রবিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৩

মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ বাংলা সাংবাদিকতার পথিকৃ


আজ ১৮ আগস্ট মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁর ৪৪তম মৃত্যু বার্ষিকী। তিনি বাংলা সংবাদপত্র ও বাঙালি সাংবাদিকতার পথিকৃত। মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং ইসলামী পণ্ডিত। তাঁকে বাংলা ভাষার সংবাদপত্রের জনক বললে অতুক্তি হবে না। তিনি বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদের (১৯৩৬-১৯৯২) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন।
আকরাম খান ১৮৬৮ সালে পশ্চিম বঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার হাকিমপুর এলাকায় জন্ম গ্রহন করেন।  প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর খুব বেশি ছিল না। পড়ালেখার জন্য তিনি ইউরোপ বা বৃটিশ যাননি। তিনি কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেন। খুব অল্প বয়সেই তাঁর সাংবাদিকতা পেশায় হাতেখড়ি।
১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ দৈনিক আজাদ পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করেন। সেই সময় বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল এবং দৈনিক আজাদ ছিল বাংলাভাষার প্রথম সংবাদপত্র। মুসলিম লীগের সমর্থন যোগাতে এই বাংলা পত্রিকাটি সেই সময় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ ১৯০৮ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত দি মোহাম্মদী ও আল-ইহসান পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। আহলে হাদীস ও মোহাম্মদী আকবর পত্রিকায় তাঁর সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। তিনি ১৯২০ থেকে ১৯২২ পর্যন্ত সময়ে কলকাতা থেকে জামানা ও সেবক পত্রিকা প্রকাশ করেন। তৎকালীন সময়ে তিনি সেবক পত্রিকার মাধ্যমে অসহযোগ আন্দোলন ও স্বদেশী আন্দোলন সমর্থন প্রদান করেন। এর মধ্য দিয়ে স্বদেশী আন্দোলন ও অনহযোগ আন্দোলন বেগবান হয়। একপর্যায়ে বেনিয়া ব্রিটিশ সেবক পত্রিকা বন্ধ করেন দেয় এবং তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
মাওলানা মুহম্মদ আকরাম খাঁ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে রাজনীতি শুরু করেন। মওলানা আকরাম ছিলেন ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগের একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯১৮ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি খেলাফত এবং অসহযোগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯২০ সালে ঢাকার আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে তিনি নিখিল ভারত খেলাফত আন্দোলন কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনে খেলাফত আন্দোলনের অন্যতম নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদি এবং মওলানা মজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। আকরাম খাঁনের দায়িত্ব ছিল তুর্কি খেলাফত থেকে ফান্ড সংগ্রহ করা। ১৯২০-১৯২৩ সময়ের মধ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন স্থানে জনসভা বা সম্মেলনের আয়োজন করে খেলাফত আন্দোলন এবং অসহযোগ আন্দোলন  গতিশীল করার চেষ্ঠা করেন। হিন্দু মুসলিম ভাতৃত্বের ক্ষেত্রে ১৯২২ সালে আকরাম খাঁ চিত্ত রঞ্জন দাসের স্বরাজ পার্টির পক্ষ নেন। এবং ১৯২৩ সালের বাংলা সন্ধির সময়ও তিনি একই পক্ষে ছিলেন। ১৯২৬-১৯২৭ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং অন্যান্য সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলীর কারণে আকরাম খাঁ ভারতীয় রাজনীতিতে তার বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন এবং তিনি স্বরাজ পার্টি এবং কংগ্রেস থেকে সরে দাঁড়ান। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যে তিনি গ্রাম্য রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩৬ সালে তিনি  গ্রাম্য রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে সক্রিয় ভাবে মুসলিম লীগের সাথে যুক্ত হন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের পর তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন এবং ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
মাওলানার সাহিত্য কর্মের মধ্যে রয়েছে, ১. সমস্যা ও সমাধান, ২. আমপারার বাংলা অনুবাদ, ৩. মোস্তফা-চরিত,
৪. মোস্তফা-চরিতের বৈশিষ্ট্য, ৫. বাইবেলের নির্দেশ ও প্রচলিত খ্রীষ্টান ধর্ম, ৬. মুসলীম বাংলার সামাজিক ইতিহাস, ৭. তাফসীরুল কোরআন (১-৫ খন্ড)।
মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ ১০১ বছর বয়সে ১৯৬৯ সালের ১৮ আগষ্ট রাজধানী বংশালে আহলে হাদীস মসজিদে নামাযরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। আমি তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। আল্লাহ্ তাঁকে বেহেস্তে নসীব করুন।
বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বাংলদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার (মরনোত্তর) স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, ১৯৮১ প্রদান করেন।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক।
islamcox56@gmail.com

রবিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৩

আহলি কিতাবীরা কী মুসলিম?


আহলি কিতাবীরা কী মুসলিম? আহলি কিতাবীদের ধর্ম কী ইসলাম? আহলি কিতাবী ঈসায়ী ও মূসায়ী তথা ইহুদী ও নাসারাদের সাথে উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর মধ্যকার বিয়ে কী বৈধ? এ প্রশ্ন এখন ঘুরে-ফিরে আসছেই। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে আলোচনার পরেই বিষয়টি আলোচিত। অনেক সম্মানিত মুফাস্সির মনে করেন যে, এটা একটি মিমাংসিত বিষয়। ফলে নতুন করে আলোচনা আসা কেন? 
