগ। সবেচেয়ে ভয়ংকর ও ভয়াবহ তথ্য ছিল সেনাবাহিনী নিয়োগের ক্ষেত্রে। সেনাবাহিনী নিয়োগের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানি বা বাঙালি নিয়োগের সংখ্যার তুলনায় উর্দু ভাষাভাষি পাকিস্তানী নিয়োগের পরিমাণ ছিল ২৫ গুণ বেশি। সেনাবাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানি ছিল পাঁচ লাখ, আর পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালি ছিল মাত্র ২০ হাজার।
চার.
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দেশ ভাগ হওয়ার পর থেকেই ঊর্দু ভাষাভাষি পশ্চিম পাকিস্তানিরা দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে বসবাসকারি বাঙালিদের উপর বিভিন্ন ভাবে নিপীড়ন করতে থাকে। সর্বশেষ ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা এসে ঘোষণা করলেন একমাত্র ঊর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ভারতীয় বংশো™ভুত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দেশের সংখ্যা গরিষ্ট মানুষের মুখের ভাষার কোন তোয়াক্কাই করলেন না। ফলে তার ঘোষণার সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা তীব্র প্রতিবাদ করে বিক্ষোভ শুরু করে। মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র দেশে। আন্দোলন থামাতে ঢাকার রাজপথে পুলিশ নামানো হয়। এক পর্যায়ে পুলিশ ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি বর্ষণ করে। এতে রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরো অনেকে তাজা প্রাণ রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। ভাষার জন্য ঢাকার রাজপথে রক্ত ঝরার পরেই ছাত্র-জনতার আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়। এসব আন্দোলনে কলকারখানা থেকে শ্রমিকেরাও এসে যোগদান করে। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন, রক্ত ঝরার নজির পৃথিবীতে তার আগে ছিল না। বাঙালি তরুণ ছাত্র-জনতা পৃথিবীর বুকে সেই নজির স্থাপন করলেন। তাজা প্রাণ কেড়ে নেওয়ার পরেও সেই আন্দোলনকে থামানো যায়নি। ঊর্দূ ভাষাভাষি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যেখানে আমাদের ভাষার দাবীতে শহীদদের রক্ত ঝরেছিল সেখানে রাতারাতি নির্মিত হলো আমাদের প্রিয় শহীদ মিনার। তার আদলেই সারা দেশেই গড়ে উঠেছে শহীদ মিনার। সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রাণপ্রিয় শহর কক্সবাজার এবং আমাদের নাড়িকাটা গ্রাম ঈদগাঁতেও নির্মাণ করা হয় শহীদদের স্মৃতিবহনকারী মিনার। শুরু হলো ভাষা শহীদদেরকে শ্রদ্ধা নিবেদন করার সংস্কৃতি। আজ ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব। এটি এখন আমাদের ঐতিহ্য। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের এখন ভাষা দিবস। দিবসটি এখন শুধু বাংলাদেশের জন্যে নয়, এখন সারা পৃথিবীর মানুষের জন্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাই দিনটি এখন বিশ্বব্যাপী ভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। ১৯৯৯সালেই কয়েকজন বাঙালি যুবকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জাতিসংঘ দিবসটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
পাঁচ.
পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রনের একমাত্র কর্ণধার হলো সেনাবাহিনী। পাকিস্তানের ঊর্দূ ভাষাভাষি সেনাবাহিনী গোড়া থেকেই পাকিস্তানে শাসনের নামে এক ধরনের ষড়যন্ত্র শুরু করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাষ্ট্রক্ষমতাকে বরাবরই তাদের নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্যে সচেষ্ট ছিল। দেশের বাজেটের ৬০ ভাগ ব্যয় করা হতো সেনাবাহিনীর পেছনে, তাই তারা তাদের অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধার লোভনীয় জীবন বেসামরিক মানুষের হাতে ছেড়ে দিতে কোন অবস্থাতেই প্রস্তুত ছিল না। ফলে তারা রাজনীতিকে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করতো। নানারকম তালবাহানা করে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে ১৯৫৮ সালে নির্বাচিত সরকারকে উৎখ্যাত করে পাকিস্তানের সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। ক্ষমতার মোহে তিনি সবকিছু ভুলে গিয়েছিলেন। ক্ষমতাকে তিনি পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিলেন। দীর্ঘ এগার বছর তিনি ক্ষমতার মসনদে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকেও রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছিল। তবে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা কোন বেসামরিক ব্যক্তির হাতে অর্পণ করেননি। ক্ষমতা অর্পণ করেছিলেন তার দোসর আরেক ঊর্দিপরা পাকিস্তানের সেনা প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে।
ছয়.
দেশে সামরিক শাসন, বাঙালিদের উপর বিভিন্ন রকমের বঞ্চনা, নির্যাতন, কাজেই পূর্ব পাকিস্তানী বাঙালিরা সেটি খুব সহজেই মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড়ো রাজনৈতিক দল ছিল আওয়ামী লীগ। বাঙালির বঞ্চনার ইতিহাস, নির্যাতনের ইতিহাস, বৈষম্যের ইতিহাস তুলে ধরে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণা করেন। ছয় দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সব রকমের অর্থনৈতিক শোষণ, বঞ্চনা আর নিপীড়ন থেকে মুক্তির একমাত্র দলিল। এই ছয় দফা ছিল এক রকমের পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ব শাসনের দলিল। পূর্ব পকিস্তানের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ছয় দফা দাবি ঘোষণার সাথে সাথেই পাকিস্তানি স্বৈরাচারি সরকার বাঙালিদের উপর নির্যাতনের স্টীম রুলার চালাতে শুরু করে। শুরু করে ব্যাপক ধর-পাকড়। আওয়ামী লীগের ছোট বড় নেতাসহ দেশ প্রেমিক লোকজনকে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে দেশদ্রোহিতার একটি মিথ্যা মামলায় প্রধান আসামি করা হয় এবং তাঁকে জেলে পুরে দেয়া হয়। পাকিস্তানী স্বৈরশাসকেরা বলতে লাগলো ছয় দফা মানে পাকিস্তানকে ভাগ করার পায়তারা। অখণ্ড পাকিস্তানের নামে স্বৈরশাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দিল, তেড়ে নিল জনজীবনের শান্তি।
পাকিস্তানীদের ধর-পাকড়ের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা আবার শুরু করল আন্দোলন। সারাদেশ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় জ্বলে উঠলো। জেল-জুলুম, পুলিশ, ইপিআর-(পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস্)-এর গুলি, কিছুই বাকি থাকল না। কিন্তু সেই আন্দোলনকে দমানো গেল না, থামানো গেল না। বাঙালিদের উপর যতই নির্যাতন, নিবর্তন, জেল-জুলুম বাড়তে লাগল আন্দোলন ততই বেগবান হতে লাগল। আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে গেল ছাত্রদের নিয়ন্ত্রনে। ছাত্ররা এর আগেই এগার দফা দাবি ঘোষণা করেছে। বাঙালিদের বৈষম্যের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হল পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনার কাগজমিলে উৎপন্ন হয় কাগজ। সে কাগজ পশ্চিম পাকিস্তানে বিক্রি হচ্ছিল প্রতি দিস্তা (২৫ পিচ কাগজে এক দিস্তা) ছয় আনা আর পূর্ব পাকিস্তানে এক দিস্তা কাগজ বিক্রি হয় বার আনা। এতে ছাত্র-জনতা ক্ষোভে ফুঁসে উঠলো। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন জেলের বাইরে, তিনিও এগিয়ে এলেন। দেখতে দেখতে সেই আন্দোলন একটি গণবিস্ফোরণে রূপ নিলÑ কার সাধ্যি একে থামায়? ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে প্রাণ দিয়েছিল ফুটফুটে কিশোর মতিউর রহমান, প্রাণ দিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদ। যার নামে রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরের প্রবেশ পথের আইয়ুব গেটের নাম পরিবর্তন করে ‘আসাদ গেট’ করা হয়। পাকিস্তান সরকার শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব নেতাকর্মীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হল। শুধু তাই নয়, প্রবল পরাক্রমশালী প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতা দিয়ে দীর্ঘ এগার বছর পরে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ বিদায় নিল।
সাত.
জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করেই পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন দেবার ঘোষণা করে। সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর। এতে করে পূর্ব পাকিস্তানের লোকজন আশান্বিত হয়ে উঠে। সাধারণ নির্বাচন যতই এগিয়ে আসতে লাগলো পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যকার চাপা আনন্দ উচ্ছ্বাস আকারে দেখা দেল। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানীদেরকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার কিছু দিন পর অর্থাৎ ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসে। এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়েই দশ লক্ষ মানুষ আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যায়। সে রকম দুর্যোগ পৃথিবীতে খুব কমই হয়েছিল। ঘুর্ণিঝড়ের আঘাতে একসাথে এত বনি আদমের প্রাণহানি এর আগে কোথাও হয়নি। পুরো উপকূল ঘুর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। দশ লক্ষ মানুষ মারা গেল, পুরো উপকূল কবরস্থানে পরিণত হলো, পুরো উপকূল বিধ্বস্থ হলো কিন্ত পাকিস্তানের স্বৈর শাসকেরা সাহায্যের হাত নিয়ে বাঙালিদের কাছে এগিয়ে আসল না। ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকার মানুষ যারা বেঁচে ছিল তারাও ধুকে ধুকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। অনেকেই মারা গেল খাদ্যের অভাবে, পান করার জন্য বিশুদ্ধ পানি না পেয়ে। ঘূর্ণিঝড় কবলিত অসহায় মানুষের প্রতি পাকিস্তানী শাসকদের অনিহা ও অবহেলা দেখে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ক্ষোভে-দুঃখে ফুঁঁসে উঠলো। সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালিরা পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া এবং উর্দু ভাষাভাষি পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটালো। প্রচণ্ড ক্ষোভে, দুঃখে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এসময় ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত উপকূলের মানুষের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে সাধারণ নির্বাচন বন্ধ রাখার দাবি জানান। কিন্তু স্বৈরশাসকেরা মনে করেছিল নির্বাচন হলে তাদের তল্পিবাহক এবং পাকিস্তানপন্থি মুসলিমলীগ, নেজামে ইসলাম পার্টি, পাকিস্তান পিপলস পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়ী হবে। ক্ষুব্ধ হয়ে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক জনসভায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবার ঘোষণা দেন এবং একই সাথে পাকিস্তানীদেরকে ‘আস্সালাসু আলাইকুম’ জানিয়ে দেন। এই ‘আসসালামু আলাইকুম’ই শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানীদের জন্য বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে দেয় এবং পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক করে বাঙালিদের আবাসভূমি ‘বাংলাদেশ’ সৃষ্টির মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়।
বাঙালির প্রচণ্ড অনাগ্রহ ও অনিহার মধ্যেও ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হলো পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। অত্যন্ত সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল দেখে পাকিস্তানী স্বৈরাশাসক ও পাকিস্তানের ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। নির্বাচনের ফলাফলে পাকিস্তানী স্বৈরশাসকের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। পাকিস্তানী সেনা শাসকসহ পশ্চিম পাকিস্তানীদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। সাধারণ নির্বাচনের ভোট গণনার পরে দেখা গেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়ে বিজয়ী হয়েছে। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে জয়ী হয়। যখন সকল আসনে নির্বাচন শেষ হলো তখন দেখা গেল, মনোনীত মহিলা আসনসহ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন, পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি-পিপিপি ৮৮টি আসনে বিজয়ী হয়েছে। অন্যান্য সব দল মিলে পেয়েছে অবশিষ্ট ৫৮টি আসন। পাকিস্তান পিপলস্ পার্টিসহ অন্যান্য আসনে বিজয়ী দলগুলো এলাইয়েন্স করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো ছাড়া পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের হাতে আর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের হাতে তো ক্ষমতা দেওয়া যায় না। এসময় পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বলাবলি করতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের ‘জলদাসেরা কী প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসনে বসবে’? উর্দু ভাষাভাষি পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তথা বাঙালিদেরকে জলদাসই মনে করতো। তাই বাঙালিদেরকে সিংহাসনে বসতে দেয়া যায় না।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী সেনাশাসকদের পরিষ্কার করে বলে দিলেন যে, ‘আমি ছয় দফার কথা বলে জনগণের কাছ থেকে ভোট নিয়েছি। শাসনতন্ত্র রচনা করতে হবে ছয় দফার ভিত্তিতে, দেশ শাসিত হবে ছয় দফার ভিত্তিতে।’ পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া এবং পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকেরা শুরু করলো ষড়যন্ত্র। তাদের ষড়যন্ত্রের একমাত্র বিষয়, কিভাবে বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দেয়া না যায়। তাদের এই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পাকিস্তান নামের অখণ্ড রাষ্ট্রের কবর রচিত হলো।
আট.
পাকিস্তানি সেনাশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান সিদ্ধান্তই নিয়ে নিলেন বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে না। কিন্তু কিভাবে তা বাস্তবায়ন করবে তার জন্য কলাকৌশল অবলম্বন করতে হবে। তার এসব কলাকৌশল বাস্তবায়নের একমাত্র নির্ভরযোগ্য সহযোগি হিসেবে পাওয়া গেল সেনাশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের একসময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান পিপিপি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে সাথে নিয়ে কলকব্জা নাড়তে লাগলো।
ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র চলতে থাকলেও জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাইরে তা বাঙালিদের বুঝতে দিল না। ১৯৭১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করলো ৩ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। সমগ্র বাঙালি জাতি সেই দিনটির অপেক্ষায় থাকলো। বাঙালি জাতির সাথে বিশ্ববাসীও গভীর আগ্রহে সেই দিনের প্রতিক্ষায় থাকল।
দেখতে দেখতে মার্চ এসেই গেল। এর মধ্যেই বাঙালির অন্যতম অহংকারের দিন একুশে ফেব্রুয়ারি। বাঙালির ভালোবাসা এবং মমতার শহীদ দিবস উদযাপিত হলো অন্য বারের তুলনায় ভিন্ন আমেজ এবং ভিন্ন উন্মাদনা নিয়ে। সমগ্র দেশের শহীদ মিনারে মানুষের ঢল নামে। সকল বাঙালির হৃদয়ের অভ্যন্তরে প্রোতিত স্বপ্ন একটি, আর সেটি হচ্ছে এবার পাকিস্তান শাসন করবে বাঙালিরাই। কিন্তু স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া তা আর হতে দিল না। জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের ঘোষিত তারিখের ঠিক দুই দিন আগে ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিল। এতে করে বাঙালিরা নিরাশ হয়ে পড়ল। দগ্ধ হতে লাগলো ক্ষোভের আগুনে। সেই ক্ষোভ হচ্ছে পেয়ে হারানোর ক্ষোভ। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের বুকের ভেতর ক্ষোভের যে বারুদ জমা হয়ে ঘনিভুত হয়েছিল, সেখানে যেন অগ্নিস্ফূলিঙ্গ স্পর্শ করল। সারাদেশে বিক্ষোভের যে বিস্ফোরণ ঘটল তার কোনো তুলনা নেই। সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পাকিস্তান নামের দেশকে ছারখার করে দিল, পাকিস্তানী ক্ষমতালিপ্সু স্বৈরশাসকদের সিংহাসন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভষ্মিভূত করে দিল।
নয়.
পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ার ঘোষণাটি যখন রেডিওতে প্রচার করা হয়, তখন ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের সাথে কমনওয়েলথ একাদশের সাথে খেলা চলছে। রেডিও’র ঘোষণা শোনার পরে মুহূর্তের মধ্যে জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, ঢাকা স্টেডিয়াম হয়ে ওঠে একটি রণক্ষেত্র। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, দোকান-পাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ রাজপথে নেমে আসে, পুরো রাজধানী ঢাকা শহর দেখতে দেখতে একটি মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়ে যায়। মানুষের মুখে তখন উচ্চারিত হতে থাকে স্বাধীনতার স্লোগান : ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে পাঁচ দিনের জন্যে হরতাল ও অনির্দিষ্টকালের জন্যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। সেই অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে পাকিস্তান সরকারকে কোনো ভাবেই সাহায্য না করার জন্য বাঙালিদের প্রতি আহবান জানালেন। তাঁর সেই ঘোষণায় সারা পূর্ব পাকিস্তান অচল হয়ে গেল। অবস্থা বেগতিক দেখে বাঙালিকে নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে কারফিউ জারি করল। কিন্তু ছাত্র-জনতার সেই বাঁধ ভাঙ্গা আন্দোলন, স্বাধীনতার মন্ত্রে উচ্ছ্বসিত বাঙালিকে থামাতে কারফিউ যথেষ্ট ছিল না। তাই ছাত্র-জনতা কারফিউ ভেঙে রাজপথে নেমে আসল। চারিদিকে বাঁধভাঙ্গা মানুষের মিছিল, গগণবিদারী স্লোগান আর বিক্ষোভ। পাকিস্তানী সেনারা মিছিল থামাতে গুলি ছুড়ল, মানুষ মারা যাচ্ছে কিন্তু রাস্তা ছেড়ে জনতা ঘরে ফিরল না। বরঞ্চ পাকিস্তানিদের বর্বরতা দেখে শিশু-কিশোরসহ সর্বস্তরের মানুষ ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসল।
২ মার্চ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে ছাত্র সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু’র ভিপি আ স ম আবদুর রব বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করলেন। এসময় ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নূরে আলম ছিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন ও শাহজাহান সিরাজ। যাঁরা পরবর্তীকালে চার খলিফা নামে খ্যাত হন।
৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় জাতীয় সংগীত হিসেবে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি নির্বাচন করা হল।
পাঁচদিন টানা হরতালের পর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভা। ছাত্র, জনতা, শ্রমিক, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ সর্বস্তরের মানুষ রেসকোর্স ময়দানে ছুটে আসল। জনতার উপস্থিতি পুরো ময়দান ছাড়িয়ে হোটেল শেরাটন পর্যন্ত পৌঁছে গেল, অপর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড় ছাড়িয়ে তিন নেতার মাজার পর্যন্ত পৌঁছে গেল। জনসভা নয়, যেন জনসমুদ্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই জনসভায় ভাষণ দিতে এলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। যাঁর যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করুন।’ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি দেশের মানুষকে (মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক মানুষ ছাড়া) ঐক্যবদ্ধ করে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অকাতরে প্রাণ দিয়ে দেশকে স্বাধীন করার শক্তি জোগায়।
দশ.
একাত্তরে পাক বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরেরা অনেক কিছু করেছে। যা আমরা এখনো ভুলতে পারিনি। পাকি বাহিনীর ক্ষতের চিহ্ন এখনো রয়েছে দেশের সর্বত্র। সেসব ক্ষত এখনো শুকায়নি। পাক বাহিনীর সেই সব ক্ষতস্থানে গড়ে ওঠেছে বধ্যভূমি, স্মৃতিসৌধ। আমাদের কক্সবাজার শহরের প্রধান বধ্যভূমি সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন প্রাক্তন রেস্ট হাউসের সামনে। যেখানে বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৭ ইঞ্জিনিয়ানস্ ব্যাটালিয়ন-ইসিবি-এর ছাউনি স্থাপন করা হয়েছে। সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা মনে হলে গা শিউরে উঠে। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের নির্মমতা হিটলার-মুসলিনির অত্যাচারকেও হার মানায়। বিশেষ করে দেশের তৃণমূলীয় জনপদে তাদের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন এখনো মানুষের মুখে মুখে ফিরে। আমার নাড়িকাটা গ্রাম ঈদগাঁতে মুক্তিকামী সর্বস্তরের মানুষসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর পুঁড়িয়ে দিয়েছে মুহুর্তের মধ্যে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর পুঁড়িয়ে তাঁদেরকে উচ্ছেদ করা হয়। বসতবাড়ি গুড়িয়ে দিয়ে তাঁদের আটক করে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়।
এগার.
১৯৭১ সাল থেকে ২০১৩ সাল। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে।
১৯৭১ সালে আমি এস এস সি পরীক্ষার্থী। কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। সত্তর-এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্টতা অর্জন করে। সঙ্গত কারণেই বাঙালিরা খুশিতে আত্মহারা। বিশেষ করে যারা বঙ্গবন্ধুর অনুসারি, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতা, কর্মী, সমর্থক সবাই। এছাড়াও খুশিতে আত্মহারা হয়েছিলো আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী, সমর্থক এর বাইরে একটি বিশাল সমর্থক (ঝরষবহঃ াড়ঃবৎং) গোষ্ঠী। আমাদের কক্সবাজার নির্বাচনী এলাকার জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এডভোকেট নূর আহমদ। তিনি প্রাক্তন নেজামে ইসলামী পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা, পিডিপি’র অন্যতম কর্ণধার, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক কক্সবাজারের গৌরব মৌলভী ফরিদ আহমদকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। নির্বাচনের এই ধরনের ফলাফলে দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যারা দেশের জোতদার, জমিদারদের নিত্য নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হতো তারাও খুশি হয়েছিলো। ছাত্রলীগের একজন সক্রিয়কর্মী হিসেবে আমাদের দল আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ায় আমরাও ছিলাম আন্দদিত ও উত্তেজিত। তারও কারণ ছিলো।