শুরুতেই একটি বিষয় সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকা দরকার যে, আহলি কিতাব কী বা কারা আহলি কিতাব? পবিত্র কুরআন মজিদে বলা হয়েছে, “যাদের কাছে আগের নবীদের আনা কোন আসমানী কিতাব ছিল, তা যত বিকৃত আকারেই থাক না কেন, তারা তা মেনে চলতো, তাদেরকে বলা হয় আহলি কিতাব। আহলি কিতাব ও মুশরিক উভয় দলই কুফরী কর্মকাণ্ডে জড়িত হলেও দু’দলকে দু’টি পৃথক নামে ডাকা হয়। আর তা হচ্ছে আহলি কিতাব ও মুশরিক। যারা কোন নবীর অনুসারী ছিল না, কোন আসমানী কিতাবও মানতো না বা মানে না তারা মুশরিক।” কুরআন মজিদের বহু স্থানে আহলি কিতাবদের শিরকের উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন খ্রীস্টানদের (নাসারাদের) সম্পর্কে বলা হয়েছে ঃ “তারা বলে, আল্লাহ্ তিন খোদার একজন।” (সূরা আল মায়েদাহ ৭৩) “তারা মসীহকেও খোদা বলে।” (সূরা আল মায়েদাহ ১৭) “তারা মসীহকে আল্লাহ্র পুত্র গণ্য করে।” (সূরা আত তাওবা ৩০) আবার ইহুদিদের সম্পর্কে বলা হয়েছে ঃ “তারা উযাইরকে আল্লাহ্র পুত্র বলে” (সূরা আত তাওবা ৩০) কিন্তু এসব সত্ত্বেও কুরআনের কোথাও তাদের জন্য মুশরিক পরিভাষা ব্যবহার করা হয়নি। বরং তাদের উল্লেখ করা হয়েছে “আহলি কিতাব” বা “যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল” শব্দের মাধ্যমে। অথবা ইহুদী ও নাসারা শব্দদ্বয়ের মাধ্যমে। কারণ তারা আসল তাওহিদী ধর্ম মানতো, তারপর ক্রমান্বয়ে তারা শিরকে লিপ্ত হয়।   
এখানে তিনটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, আহলি কিতাবীরা মুসলিম (ছিলেন)। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, তাদের ধর্ম ইসলাম, এতে কোন সন্দেহ নেই। এবং তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, আহলি কিতাবী ঈশায়ী ও মূসায়ী বা ইহুদী ও নাসারাদের সাথে উম্মতে মুহাম্মদী সা.-এর মধ্যকার বিয়ে একসময় বৈধ ছিল। তবে এখন সেই বিয়ে বৈধ নয়। কোন আহলি কিতাবী উম্মতে মুহম্মদী স. হওয়ার পরেই বিয়ে বৈধ। আহলি কিতাবীরা মুসলিম ছিলেন। ব্রাকেট দিয়ে বলা হয়েছে ‘ছিলেন’। কেউ শিরকে লিপ্ত হলে মুসলিম থাকার প্রশ্নই আসে না।
উত্থাপিত প্রথম এবং দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর নিন্মের আলোচনা থেকে পেতে পারি। আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কুরআন মজিদে স্পষ্ট করে বলেছেন যে, আহলী কিতাবীরাও মুসলিম এবং তাদের ধর্মও ইসলাম।  
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল কাসাস-এর ৫২ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, “যাদেরকে আমি এর আগে কিতাব দিয়েছিলাম তারা এর (কুরআন) প্রতি ঈমান আনে।”
এর অর্থ এই নয় যে, সমস্ত আহলে কিতাব (ইহুদী ও ঈসায়ী) এর প্রতি ঈমান আনে। বরং এ সূরা নাযিল হবার সময় যে ঘটনা ঘটেছিলো এখানে আসলে সেদিকে ইশারা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মক্কাবাসীদেরকে লজ্জা দেয়াই উদ্দেশ্য যে, তোমাদের নিজেদের বাড়িতে যে নিয়ামত এসেছে তাকে তোমরা প্রত্যাখ্যান করছো। অথচ দূরদেশ থেকে লোকেরা এর খবর শুনে আসছে এবং এর মূল্য অনুধাবন করে এ থেকে লাভবান হচ্ছে। যেমন সে সময় হাবশা ও ইয়াসরীবের লোকজন এসে আল্লাহ্র নবী স.-এর কাছে বাইয়াত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। 
পবিত্র কুরআন মজিদ-এর সূরা আল কাসাস-এর ৫৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আর যখন তাদেরকে এটা শুনানো হয় তখন তারা বলে, “আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি, এটি যথার্থই সত্য আমাদের রবের পক্ষ থেকে, আমরা তো আগে থেকেই মুসলিম।”
এর মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এর আগেও আমরা নবীদের এবং আসমানী কিতাবের আনুগত্য করে এসেছি। তাই ইসলাম ছাড়া আমাদের অন্য কোনো দীন ছিলো না। আর এখন যে নবী আল্লাহ্র পক্ষ থেকে কিতাব নিয়ে এসেছেন তাকেও আমরা মেনে নিয়েছি। কাজেই মূলত আমাদের দীনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং আগেও যেমন আমরা মুসলমান ছিলাম তেমনি এখনও মুসলমান আছি।
একথা থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স. যে দীনের দাওয়াত দিয়েছেন তার নামই শুধু ইসলাম নয় এবং ‘মুসলিম’ পরিভাষাটি শুধুমাত্র নবী করীম স.-এর অনুসারীগণ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। বরং সব সময় এ ইসলামই ছিলো সকল নবীর দীন এবং সব জমানায় তাঁদের সবার অনুসারীগণ মুসলমানই ছিলেন। হযরত আদম আ. ছিলেন প্রথম মানুষ এবং প্রথম নবী। সেই থেকে শেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ স. পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলগণ ইসলামই প্রচার করেছেন। শেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ স. এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তাঁর মনোনীত জীবন বিধান পূর্ণাঙ্গ ইসলামেরই প্রচার করেছেন। তাই পরবর্তী যে কোন নবী-রাসূলের আনীত বিধানের সাথে পূর্ববর্তী কোন নবীর আনীত অবিকৃত ইসলামী বিধানের উপর বিশ্বাস স্থাপন ঈমানের অন্যতম শর্ত। মুসলমানরা যদি কখনো পরবর্তীকালে আগত কোনো সত্য নবীকে মানতে অস্বীকার করে থাকে তাহলে কেবল তখনই তারা কাফের হয়ে গিয়ে থাকবে। কিন্তু যারা পূর্বের নবীকে মানতো এবং পরের আগত নবীকেও মেনে নিয়েছে তাদের ইসলামে কোনো ছেদ পড়েনি। তারা পূর্বেও যেমন মুসলমান ছিলো, পরেও তেমনি মুসলমান।
প্রকৃত পক্ষে, পবিত্র কুরআন মজিদ কেবলমাত্র এই একটি স্থানেই নয়, বরং অসংখ্য জায়গায় এ সত্যটি বর্ণনা করেছেন। কুরআন বলছে, আসল দীন হচ্ছে একমাত্র ‘ইসলাম’ (আল্লাহ্র আনুগত্য) এবং আল্লাহ্র বিশ্ব-জাহানে আল্লাহ্র সৃষ্টির জন্য এছাড়া দ্বিতীয় কোনো দীন বা ধর্ম হতে পারে না। সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে যে নবীই মানুষকে পথনির্দেশ দেবার জন্য এসেছেন তিনি এ দীনই নিয়ে এসেছেন। আর নবীগণ হামেশাই নিজেরা মুসলিম থেকেছেন, নিজেদের অনুসারীদেরকে মুসলিম হয়ে থাকার তাকিদ দিয়েছেন এবং তাঁদের যেসব অনুসারী নবুওয়াতের মাধ্যমে আগত আল্লাহ্র ফরমানের সামনে আনুগত্যের শির নত করে দিয়েছেন তারাও প্রতিটি যুগে মুসলমিই ছিলেন। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত স্বরূপ শুধুমাত্র কয়েকটি আয়াত পেশ করা যায়-
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আলে ইমরানের ১৯ নম্বর আয়াতে বর্ণিত, “আসলে আল্লাহ্র কাছে ইসলামই একমাত্র দীন।”
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা ইউনুস-এর ৭২ নম্বর আয়াতে বর্ণিত, “আর যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন অবলম্বন করে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না।”
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল বাকারাহ-এর ১৩১, ১৩২ ও ১৩৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত, “যখন তার রব তাকে বললেন, মুসলিম (ফরমানের অনুগত) হয়ে যাও, সে বললো, আমি মুসলিম হয়ে গেলাম রব্বুল আলামীনের জন্য। আর এ জিনিসটিরই ওসিয়াত করে ইবরাহীম তার সন্তানদেরকে এবং ইয়া’কূবও ঃ হে আমার সন্তানরা! আল্লাহ্ তোমাদের জন্য এ দীনটিই পছন্দ করেছেন। কাজেই মুসলমি না হয়ে তোমরা কখনো মৃত্যুবরণ করো না। তোমরা কি তখন উপস্থিত ছিলে যখন ইয়া’কূবের মৃত্যুর সময় এসে গিয়েছিলো, যখন সে তার পুত্রদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলো, আমার মৃত্যুর পর তোমরা কার ইবাদত করবে? তারা জবাব দিয়েছিল, আমরা ইবাদত করবো আপনার ইলাহ-এর এবং আপনার বাপ-দাদা ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের ইলাহ-এর, তাঁকে একক ইলাহ হিসেবে মেনে নিয়ে। আর আমরা তাঁরই অনুগত-মুসলিম।” 
“ইবরাহীম ইহুদী ছিলো না, খৃষ্টানও ছিলো না, বরং ছিলো একনিষ্ট মুসলিম।”
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল বাকারাহ-এর ১২৮ নম্বর আয়াতে স্বয়ং হযরত ইবরাহীম আ. ও হযরত ইসমাঈল আ. দোয়া করেন এভাবে, “হে আমাদের রব! আমাদেরকে তোমার মুসলিম (অনুগত) করো এবং আমাদের বংশ থেকে একটি উম্মত সৃষ্টি করো যে হবে তোমার অনুগত (মুসলিম)।”
হযরত ইউসূফ আ. মহিমান্বিত রবের দরবারে নিবেদন করেন :
“আমাকে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু দান করো এবং সৎকর্মশীলদের সাথে মিলিয়ে দাও।”
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা ইউনুস এর ৮৪ নম্বর আয়াতে হযরত মূসা আ. তঁাঁর নিজের জাতিকে বলেন :
“হে আমার জাতি! যদি তোমরা আল্লাহ্র প্রতি ঈমান এনে থাকো, তাহলে তাঁর ওপরই ভরসা করো যদি তোমরা মুসলিম হয়ে থাকো।”