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির-পিডিপি প্রধান জনাব ফরিদ আহমদ (মাদ্রাসা শিক্ষা গ্রহণ না করেও যিনি মৌলভী ফরিদ আহমদ নামেই সমধিক পরিচিত)-এর পৈত্রিক নিবাস ছিলো রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের (বর্তমান রশিদ নগর ইউনিয়ন) মাছুয়াখালী গ্রামে। মাছুয়াখালী গ্রামটি ছিলো মগ তথা রাখাইন সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত। মাছুয়াখালী গ্রামের কিছু অংশ ঈদগাঁও ইউনিয়নভুক্ত। আমার পৈত্রিক নিবাস ঈদগাঁও ইউনিয়নের (বর্তমান জালালাবাদ ইউনিয়ন) দক্ষিণ লরাবাক গ্রাম। দক্ষিণ লরাবাক গ্রামসহ বৃহত্তর ঈদগাঁও ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামেই ছিলো মৌলভী ফরিদ আহমদের আত্মীয় স্বজন। ঈদগাঁও ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন পোকখালী। পোকখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব মোহাম্মদ আমিন প্রকাশ আমিন মিয়া (বর্তমানে প্রয়াত) ছিলেন মৌলভী ফরিদ আহমদের ভগ্নিপতি। সম্পর্কে আমার দাদা, ঈদগাঁও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের দীর্ঘ দিনের শিক্ষক জনাব আবদুর রহমান (বর্তমানে প্রয়াত) ছিলেন মৌলভী ফরিদ আহমদের নিকট আত্মীয়। আমার জেঠাতো ভাই সবার মেঝদা জনাব মাস্টার মমতাজ উদ্দিন আহমদ বিএবিটি (বর্তমানে প্রয়াত) ছিলেন মৌলভী ফরিদ আহমদের ছাত্র। ফলে পুরো এলাকায় এবং আমাদের পরিবারেও মৌলভী ফরিদ আহমদের প্রভাব ছিলো অত্যন্ত বেশি। এলাকার মানুষ হিসেবে মৌলভী ফরিদ আহমদের প্রতি ছিলো সাধারণ মানুষেরও সহানুভূতি। বিশেষ করে জোতদার, জমিদার এবং তাদের অধীনস্থ বর্গাচাষী এবং সুবিধাভোগী মহল। এছাড়াও এলাকার বয়স্ক শ্রেণীর লোকজন মৌলভী ফরিদ আহমদের সমর্থক ছিলেন। এলাকার সর্বস্তরের মানুষ মৌলভী ফরিদ আহমদকে সমর্থন করলেন একমাত্র কারণে, তিনি এলাকার লোকজনকে বুঝাতে সক্ষম হলেন যে, নৌকা প্রতীকে ভোট দিলে পাকিস্তান ভেঙে যাবে। ‘আপনারা যদি অভিন্ন পাকিস্তান চান তা হলে নৌকা প্রতীকে ভোট দেবেন না। শেখ মুজিব পাকিস্তান চায় না। নৌকা প্রতীকে ভোট দিলে পাকিস্তান থাকবে না।’ এলাকার লোকজন পাকিস্তান ভাঙতে চায় না। তারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে নিপীড়িত, নিগৃহীত ও বঞ্চিত হলেও পাকিস্তান ভাঙতে চায়না। এর একমাত্র কারণ ছিল এলাকার লোকজন অল্প শিক্ষিত ও অশিক্ষিত। অশিক্ষিত মানুষ তো আর বুঝতে পারছে না কিভাবে তারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে লাঞ্চিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত হচ্ছে। মোদ্দা কথা, এসব কারণে পুরো এলাকার সর্বাধিক মানুষ ছিলো মৌলভী ফরিদ আহমদের কর্মী, নয়তো সমর্থক। এটা ছিলো বাইরের দৃশ্য। কিন্তু ভেতরের দৃশ্য ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। জোতদার, জমিদার, গুটি কয়েক সুবিধাভোগী চেয়ারম্যান-মেম্বার ছাড়া সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন ছিলো বঙ্গবন্ধুর প্রতি, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার প্রতি। আমার দাদার বিশাল পরিবারে আমি আর বাবুল (নাসির উদ্দিন বাবুল। বাবুল আমার বড় জেঠা জনাব আবদুল শুকুরের মেঝ ছেলে জনাব মাস্টার মমতাজ উদ্দিন আহমদ, বিএবিটি’র বড় ছেলে। আমাদের ভাতিজা। তবে আমরা সম বয়সী ছিলাম বলেই আমাদের বিভিন্ন কাজকর্ম ছিল একসাথে।) ছিলাম ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। এছাড়া আমাদের বাড়ীসহ পুরো গ্রাম ছিলো মৌলভী ফরিদ আহমদের সমর্থক। খরস্রোতা নদীর স্রোতের উল্টো দিকে নৌকা চালানোর মতো ছিলো আমাদের অবস্থান। ফলে আমাদের দুইজনের অবস্থা ছিল ‘হারগিলা খাইয়ার’ মতো। নির্বাচনের পরে ভোটের ফলাফলে আমাদের ‘নৌকা’ প্রতীক যখন বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হলো তখনই আমাদের আনন্দ, উচ্ছ্বাস দেখে কে? আমাদের নৌকা প্রতীক বললাম এ কারনেই স্কুল ছাত্র হলেও আমরাও ভোটার হয়েছিলাম। ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে নৌকা প্রতীকের জন্য এলাকার পরিচিত জনসহ সর্বস্তরের ভোটারের কাছে ভোট ভিক্ষা করেছিলাম। মিটিং, মিছিল করে গলা ফাটিয়েছি।
পূর্বেই বলেছি নির্বাচনের পরে পাক স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহবান নিয়ে তালবাহানা শুরু করে। তখন আমাদের নির্বাচনী পরীক্ষা শেষ। আমরা এস এস সি পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এসময় দেশের অবস্থা ক্রমে অস্থির থেকে অস্থির হয়ে উত্তাল হতে থাকে। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি পরোক্ষ ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান এবং দেশবাসীকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হতে আহবান জানান। (বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার চুড়ান্ত ঘোষণা প্রদান করেন ২৫ মার্চ মধ্যরাতে, যা ভোর হতে হতে ২৬ মার্চ হয়। ২৬ মার্চ ভোর রাতে পাক বহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার আগেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সে কারনেই ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস)। সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের পরে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠা দেশের অবস্থা দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে। দেশের সর্বত্র সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক, কখন কি হয় এই ভেবে।
এদিকে মোটামুটি ভাবে নির্ধারিত আগামী আগস্ট মাসে আমাদের এস এস সি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পরে আমাদের পড়ালেখা তথা পরীক্ষার প্রস্তুতি বলতে গেলে অনেকটা শিখেয় ওঠে। তখন আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকে সতর্ক করে রাখা হয়। ঈদগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের অফিসে দলের নেতাকর্মীদের শল্লা-পরামর্শ হতে থাকে। সকাল থেকে রাত ১১টা ১২টা পর্যন্ত চলে। কেন্দ্রের নির্দেশে ঈদগাঁওতেও গঠন করা হয় ‘সংগ্রাম কমিটি’। কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের পৃথক সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়।
এলাকার সবার পরিচিত এবং আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মাহফুজুল করিম চৌধুরীকে (যিনি এলাকায় মজু মউ (মজু মামা) নামে সমধিক পরিচিত) সভাপতি এবং ঈদগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জাবের আহমদ চৌধুরীকে সেক্রেটারী করে গঠন করা হয় ‘ঈদগাঁও সংগ্রাম কমিটি’। ‘ঈদগাঁও সংগ্রাম কমিটি’র কোষাধ্যক্ষ ছিলেন জনাব ছৈয়দুল হক (বর্তমান আয়কর উপদেষ্টা)। সংগ্রাম কমিটিতে অন্যদের মধ্যে ছিলেন বাবু মথুরা বিকাশ পাল (পরে কক্সবাজার সরকারি কলেজের অধ্যাপক), জনাব ছৈয়দুল আলম চৌধুরী প্রকাশ আলম মাস্টার (যিনি ঈদগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন), জনাব মোহাম্মদ আবদুর রশিদ এম এ (মাইজপাড়া), জনাব মীর আহমদ প্রকাশ মীরু (মাইজপাড়া), জনাব আনোয়ারুল আজিম চৌধুরী (মাইজপাড়া। যিনি পরবর্তীতে ঈদগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন), জনাব আহমদ হোসেন প্রকাশ আহমদ হোসেন খলিফা (দীর্ঘ দিন ঈদগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ছিলেন), জনাব মোহাম্মদ আলম প্রকাশ জুমের আলম (মুক্তিযোদ্ধা ছুরত আলম), জনাব আব্বাস আহমদ প্রকাশ আব্বাস ড্রাইভার (খোদাইবারী), জনাব এজাহার মিয়া প্রকাশ এজাহার ড্রাইভার (খোদাইবারী), ছাত্রপ্রতিনিধি হিসেবে জনাব এটিএম রাজা মিয়া (পাহাশিয়াখালী)। পরবর্তীতে সংগ্রাম কমিটি সম্প্রসারণ করা হয়। সম্প্রসারিত কমিটিতে জনাব মোজাম্মেল হক ফরাজী (ঈদগাঁও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক), জনাব হেফাজতুর রহমান চৌধুরী (কালিরছরা), জনাব কামাল উদ্দিন (কালিরছরা), বাবু গোপাল কৃষ্ণ শর্মা (করণিক-কাম-সহকারী শিক্ষক, ঈদগাঁও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়), জনাব মোহাম্মদ সেকান্দর প্রকাশ সেকান্দর সওদাগর (পোকখালী), জনাব নূরুল হক বি কম (পোকখালী) ও জনাব উজির আলী সওদাগর (নাপিতখালী, ইসলামপুর)-কে সদস্য হিসেবে রাখা হয়।