বনী ইসরাঈলের আসল ধর্ম ইহুদীবাদ নয়, বরং ইসলাম ছিলো। বন্ধু ও শত্রু সবাই একথা জানতো। কাজেই ফেরাঊন সাগরে ডুবে যেতে যেতে যে শেষ কথাটি বলে তা হচ্ছে ঃ পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা ইউনুস এর ৯০ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, “আমি মেনে নিলাম বনী ইসরাঈল যার প্রতি ঈমান এনেছে তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই এবং আমি মুসলিমদের অন্তরভুক্ত।”
বনী ইসরাঈলের সকল নবীর দীনও ছিলো এ ইসলাম। যা সূরা আল মায়েদাহ-এর ৪৪ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, “আমি তাওরাত নাযিল করেছি, যাতে ছিলো হেদায়াত ও আলো, সে অনুযায়ী সে নবীগণ যারা মুসলিম ছিল তাদের বিষয়াদির ফয়সালা করতো যারা ইহুদী হয়ে গিয়েছিলো।”
আর এটিই ছিল হযরত ঈসা আ. ও তাঁর হাওয়ারীদের (সহযোগী) দীন। যা পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল মায়েদাহ-এর ১১১ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “আর যখন আমি হাওয়ারীদের প্রতি (কাছে) ওহী পাঠালাম যে, ঈমান আনো আমার প্রতি এবং আমার রসূলের প্রতি, তখন তারা বললো, আমরা ঈমান এনেছি এবং সাক্ষী থাকো আমরা মুসলিম।”
আসলে এ আয়াতগুলোতে যে কথাটি বলা হয়েছে তা হচ্ছে, আল্লাহ্র পক্ষ থেকে যে প্রকৃত দীনটি এসেছে তা খৃষ্টবাদ, মূসাবাদ বা মুহাম্মদবাদ নয় বরং তা হচ্ছে নবীগণ ও আসমানী কিতাবসমূহের মাধ্যমে আগত আল্লাহ্র ফরমানের সামনে আনুগত্যের শির নত করে দেয়া এবং এ নীতি আল্লাহর যে বান্দা যেখানেই যে যুগেই অবলম্বন করেছে সে-ই হয়েছে একই বিশ্বজনীন, আদি ও  চিরন্তন সত্যদীনের অনুসারী। সে সত্যদীন হলো ইসলাম। যারা এ দীনকে যথার্থ সচেতনতা ও আন্তরিকতা সহকারে গ্রহণ করেছে তাদের জন্য মূসার পরে ঈসাকে এবং ঈসার পরে মুহাম্মদ সা.-কে মেনে নেয়া ধর্ম পরিবর্তন করা হবে না, বরং হবে প্রকৃত ও আসল ধর্মের অনুসরণ করার স্বাভাবিক ও ন্যাগসংগত কাজ। পক্ষান্তরে যারা আম্বিয়া আ.-এর উম্মতের মধ্যে না জেনে-বুঝে ঢুকে পড়েছে অথবা তাঁদের দলে জন্ম নিয়েছে এবং জাতীয় ও বংশীয় স্বার্থপ্রীতি যাদের জন্য আসল ধর্মে পরিণত হয়ে গেছে তারা ইহুদী ও খৃস্টান হয়ে রয়ে গেছে এবং শেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ সা.-এর আগমনে তাদের মূর্খতা ও অজ্ঞতার হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে গেছে। কারণ তারা আল্লাহ্র শেষ নবীকে অস্বীকার করেছে। আর এটা করে তারা শুধু যে নিজেদের ভবিষ্যতে মুসলিম হয়ে থাকাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তাই নয়, বরং নিজেদের এ কার্যকলাপের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করে দিযেছে যে, তারা আসলে ইতিপূর্বেও মুসলিম ছিলো না, নিছক একজন নবীর বা কয়েকজন নবীর ব্যক্তিত্বের ভক্ত ও অনুরক্ত ছিল। অথবা পিতা-প্রপিতার অন্ধ অনুকরণকে ধর্মীয় আচারে পরিণত করে রেখেছিলো।
এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে তারা মুসলিম ছিলেন এবং তাদের ধর্ম ইসলাম। কিন্তু পরবর্তীতে এই সব আহলে কিতাবীদের অনেকেই আল্লাহ্ তা’আলার একত্ববাধের উপর ঈমান আনলেও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স.-এর প্রতি ঈমান আনেনি, আল্লাহ্র নবী স.-এর প্রতি প্রেরিত পবিত্র কুরআন মজিদের প্রতি ঈমান আনেনি। তারা দোয়াল্লিন ও মগদুব পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্ত। তারা অমুসলিম, তারা ইসলামকে অস্বীকারকারী, তারা জালেম, তারা আল্লাহ্ তা’আলার অবাধ্য, তারা অবিশ্বাসী। আর সে কারণেই মুমিনদেরকে আহলে কিতাবীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না রাখার ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কুরআন মজিদে নিষেধ করেছেন। 
আহলে কিতাবীদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল-মায়েদাহ-এর ৫১ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “হে মুমিনগণ, তোমরা ইহুদী ও নাসারাকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।”
এই আয়াতে মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন ইহুদী ও নাসারাদের সাথে সামঞ্জস্য ও গভীর বন্ধুত্ব না করে। সাধারণ অমুসলিম এবং ইহুদী ও খ্রীস্টানদের রীতিও তাই। তারা গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে শুধু স্বীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে; মুসলমানদের সাথে এরূপ সম্পর্ক স্থাপন করে না।