আর ছাত্রলীগ নেতা জনাব এস টি এস রাজা মিয়ার নেতৃত্বে গঠন করা হয় ‘বৃহত্তর ঈদগাঁও ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’। এস টি এম রাজা মিয়া পরবর্তীতে কক্সবাজার কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন এবং বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কক্সবাজার সদর উপজেলা শাখা’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ‘বৃহত্তর ঈদগাঁও ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’ হলেও উক্ত কমিটিতে পোকখালী, চৌফলদণ্ডী (ভারুয়াখালী ইউনিয়ন এসময় চৌফলদণ্ডী ইউনিয়নের অধীন ছিল)ও ইদগড় ইউনিয়নের প্রতিনিধিও রাখা হয়। বর্তমানের তুলনায় তখন ইদগড়, চৌফলদণ্ডী ও পোকখালী ইউনিয়নের জনগণ ঈদগাঁও বাজারের উপর বেশি নির্ভরশীল ছিল। এখন ইদগড়, পোকখালী, চৌফলদণ্ডী, ভারুয়াখালী ইউনিয়নে একাধিক বাজার গড়ে উঠলেও তখন ইউনিয়নসমূহে বলতে গেলে তেমন কোন বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিলনা। এসব ইউনিয়নে ছোট পরিসরে বাজার প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও ঈদগাঁও বাজার ছিল সমগ্র জনপদের মূল কেন্দ্রবিন্দু। ঈদগাঁও বাজারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত সমগ্র বৃহত্তর ঈদগাঁও ইউনিয়নের রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতি। সে সময় জনাব এসটিএম রাজা মিয়া ছিলেন কক্সবাজার কলেজের ছাত্র। ১৯৬৮ সালে রাজা মিয়া ঈদগাঁও উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস এস সি পাশ করেন।
‘বৃহত্তর ঈদগাঁও ছাত্র সংগ্রাম কমিটিতে’ সদস্য হিসেবে অন্যদের মধ্যে ছিলেন জনাব আবু তাহের চৌধুরী (কালিরছরা), জনাব নূরুল ইসলাম বাঙ্গালী (ইদগড়, পরবর্তীতে ইদগড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান), জনাব সিরাজুল হক রেজা (ইদগড়, পরবর্তীতে কক্সবাজার কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন), জনাব কবির আহমদ কোম্পানী (খোদাইবাড়ী। পরবর্তীতে খোদাইবাড়ী এজি লুৎফুল কবির মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা), জনাব আবদুল হালিম (মাছুয়াখালী), জনাব আমিনুর রশিদ (পাহাশিয়াখালী), জনাব জানে আলম (পাহাশিয়াখালী), জনাব এনামুল হক (মাছুয়াখালী), জনাব আক্তার কামাল (পালাকাটা, পরবর্তীতে স্কুল শিক্ষক), জনাব আমান উল্লাহ (ইউছুপেরখিল, পরবর্তীতে খুটাখালী তমিজিয়িা মাদ্রাসার শিক্ষক), জনাব মোহাম্মদ সিরাজুল হক (দক্ষিণ লরাবাক, বর্তমানে দক্ষিণ লরাবাক জমিরিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত), মুহম্মদ নূরুল ইসলাম (গ্রন্থকার), জনাব এচারুল হক (সিকদারপাড়া, পাহাশিয়াখালী), জনাব সাইফুদ্দিন ফরাজী (বর্তমানে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন-বিএমএ, কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক), জনাব আবদুস ছালাম (মোহাজের পাড়া, গোমাতলী, পোকখালী), জনাব জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (মাইজপাড়া), জনাব আবদু শুকুর (মোহাজের পাড়া, গোমাতলী, পোকখালী)। আমার গ্রাম দক্ষিণ লরাবাক থেকে ছাত্র সংগ্রাম কমিটিতে ছিলাম আমি ও জনাব মোহাম্মদ সিরাজুল হক।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পরে দেশের অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। দেশের সর্বত্র আতঙ্ক, মানুষের মধ্যে চাপা ভীতি। ক্রমে এগিয়ে আসতে থাকে সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি। দেশের পরিবর্তনশীল অবস্থার মধ্যে পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার ভান করতে থাকে এবং এর মধ্যে প্রতিদিন বিমানে করে পাকিস্তান থেকে ঢাকায় সৈন্য আনতে থাকে। বন্দর নগরী চট্টগ্রাম, খুলনাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সৈন্য সমাবেশসহ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুত করতে থাকে। যুদ্ধজাহাজে করে অস্ত্র এনে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে কিন্তু জনগণের বাধার কারণে সেই অস্ত্র তারা নামাতে পারছিল না। ২১ মার্চ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোও ঢাকা আসে। সদলবলে ঢাকা পৌঁছে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনার ভান করতে থাকে। পাকিস্তান থেকে যখন সেনাবাহিনীর সদস্য ঢাকা আসতে থাকে তখন জেনারেল ইয়হিয়া এবং পাকিস্তান প্রেমিকরা (?) পাকিস্তান জিন্দাবাদ দিয়ে মুখের ফেনা তুলতে ব্যস্ত।
এরমধ্যে ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে বাঙালি সেনাসদস্যরা বিদ্রোহ করে বসে। তাদের থামানোর জন্যে ঢাকা থেকে যে সেনাবাহিনী পাঠানো হয় তাদের সাথে সাধারণ জনগণের সংঘর্ষে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়।
২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস কিন্তু সেনানিবাস আর গভর্নমেন্ট হাউজ ছাড়া সারা দেশে কোথাও পাকিস্তানের পতাকা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনেও সেদিন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সাথে সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
পরদিন ২৪ মার্চ, সারাদেশে একটি থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল। গণহত্যার জন্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চকে বেছে নিয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যার আদেশ দিয়ে সে সন্ধ্যাবেলা দলবল নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান যাত্রা করে। বাঙালি গণহত্যার নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট।’ এতে করে অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে, বাঙালি নিধনে গণহত্যার নিখুঁত পরিকল্পনা অনেক আগে থেকে করা হয়। অপারেশন সার্চলাইটের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল রক্ত বন্যা বইয়ে দিয়ে হলেও বাঙালিকে স্তব্ধ করা। সোজা কথা কীভাবে একটি জাতিকে ধ্বংস করা। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনার জন্য আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করা হয়।
ঠিক এমনি অবস্থায় ২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনী নিরীহ বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়েনার মতো। রাজধানী ঢাকার রাজপথ বাঙালির বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হলো। হাজার হাজার নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশুর নিথর দেহ রাজপথে পড়ো থাকলো। পাক বাহিনীর লক্ষ্য ছিলো বাঙালিকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা এবং বাঙালির প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করা। বন্দি করার পরে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত করে ফাঁসিতে ঝুলানো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পরে দেশে পাকিস্তানী প্রশাসন বলতে কিছু ছিলো না। তখন স্থানীয় ভাবে প্রশাসন নিয়ন্ত্রন করতো ‘সংগ্রাম কমিটি’।
এরপরে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিকামী মানুষ আত্মগোপন করেন যে যেভাবে পারে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে গঠিত ‘সংগ্রাম কমিটি’র উপর নির্দেশ আসে। যেই নির্দেশ সেই কাজ। ‘সংগ্রাম কমিটি’ ও ‘ছাত্রসংগ্রাম কমিটি’র সদস্যরা যৌথ ভাবে কেন্দ্রীয় নির্দেশ পালনে সচেষ্ট। আমরাও সংগ্রাম কমিটির নির্দেশে ‘বৃহত্তর ঈদগাঁও ছাত্র সংগ্রাম কমিটির’ উদ্দ্যোগে মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ সরবরাহ করার জন্য ঈদগাঁও বাজারে, গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল-ডাল, তরকারি সংগ্রহ করতে থাকি। সংগৃহিত পণ্য সংগ্রাম কমিটির অফিসে জমা করতে থাকি। ঈদগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে সংগ্রাম কমিটির কর্মকাণ্ড চলতে থাকে। পরে এসব পণ্য ট্রাক যোগে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। আমি, এচারু, সাইফুদ্দিন, জাহাঙ্গীর, আবদুস সলাম, আবদু শুকুর ছিলাম সংগ্রাম কমিটির সর্ব কণিষ্ঠ সদস্য। ফলে সিনিয়রদের ফরমায়েস অনুযায়ী আমাদেরকে কাজ করতে হতো। আমি আর এচারু ছিলাম এস এস সি পরীক্ষার্থী। সাইফুদ্দিন, জাহাঙ্গীর, সালাম ও শুক্কুর ১৯৭২ সালের পরীক্ষার্থী।
এরমধ্যে খবর আসল মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন অলি আহমদসহ কিছু সংখ্যক সৈনিক চট্টগ্রাম শহর থেকে কক্সবাজার আসবেন। সে দিন ২৮ মার্চ। তাঁরা চট্টগ্রাম থেকে চকরিয়া, ডুলহাজারা হয়ে ঈদগাঁও বাস স্টেশন হয়ে কক্সবাজার যাবে। ঈদগাঁও সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত হল আমরা ঈদগাঁ বাসস্টেশনে মেজর জিয়া, মেজর মীর শওকত, ক্যাপ্টন অলি আহমদ-কে সম্বর্ধনা জানাবো। মাগরিবের নামাজের পরে আমরা ঈদগাঁও সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে ঈদগাঁও বাসস্টেশনে গিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। সবার হাতেই বাঁশের ও কাঠের লাঠি। আমরা যে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত তা দেখাবার জন্যই বাঁশ-কাঠের লাঠি নিয়ে দাঁড়ানো। এর আগে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছেন, যার যা আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকার জন্য। বঙ্গবন্ধুর আহবানে আমরা উদ্বুদ্ধ হয়ে লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছি। মাতৃভূমি বাংলাকে শত্রুমুক্ত করতে তিতুমীর, ফকির সন্যাসী বাঁশের লাঠি নিয়ে, তীরধনুক নিয়ে, বাঁশের কেল্লা তৈরি করে ব্রিটিশ বেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ সাহেব একটি খোলা জীপে করে আসলেন। তখন দিনের আলো প্রায় নিভে গেছে। অন্ধকারে ভাল দেখা যাচ্ছে না। আমরা তাঁদেরকে অভ্যর্থনা জানালাম। মাগরিবের নামাজের পরে হাজারো জনতার গগণ বিদারী ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে ঈদগাঁও বাস স্টেশন প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। তারা নেতৃবৃন্দের সাথে খোলা জীপের উপর থেকেই কুশল বিনিময় করে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ঈদগাঁও বাসস্টেশন ত্যাগ করলেন।
দিন গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকে। আমরা তখন সময় পেলেই বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, আকাশবাণী এবং জার্মান রেডিও ডয়েস-এ ভেলি শুনে দেশের অভ্যন্তরীন খবর জানার চেষ্টা করতাম। কারণ পাকিস্তান রেডিও প্রকৃত খবর দিতো না। পাকিস্তান রেডিওতে মূলত কতজন ‘মুক্তি’কে হত্যা করলো, কোথায় কোথায় পাকিস্তানের সেনারা অভিযান চালিয়ে অবস্থা স্থিতিশীল করছে তাই প্রচার করতো। এতে করে দেশে কোথায় কি ঘটছে তার সঠিক তথ্য জানা যেতো না। একারণেই দেশের সিংহভাগ মুক্তিকামী মানুষ বিদেশি রেডিরও’র উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। আগেই বলেছি মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কারণে পরীক্ষার প্রস্তুতি বন্ধ ছিলো। ক্রমেই যখন যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকে তখন আমরা বাড়ি থেকে সরে থাকতাম। সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত মতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রসদ সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
এভাবে মার্চ মাসের বাকি দিনগুলো কেটে গেল। এপ্রিল আসলো। এপ্রিল মানেই বাঙলার ক্যালেণ্ডারে বোশেখ মাস। বোশেখ তীব্র তাপদাহ এবং ঝড়ঝঞ্ঝার মাস। বোশেখের তীব্র তাপদাহ এবং ঝড়ঝঞ্ঝার সাথে মুক্তিকামী মানুষের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে লাগলো। এদিকে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহেই নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হঠিয়ে পাক বাহিনী চট্টগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করল। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান পথ হলো আরাকান সড়ক। পাকিস্তানীরা চট্টগ্রাম শহর দখল করার পরে দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা কক্সবাজার পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা শুরু করল। তারই ধারবাহিকতায় তারা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আরাকান সড়কের কালুরঘাট সেতু দখলের প্রচেষ্টা শুরু করল। তবে কালুরঘাট সেতু কেন্দ্রিক প্রতিরক্ষাব্যূহ ছিল মুক্তিবাহিনীর অন্যতম প্রধান প্রতিরোধ কেন্দ্র। ১১ এপ্রিল পাক বাহিনীর কাছে কালুরঘাটের পতন হলে মুক্তিবাহিনীর সদস্য পেছন দিকে সরে যায়। ঈদগাঁও ছাত্র সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক এস টি এম রাজা মিয়া কালুরঘাট যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পেছনে সরে গিয়ে বোয়ালখালী হয়ে উত্তর চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের দিকে পশ্চাদপসরণ করেন এবং বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। পাক বাহিনী কালুরঘাট জয় করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা কক্সবাজারের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করার মতো সামরিক শক্তি মুক্তিবাহিনীর ছিল না। পাক বাহিনী চট্টগ্রাম শহর থেকে কক্সবাজার অগ্রসর হতে হতে বিভিন্ন এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে জনপদে আগুন দিয়ে পুঁড়িয়ে ছারখার করে পুরো এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে থাকে। এই অবস্থায় আরো অনেকেই পালিয়ে প্রতিবেশি রাষ্ট্র বার্মা ও ভারতে আশ্রয় নিতে থাকে।