এরপর যদি কোন মুসলমান এ নির্দেশ অমান্য করে কোন ইহুদী অথবা খ্রীস্টানের সাথে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে, তবে সে ইসলামের দৃষ্টিতে সে সম্প্রদায়ের লোক বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য।
তফসীরবিদ ইবনে জরীর ইকরামা রা.-এর বাচনিক বর্ণনা করেন ঃ এ আয়াতটি একটি বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছে। ঘটনাটি এই যে, রাসূলুল্লাহ্ সা. মদিনায় আগমনের পর পার্শ্ববর্তী ইহুদী ও নাসারাদের (খ্রীস্টানদের) সাথে এই মর্মে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন যে, তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিজেরা যুদ্ধ করবে না, বরং মুসলমানদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আক্রমণকারীকে প্রতিহত করবে। এমনিভাবে মুসলমানরাও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না এবং কোন বহিরাক্রমণকারীর সাহায্য করবে না, বরং আক্রমণকারীকে প্রতিহত করবে। কিছুদিন পর্যন্ত এ চুক্তি উভয় পক্ষেই বলবৎ থাকে, কিন্তু ইহুদীরা স্বভাবগত কুটিলতা ও ইসলাম বিদ্বেষের কারণে বেশিদিন এ চুক্তি মেনে চলতে পারল না এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে মক্কার মুশরিকদের সাথে ষড়যন্ত্র করে তাদেরকে স্বীয় দুর্গে আহবান জানিয়ে পত্র লিখল। রাসূলুল্লাহ্ সা. হযরত জিবরাঈল আ. কর্তৃক এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে তাদের বিরুদ্ধে একটি মুজাহিদ বাহিনী প্রেরণ করলেন। বনী-কুরায়যার এসব ইহুদী একদিকে মুশরিকদের সাথে হাত মিলিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এবং অপর দিকে মুসলমানদের দলে অনুপ্রবেশ করে অনেক মুসলমানের সাথে বন্ধুত্বের চুক্তি সম্পাদন করে রেখেছিল। এভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের জন্যে গুপ্তচর বৃত্তিতে লিপ্ত ছিল। এ কারণে আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং মুসলমানদেরকে ইহুদী ও নাসারাদের (খ্রীস্টানদের) সাথে গভীর বন্ধুত্ব স্থাপন করতে নিষেধ করে দেয়া হয়।
একই সাথে পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল মায়েদাহ-এর সূরা ৫৭ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের পূর্ববর্তী আহলে কিতাবের মধ্য থেকে যেসব লোক তোমাদের দীনকে বিদ্রুপ ও হাসি-তামাশার বিষয়ে পরিণত করেছে তাদেরকে এবং অন্যান্য কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। আল্লাহ্কে ভয় করো, যদি তোমরা  মুমিন হয়ে থাকো।”
সূরা আল-মায়েদাহ-এর ৫৯ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘তাদেরকে বলো, “হে আহলি কিতাব! আমাদের প্রতি তোমাদের ক্রোধের একমাত্র কারণ এই যে, আমরা আল্লাহ্র ওপর এবং দীনের সে শিক্ষার ওপর ঈমান এনেছি যা আমাদের প্রতি নাযিল হয়েছে এবং আমাদের আগেও নাযিল হয়েছিলো। আর তোমাদের বেশির ভাগ লোকই অবাধ্য।”
সূরা আল-মায়েদাহ্-এর ৬৫ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “যদি (বিদ্রোহের পরিবর্তে) এ আহলে কিতাব গোষ্ঠী ঈমান আনতো এবং আল্লাহভীতির পথ অবলম্বন করতো, তাহলে আমি তাদের থেকে তাদের দুষ্কৃতিগুলো মোচন করে দিতাম এবং তাদেরকে পৌঁছিয়ে দিতাম নিয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাতে।” সূরা আল-মায়েদাহ্-এর ৬৬ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “হায়, যদি তারা তাওরাত, ইনজীল ও অন্যান্য কিতাবগুলো প্রতিষ্ঠিত করতো, যা তাদের রবের পক্ষ থেকে তাদের কাছে পাঠানো হয়েছিলো! তাহলে তাদের জন্য রিযিক ওপর থেকে বর্ষিত হতো এবং নিচে থেকেও উত্থিত হতো। তাদের মধ্যে কিছু লোক সত্যপন্থী হলেও অধিকাংশই অত্যন্ত খারাপ কাজে লিপ্ত।”
কাজেই ইহুদী ও নাসারারা (খ্রীস্টানরা) যদি ধর্মগ্রন্থে আল্লাহ ও নবীদের পক্ষ থেকে উদ্বৃত প্রকৃত শিক্ষার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতো তাহলে নিঃসন্দেহে নবী সা.-এর আবির্ভাবকালে তাদেরকে একটি ন্যায়বাদী ও সত্যপন্থী দল হিসেবে পাওয়া যেতো। এক্ষেত্রে তারা পবিত্র কুরআন মজিদের মধ্যে সেই একই আলো দেখতে পেতো, যা পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর মধ্যে পাওযা যেতো। এ অবস্থায় নবী সা.-এর আনুগত্য করার জন্য তাদের ধর্ম পরিবর্তন করার আদতে কোনো প্রশ্নই দেখা দিতো না, বরং যে পথে তারা চলে আসছিল সে পথের ধারাবাহিক পরিণতি হিসেবেই তারা মুহাম্মদ সা.-এর অনুসারী হয়ে সামনে অগ্রসর হতে পারতো। অথচ তারা করেনি। তারা না করে অবাধ্য হয়েছে।  