পাক বাহিনী ১১ এপ্রিল কালুরঘাট সেতু দখল করে বিভিন্ন জনপদে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ২৭ এপ্রিল চকরিয়া আগমন কর। তবে তারা কক্সবাজার পৌঁছতে সময় নেয় ৫ মে পর্যন্ত। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পৌঁছতে দীর্ঘ সময় নেওয়ার কারণ হচ্ছে তারা এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে জ্বালায়-পোড়াও এবং ধর-পকড়াও নীতি অবলম্বন করে। এতে অনেকেই গৃহহীন হয়ে পড়ে, অনেকেই পাকিস্তানীদের গুলির নিশানা হয়ে শহীদ হন। পাক বাহিনী অবশেষে ৬ মে থেকে কক্সবাজারে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে। কক্সবাজারের সী-বীচ রেস্ট হাউস তাদের আস্তানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পাক-বাহিনী কক্সবাজারে আগমন করার দিন তাদের এদেশীয় তাবেদারেরা ‘নারেয়ে তকবির, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, শ্লোগান দিয়ে পাকি’দের অভ্যর্থনা জানালো। কক্সবাজারে পাক বাহিনীর অবস্থান নিশ্চিত করার সাথে সাথে তাদের এদেশীয় দোসরেরা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী এবং সমর্থকদের তালিকা করা শুরু করল। তালিকা করার সুবাধে কোন কোন স্থানে তালিকা প্রস্তুতকারীরা টাকা পয়সা হাতিয়ে নিতে শুরু করে। একই সাথে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক ‘নৌকা’ মার্কায় ভোট দেয়ার ‘অপরাধে’ সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসাবাড়িতে হামলা এবং আগুন দেয়া শুরু করলো। পাকি এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের আক্রোস এবং হামলা থেকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মী, সমর্থকেরাও বাদ যায়নি।
পূর্বেই বলেছি এস টি এম রাজা মিয়া, মোহাম্মদ আলম প্রকাশ জুমের আলমসহ বেশ কয়েকজন বাড়ি থেকে চলে গেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। আমি বয়সে ছোট ছিলাম বলে মুক্তিযেুদ্ধে অংশ নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করায় বাবুল ও আমাকে বাড়িতে চোখে চোখে রাখা হচ্ছিলো। ফলে আমাদের বিচরণ ছিলো সীমাবদ্ধ। ঈদগাঁও বাজারে যাওয়ার সুযোগ ছিলো আমাদের। ঈদগাঁও বাজারে গেলে মোটামুটি যাবতীয় খবরাখবর পাওয়া যেতো। আমরা ঈদগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাদের উপরে বসে যাবতীয় কিছুর উপর নজর রাখতাম। স্কুলের মাঠ থেকে বিল্ডিং-এর ছাদের উপর দেখা যায় না বলেই আমাদের অবস্থান ছিলো নিরাপদ।
এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ। সেই দিন শনিবার। সাপ্তাহিক হাটের দিন। সংগত কারণেই সাপ্তাহিক হাটের দিন বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার ভীড় থাকে বেশি। এসময় আমি, বাবুল, মোহাম্মদ উল্লাহ (আমার ঘনিষ্ট বন্ধুদের অন্যতম, জালালাবাদ ইউনয়নের খামারপাড়ার মিয়াজিপাড়ার বাসিন্দা) স্কুলের ছাদের উপরে বসা ছিলাম। আছরের নামাজের পরে এটি জীপ গাড়ি নিয়ে কক্সবাজার থেকে ঈদগাঁও আসলেন পিডিপি প্রধান মৌলভী ফরিদ আহমদ। সাথে ছিলেন তার নিকট আত্মীয় এবং ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ছওয়ার কামাল। ছরওয়ার কামালের কোমরের দু’পার্শ্বে নিয়মিত ভাবে ঝুলানো থাকতো দু’টি গুলি ভর্তি রিভলবার। ছরওয়ার কামাল কক্সবাজার মহকুমা শান্তি কমিটির সাথে যুক্ত। ছরওয়ার কামালের অংগুলি হেলনে তখন অনেক কিছু হয়েছে। মাছুয়াখালীতে অনেক রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়ি উচ্ছেদ হয়েছে, অনেকের বসতবাড়ি হয়েছে দখল। তাদের অত্যাচারে অনেক রাখাইন পরিবার এসময় নাড়িকাটা ভিটাবাড়ির মায়া ত্যাগ করে হিজরত করে বার্মা চলে গেছে। তারা আর কোন দিন বাংলাদেশে ফিরে আসেনি। শুধু কি তাই? খোদ কক্সবাজার শহরে অনেক মুক্তিকামী বাঙালির বাড়ি উচ্ছেদ করেছে। অনেকের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে এই ছরওয়ার কামালের নির্দেশে। একাত্তর-এ তার প্রচণ্ড প্রতাপে বলা হয় বাঘে-মহিষে একঘাটে পানি খেয়েছে।
মৌলভী ফরিদ আহমদ ঈদগাঁও হাইস্কুলের মাঠে পৌঁছে স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্যদের নির্দেশ দিলেন ‘মালাউনদের’ বাড়িঘর পুঁড়িয়ে দিতে। যেই নির্দেশ সেই কাজ। শান্তি কমিটির স্থানীয় নেতৃবৃন্দ পিডিপি প্রধান মৌলভী ফরিদ আহমদের আগমনে ঈদগাঁও উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সমবেত হলেন। নেতার নির্দেশে ‘নারায়ে তকবির, পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ দিয়ে পালপাড়ার দিকে রওয়ানা দিলেন ‘পাকিস্তান রক্ষাকারী’ জনতা। একটু পরেই দেখলাম পালপাড়া থেকে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ছে। এসময় আমরা স্কুলের ছাদের উপর ভয়ে কুকড়ে যাচ্ছিলাম। আমরা স্কুলের সিঁড়ি ঘরের পশ্চিম পার্শ্বে লুকিয়ে থাকলাম। ওদিকে আগুনের লেলিহান শিখায় বঙ্গবন্ধুর ‘নৌকা প্রতীকে ভোট প্রদানকারী সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের’ বাড়িঘর পুঁড়ে ছাই হতে বেশি সময় লাগেনি। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে নিজেদের ‘জান’ বাঁচাতে পালিয়ে গেলেও মান বাঁচাতে পারেনি, পারেনি তাদর সম্ভ্রম, তাদের মাল বাঁচাতে। জান বাঁচাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় অনেক হিন্দু তরুণি, যুবতিসহ মা-বোন লাঞ্চিত হয়েছে। অস্থাবর সম্পত্তিসহ বাড়িঘর হারিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পূর্ব দিকের ভোমরিয়াঘোনার জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিলো। হিন্দু মুসলমানের শত শত বছরের অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সহাবস্থান মুহূর্তের মধ্যে ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন শত বছরের ভ্রাতৃপ্রতীম মুসলমানদের ঠুনকো ভালবাসার মোজেজা বুঝতে পারল। তাঁদের মধ্য মুসলমান সম্পর্কে অবিশ্বাস বাসা বেঁধে তা শাখা প্রশাখায় বিস্তৃতি লাভ করল। জঙ্গলের বন্য জীবজন্তুর সাথে রাত অতিবাহিত করে পরদিন যে যেভাবে পারে পরিবার পরিজন নিয়ে ভারতে, বার্মায় পালিয়ে গেল। পাকিস্তানী বাহিনীর দোসরদের বর্বরতা এখানেই শেষ নয়। তারা পর্যায়ক্রমে মাস্টার ছৈয়দুল আলম চৌধুরী, রাজা মিয়া, ভোমরিয়াঘোনার আবদুল জলিলসহ মুক্তিকামী লোকজনের বাড়ি ঘরে আগুন দিয়ে এক বিভিষিকাময় অবস্থার সৃষ্টি করল। এতে করে মানুষের মধ্যে ভয় ভীতি এবং আতঙ্ক বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমাকেও বাড়ি থেকে চাপাচাপি করতে থাকে কখন আমাদের বাড়িও পুঁড়িয়ে দেয় এই ভয়ে। ফলে ভয় সবার মনে বাসা বাঁধতে থাকে।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি আমাদের এস এস সি পরীক্ষার সময় ধার্য রয়েছে আগস্ট মাসে। যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে আমার পড়ালেখাও চাঙ্গে উঠে। তবে বাড়ির চাপে পড়ালেখার অভিনয় করতে থাকি। দেখতে দেখতে আগস্ট মাস এসে গেলো। এস এস সি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য কক্সবাজারে যাই। পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য কক্সবাজারের বইল্লা পাড়ায় আমাদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায় উঠি। পরীক্ষা দেয়ার জন্য আমার সাথে ছিল আমাদের আর এক আত্মীয় বদরুল ইসলাম। পরীক্ষা শুরু হল। কয়েকটি পরীক্ষা দিয়ে ফেল্লাম। কক্সবাজার গিয়ে আমরা জানতে পারলাম অনেক ছাত্রলীগ নেতাকে পাকিস্তানী বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন সরকারি রেস্ট হাউসে পাকিস্তানী বাহিনী অবস্থান নিয়েছে। সেই রেস্ট হাউসের পূর্ব দিকের পাতকুয়াকে পাকি বাহিনী করেছে মৃত্যুকূপ। মুক্তিকামী বাঙালিকে মৃত্যুকূপে হত্যার পরে রেস্ট হাউসের পশ্চিম পার্শ্বের বালিয়াড়ির খোলা আকাশে তাদের লাশ ফেলে দেয়া হতো। অথবা বালু চাপা দেওয়া হতো। এসব লাশ হতো শেয়াল কুকুরের খাবার। এসব জানার পরে অজান্তেই মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেল। একই সাথে জানতে পারলাম আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও ঈদগাঁও সংগ্রাম কমিটির সদস্য মাস্টার ছৈয়দুল আলম চৌধুরীকে পাকিস্তানী বাহিনী ধরে কক্সবাজারে নিয়ে এসেছে। এদিকে যুদ্ধের তীব্রতা দিন দিন বাড়ার প্রেক্ষিতে পরীক্ষা শেষ না করে আমি বাড়িতে পালিয়ে আসলাম। মনের মধ্যে ভয় ছিলো কখন আবার ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে আমাদেরকে পাক হানাদারদের হাতে তুলে দেয়া হয়। কক্সবাজারের সাম্প্রতিক সময়ের অবস্থা বাড়িতে বর্ণনা করাতে তারাও পরীক্ষার জন্য আর জোড়াজুড়ি করলো না। বাড়ি ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী রাজা মিয়া, ছুরত আলমসহ অন্যদের সাথে যোগাযোগ করলাম।