আহলি কিতাবী ও উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর বিয়ের ব্যাপারে কিছু কিছু আলেমেদীন ও মুফাস্সির মনে করেন এই বিয়ে বৈধ। পাশাপাশি অনেক আলেমেদীন মনে করেন যে, এই বিয়ে বৈধ নয়। আমি ব্যক্তিগত ভাবে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে, আল্লাহ্র পবিত্র কুরআন সম্পর্কে সম্পূর্ণ মুর্খ ও অজ্ঞ। আমিও মনে করি যে আহলি কিতাবী এবং উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর মধ্যকার বিয়ে বৈধ নয়। যারা বিয়ে বৈধ মনে করেন তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, যে সব আহলি কিতাবী আল্লাহ্ তা’আলার একত্ববাদের উপর অবিচল আস্থা আছে তাদের সাথে উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর বিয়ে বৈধ। এখানেই শেষ নয়। আছে আরো কিছু যুক্তি আর তা হচ্ছে, আহলি কিতাবরা আল্লাহ্র নাম নিয়ে যদি কোন হালাল প্রাণীকে সঠিক পদ্ধতিতে যবেহ করে তাহলে তা মুসলমানদের জন্য তা হালাল গণ্য করা হয়েছে। তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে করারও অনুমতি দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে মুশরিকদের যবেহ করা প্রাণীও হালাল নয় এবং তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে করারও অনুমতি দেয়া হয়নি। পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল-মায়েদার ৫ নম্বর আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী কোনো কোনো মুফাস্সির আহলি কিতাবীদের মেয়েদের সাথে উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর পুরুষের সাথে বিয়ে বৈধ মনে করেন। উক্ত সূরায় বর্ণিত হয়েছে যে, “আজ তোমাদের জন্য সমস্ত পাক-পবিত্র বস্তু হালাল করা হয়েছে। আহলে কিতাবের খাদ্য দ্রব্য তোমাদের জন্য হালাল এবং তোমাদের খাদ্য দ্রব্য তাদের জন্য হালাল। আর সংরক্ষিত মেয়েরা তোমাদের জন্য হালাল, তারা ঈমানদারদের দল থেকে হোক বা এমন জাতিদের মধ্য থেকে হোক, যাদেরকে তোমাদের আগে কিতাব দেয়া হয়েছে। তবে শর্ত এই যে, তোমরা তাদের মোহরানা পরিশোধ করে দিয়ে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে তাদের রক্ষক হবে।”  
এখানে ব্যাখ্যায় আহলি কিতাবী বলতে ইহুদী-খৃষ্টানদের (নাসারাদের) কথা বলা হয়েছে। কেবলমাত্র তাদের নারীদেরকেই বিবাহ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আর এর সংগে শর্তও আরোপিত হয়েছে যে, তাদের ‘মুহসানাত’ (সংরক্ষিত মহিলা) হতে হবে। এ নির্দেশটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিরূপণের ব্যাপারে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর মতে এখানে আহলে কিতাব বলতে সেসব আহলে কিতাবকে বুঝানো হয়েছে যারা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রজা। অন্যদিকে দারুল হারব ও দারুল কুফরের ইহুদী ও খৃস্টান (নাসারা) মেয়েদের বিয়ে করা জায়েয নয়। হানাফী ফকীহগণ এর থেকে সামান্য একটু ভিন্নমত পোষণ করেন। তাদের মতে বহির্দেশের আহলে কিতাবের মেয়েদেরকে বিয়ে করা হারাম না হলেও মাকরূহ, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তারপর ‘মুহসানাত’ শব্দের অর্থের ব্যাপারেও ফকীহগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রা.-এর মতে ‘মুহসানাত’ অর্থ পবিত্র ও নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী মেয়েরা। ‘মুহসানাত’ শব্দের এ অর্থ গ্রহণ করার কারণে তিনি আহলে কিতাবের স্বেচ্ছাচারী মেয়েদের বিয়ে করাকে এ অনুমতির আওতার বাইরে রেখেছেন।          
এপ্রসঙ্গে সূরা আল মায়েদাহ-এর ১৯ নম্বর আয়াতে কি বলা হয়েছে তা আমরা দেখে নিতে পারি। আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “হে আহলি কিতাব! রসূলদের সিলসিলা দীর্ঘকাল বন্ধ থাকার পর প্রকৃত সত্যকে সুস্পষ্ট করার জন্য তোমাদের কাছে আমার রসূল এসেছে। যাতে তোমরা বলতে না পারো আমাদের কাছে না কোন সুসংবাদদানকারী এসেছিল, না এসেছিল কোন সতর্ককারী। কাজেই নাও,এখন তোমাদের কাছে সুসংবাদদানকারী এসে গেছে এবং সতর্ককারীও।”
এখানে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ স.-কেই একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ বলা হয়েছে। কিন্তু এর পরেও ইহুদী ও নাসারারা শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স.-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেনি। পবিত্র কুরআন মজিদের প্রতি একীন রাখেনি। যা সূরা আল বাকারাহ-এ তাদেরকে আহবান জানানোর পরেও তারা অবাধ্য থেকে গেছে।              
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল বাকারাহ-এর ২-৪ নম্বর আয়াতে বর্ণিত আছে যে, “এটি আল্লাহ্র কিতাব, এর মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। এটি হেদায়াত সেই মুত্তাকীদের জন্যে, যারা অদৃশ্যে ঈমান রাখে নামায কায়েম করে এবং যে রিযিক আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে খরচ করে। আর যে কিতাব তোমার ওপর নাযিল করা হয়েছে (অর্থাৎ কুরআন) এবং তোমার আগে যেসব কিতাব নাযিল করা হয়েছিলো সেগুলোর ওপর ঈমান আনে এবং আখেরাতের ওপর একীন রাখে।”
পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল বাইয়েনাহ নাযিল হয়েছে মূলত আহলি কিতাব ও মুশরিকদের চিহ্নিত করার জন্য, তাদের সম্পর্কে বর্ণনা করার জন্য। আহলি কিতাবদের গোমরাহী তুলে ধরার জন্য। সূরায় একথাটি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, যেসব আহলি কিতাব ও মুশরিক এই রসূলকে মেনে নিতে অস্বীকার করবে তারা নিকৃষ্টতম সৃষ্টি। তাদের শাস্তি চিরন্তন জাহান্নাম। আজকের আহলি কিতাবীরা আল্লাহ্র সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স.-কে অস্বীকার করেছে। (নাসারাদের) কেউ তিন আল্লাহ্র উপর বিশ্বাস করে। (ইহুদিদের) কেউবা শেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মদ স.-এর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। অথচ শেষ নবী মুহাম্মদ স.-এর প্রতি ভালবাসা ঈমানের অন্যতম শর্ত। ফলে তাদের সাথে যেমন বন্ধুত্ব করা অবৈধ, তেমনি ভাবে তাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কও অবৈধ। 
সূরা আল বাইয়েনাহ-এর ১-৩ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “আহলি কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কাফের তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ না আসা পর্যন্ত তারা (নিজেদের কুফরী থেকে) বিরত থাকতে প্রস্তুত ছিল না। অর্থাৎ আল্লাহ্র পক্ষ থেকে একজন রাসূল যিনি পবিত্র সহীফা পড়ে শুনাবেন, যাতে একেবারে সঠিক কথা লেখা আছে।” ২ নম্বর আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী ‘যারা কুফরী করে, যারা আহলে কিতাব ও মুশরিকদের দলের অন্তরভুক্ত। সূরা আল- বাইয়েনাহ-এর ৬ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে,“আহলি কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে তারা নিশ্চিতভাবে জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে।” এখানে কুফরী বলতে আল্লাহ্র নবী স.-কে মেতে নিতে অস্বীকার করা। অর্থাৎ মুশরিক ও আহলি কিতাবদের মধ্য থেকে যারা এই রাসূলের নবুওয়াত লাভের পর তাঁকে মানেনি।  
তাদের জন্য পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল বাকারাহ-এর ১৯-২০ নম্বর আয়াত প্রযোজ্য। সূরা আল বাকারাহ-এর ১৯-২০ নম্বর আয়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, “অথবা এদের দৃষ্টান্ত এই যে, আকাশ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। তার সাথে আছে অন্ধকার মেঘমালা, বজ্রের গর্জন ও বিদ্যুৎ চমক। বজ্রপাতের আওয়াজ শুনে নিজেদের মৃত্যুর ভয়ে এরা কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেয়। আল্লাহ্ এ সত্য অস্বীকারকারীদেরকে সবদিক থেকে ঘিরে রেখেছেন। বিদ্যুৎ চমকে তাদের অবস্থা এই হয়েছে যে, বিদ্যুৎ যেন অচিরেই তাদের দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নেবে। যখন সামান্য একটু আলো তারা অনুভব করে তখন তার মধ্যে তারা কিছুদূর চলে এবং যখন তাদের ওপর অন্ধকার ছেয়ে যায় তারা থমকে দাঁড়িয়ে যায়। আল্লাহ্ চাইলে তাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণরূপেই কেড়ে নিতে পারতেন। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছুর ওপর শক্তিশালী।” 