আগস্টের শেষ সপ্তাহে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম। আগেই খবর নিয়েছিলাম ঈদগড়ের পাহাড়ী এলাকায় আমার পরিচিত, ঈদগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের অনেক বন্ধু-বান্ধব রয়েছে। তার মধ্যে রাজা মিয়া, এচারুল হক, নূরুল ইসলাম বাঙ্গালী, সিরাজুল হক রেজা। তারা সবাই দেশকে স্বাধীন করার জন্য, দেশ থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের তাড়াবার জন্য বাড়িঘর ছেড়ে, নিজের পিতা-মাতা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, আরাম-আয়েশ ছেড়ে জঙ্গলে বন্যপ্রাণীর সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছে। জঙ্গলের বন্যপ্রাণীর সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
ঈদগড় আগে থেকেই আমার পরিচিত এলাকায়। প্রায় পাঁচ বছর আগে আমি ঈদগড়ে ছিলাম। ছিলাম বেশ কিছু দিন। ঈদগড় পৌঁছে কুদালিয়াকাটায় আমার পূর্ব পরিচিত বন্ধু মোহাম্মদ হোসেনের বাড়িতে উঠলাম। ফলে ঈদগড়ের রাস্তাঘাট চিনতে আমার অসুবিধা হয়নি। ঈদগড়ে আমার স্কুলের সহপাঠিদের মধ্যে ছিল সোলাইমান, ওসমান, জামাল। স্কুলের জুনিয়রদের মধ্যে ইসহাক, মনিরুজ্জামানসহ অনেকেই। মোহাম্মদ হোসেনের বাড়িতে থেকেই গভীর জঙ্গলে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করলাম। মোহাম্মদ হোসেনের হোসেনের দেখানো পাহাড়ি পথ বেয়ে অনেক গভীরে মুরুং পাড়ায় চলে গেলাম এবং আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধব ও অপরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগদান করলাম। তাঁদের সাথে থেকে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিতে থাকি। এরপরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর।
৬ ডিসেম্বর কক্সবাজারে মিত্রবাহিনী বোমা হামলা বর্ষণ করে। একই সাথে বঙ্গোপসাগরে অবস্থানকারী যুদ্ধ জাহাজ থেকে গোলা নিক্ষেপ করে। ৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী কক্সবাজার বিমান বন্দরে প্রথম বোমা হামলা করে। বোমার আঘাতে বিমান বন্দর, রানওয়ে, টার্মিনাল মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মিত্রবাহিনীর বোমার আঘাতে কক্সবাজার মহকুমা শান্তি কমিটির সভাপতি এডভোকেট মাঈদুর রহমান মারা যান। পাকিস্তান রক্ষার অগ্রসৈনিক মাঈদুর রহমান চকরিয়া থানার (বর্তমানে পেকুয়া থানা) বারবাকিয়া ইউনিয়নের জমিদার পরিবারের সদস্য। সেই বোমার আঘাতে আরো অনেকেই আহত হয়েছিল। বোমা বষর্ণকালের অনেক সাক্ষী এখনো জীবিত আছেন।
৬ ডিসেম্বর যখন মিত্রবাহিনীর বোমাবর্ষণ হয় তখন আমরা ছিলাম ঈদগড়ের জঙ্গলে। বোমার আঘাতে তখন ঈদগড়ও প্রকম্পিত হয়ে উঠে। কক্সবাজার বিমান বন্দরে মিত্রবাহিনীর বোমা বর্ষণে পাওয়ার হাউসও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আমরা জঙ্গলে অবস্থান করে ভাবতেও পারিনি এত তাড়াতাড়ি দেশ শত্রুমুক্ত হবে। মিত্রবাহিনীর বোমা বর্ষণের ঐদিনই পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের সহযোগিরা কক্সবাজার ত্যাগ করে। কক্সবাজার বিমান বন্দরে মিত্রবাহিনীর নিক্ষিপ্ত অবিস্ফোরিত বোমা ১৯৭২ সালে দীর্ঘদিন ধরে বিমান বন্দরের রানওয়েতে পড়ে ছিল। মিত্রবাহিনী কর্তৃক কক্সবাজারে বোমা বর্ষণের পরে প্রতিবেশি বার্মায় আশ্রয় নেয়া লোকজন দেশে ফিরতে শুরু করে। মিত্রবাহিনী কর্তৃক বোমা বর্ষণের পরেই পাকিস্তানী বাহিনী কক্সবাজার ছেড়ে চলে যেতে থাকে। মাত্র ছয়দিন পরে কক্সবাজার মুক্ত হয়। ১২ ডিসেম্বর কক্সবাজারে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয়। পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পনের মাধ্যমে দেশ শত্রুমুক্ত হয়। কিন্তু বিজয়ের পরে কি দেখলাম? গঠিত হলো ইউনিয়ন ও গ্রাম পঞ্চায়েত, রিলিফ কমিটি। যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশ গঠনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার মনোনিবেশ করলেন। ক্ষতিগ্রস্থ লোকজনকে পুনর্বাসনে সরকার এগিয়ে আসলেন। ইউনিয়ন ও গ্রাম পঞ্চায়েত কমিটি ও রিলিফ কমিটিতে স্থান করে নেয় স্বাধীনতা বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের শত্র“রা, পাকিস্তান রক্ষাকারী রাজনৈতিকদলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। শুধু তাই নয়, পুসর্বাসনের তালিকায় পিডিপি’র নেতা-কর্মীদের নাম দেখা গেল শীর্ষে। সংগত কারণেই মানুষ আশাহত হলো। ধাঁক্কা খেলো প্রচণ্ড ভাবে। শুধু এখানে শেষ নয় যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি এমন অনেকেই সনদ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধারা গোপনে স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে গিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের ব্যবস্থা করেন। শুধু তাই নয় ঈদগাঁও বাজারের বিভিন্ন দোকান-পাঠ এবং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান লুটপাঠ করেছিল, লুটপাঠে অংশ নিয়েছিল তারা এবং তাদের সহযোগিরাও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট জোগাড় করে মুক্তিযোদ্ধা বনে গেল। এতে করে প্রচলিত প্রবাদ অনুযায়ী এটাই প্রমাণিত হল, ‘যারা গাছের টা খেতে পারে তারা গোড়ারটাও কুড়িয়ে খেতে পারে।’
(বিদ্র ঃ সংগ্রাম কমিটির তালিকা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে আয়কর উপদেষ্টা জনাব ছৈয়দুল হক, সংগ্রাম কমিটির সেক্রেটারী জনাব জাবের আহমদ চৌধুরী, ঈদগাঁও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের দীর্ঘ দিনের শিক্ষক গোপাল কৃষ্ণ শর্মা, এস টি এম রাজা’র কাছ থেকে। এই তালিকা যে পূর্ণাঙ্গ তা জোর করে কেউ বলতে পারছেন না। স্মৃতি থেকে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত ভাবে কারো নাম বাদ গেলে তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। সংগ্রাম কমিটিতে ছিলেন এবং তালিকা সম্পর্কে ধারণা পোষন করেন এরকম কেউ থাকলে তালিকাটি সরবরাহ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। ভবিষ্যতে তালিকাটি পূর্ণাঙ্গ করার চেষ্টা করবো। ২০১০ সালে এই লিখাটি স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করে। তবে এযাবৎ কেউ এই তালিকা সম্পর্কে কোন অভিযোগ করেননি।-লেখক।)
islamcox56@gmail.com
তথ্যসূত্রঃ
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, প্রতীতি প্রকাশনা, ডিসেম্বর ২০০