আহলি কিতাবীরা তাদের কিতাবের উপর ঈমান এনেছিল। কিন্তু আল্লাহ্র শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স.-এর উপর ঈমান আনেনি। পবিত্র কুরআনের উপর তাদের তাদের একীন নেই। সে কারণেই তারা জালিম, তারা আল্লাহ্র অবাধ্য। 
একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স.-এর উপর ওহী নাযিল হওয়ার পরে পূর্ববর্তী আমসানী কিতাবের কার্যকারীতা যে ভাবে স্থগিত হয়ে গেছে তেমনি ভাবে নতুন রাসূল আগমনের পরে পূর্ববর্তী নবীর কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে গেছে। যা মূলত স্থগিত হয়ে গেছে। উপরের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, যে সব আহলি কিতাবীরা পূর্ববর্তী নবীর উম্মত হিসেবে আল্লাহ্ তা’আলার একত্ববাদের উপর ঈমান এনেছিল তেমনি ভাবে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স.-এর প্রতি ঈমান আনলে, পবিত্র কুরআন মজিদের উপর একীন রাখলেই তাদের ইসলাম ধর্মের ধারা অব্যাহত থাকে। কিন্তু আল্লাহ্র রাসূল স.-কে এবং পবিত্র কুরআন মজিদকে অস্বীকার করে তাদের মুসলিম বলার বা তাদের ধর্ম ইসলাম বলার এখতিয়ার নেই। তেমনি এসব আহলি কিতাবীদের ধর্মগ্রন্থ মৌলিক অবস্থায় আছে কী না সেটাও ধর্তব্যের বিষয় নয়। তাদের ধর্মগ্রন্থ মৌলিক অবস্থায় থাকলেও পবিত্র কুরআন মজিদ নাযিল হওয়ার পরে পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থের কার্যকারীতা স্থগিত হয়ে গেছে। তবে আগের কিতাবের যেসব বিধান কোরআনের বিধানের সাথে মিল থাকবে ওগুলো কুরআনের বিধানের অন্তরভূক্ত বলেই গণ্য হবে। ফলে আহলি কিতাবী নারীদের সাথে উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর পুরুষের বিয়ে বৈধ হতে পারে কিনা ভেবে দেখা দরকার। (এবিষয়ে যুগের সম্মানিত ওলামায়ে কেরাম ও ফকিহগণের মতামত ব্যক্ত করে আমাদের সহযোগিতা করার জন্য সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি।)
আহলি কিতাবী ও উম্মতে মুহম্মদী স.-এর বিয়ের বিষয়টি মেনে নেয়া হলে ইসলাম যে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, এটি যে মানুষের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান এতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। কারণ ইসলাম শুধু আনন্দ উপভোগ করার জন্য বিয়ে শাদীর ব্যবস্থা করেনি। এর মাধ্যমে মানুষকে বেবিচার-অনাচার থেকে বাঁচিয়ে রাখা যেমন উদ্দেশ্য। তেমনি পরিশুদ্ধ সমাজ ব্যবস্থার জন্য খাঁটি অনুগত আল্লাহর (মুসলিম) বান্দা সৃষ্টি করাও উদ্দেশ্য। (পবিত্র কুরআন মজিদের ভাষায়) মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম আ. যেমনটি দোয়া করেছিলেন।  
আল্লাহ্ তা’আলা যেখানে ইহুদী ও নাসারাদের সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য নিষেধ করেছেন সেখানে আহলি কিতাবীদের সাথে উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর সাথে বিয়ের অনুমোদন বা বৈধতা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। বরঞ্চ তাদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করবে তারা তাদের দলে বলে স্বয়ং আল্লাহ ঘোষণা করেছেন পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল মায়েদাহ’এ। যাঁরা আহলি কিতাবী ও উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর মধ্যে বিয়ে বৈধ বলেন তাঁদের সূরা আল-মায়েদাহ-এর ৫১ নম্বর আয়াত এবং ৫ নম্বর আয়াত ও আয়াতের ব্যাখ্যা দৃষ্টির সামনে রাখার জন্য বিনীত অনুরোধ করব।  
এরপরেও কেউ আহলি কিতাবীদের সাথে উম্মতি মুহাম্মদী স.-এর বিয়ে বৈধ বলার অর্থ তা পবিত্র কুরআন মজিদের সাথে সাংঘর্ষিক ও আল্লাহ্র অবাধ্য আচরণ করা নয় কি? আল্লাহ্র অবাধ্যদের শাস্তি কী যাদের পবিত্র কুরআন মজিদ সম্পর্কে একটুও ধারণা রাখেন তারা ভাল ভাবেই জানেন।
বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য, পবিত্র কুরআন মজিদকে বুঝার জন্য আল্লাহ্ তা’আলা সবাইকে তওফীক দান করুন। আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে সাহায্য করুন। আল্লাহ্ আমাদের কবুল করুন। আমীন।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক।
islamcox56@gmail.com